জগদীশ নারায়ণ সরকার
ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ বিশ্বেন্দু নন্দ
অনুবাদকের কৈফিয়ত
বাঙলার ইতিহাসের যে খোঁজে কলাবতী মুদ্রা বা তার সঙ্গে থাকা উইভার্স, আর্টিজান এন্ড ট্রাডিসনাল আর্টিস্টস গিল্ড আর বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ মনে করে সেই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ হল ব্রিটিশ শক্তির হাতে সিরাজদ্দৌলার পতন। সেই ঘটনায় শুধু বাঙলার ইতিহাস নয় পালটে গেল বিশ্বের ইতিহাসও। সে সময়ের উদ্বৃত্ত অর্থনীতি থেকে যে সম্পদ, জ্ঞান আর প্রযুক্তি শুষে নিয়ে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, সেই সম্পদ কাজে লাগে নব্য ইওরোপের শিল্পায়ন ঘটাতে, এশিয়া আফ্রিকাকে পদানত করতে। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির প্রতি নিবেদিত অধিকাংশ ইতিহাস ব্রিটিশ শাসনের সময়ের কর্মকাণ্ড, তত্ত্ব ইত্যাদি ধরে কাজ করতে উতসাহী এবং তাঁদের এই কাজে প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহন ও উতসাহও তো রয়েছে। অথচ ব্রিটিশপূর্ব সময়টায় বাংলা কি ছিল, তার আলোচনা হয় নি নয়, হয়েছে, কিন্তু বড্ড অসম্পূর্ণ এবং ঔপনিবেশিক রসে জরানো, প্রায় প্রত্যেকেই চেষ্টা করছেন শিল্পায়িত ইওরোপের বিকাশের তত্ত্বের সঙ্গে বাঙলার বিকাশের রূপরেখা তৈরি করতে।
অথচ সুলতানি এবং তাঁর পরে মুঘল আমলে বাঙলার অর্থনীতি, তাঁর শিক্ষা, সামাজিক অবস্থা বিশ্বের অন্যতম নিদর্শন ছিল। বিশেষ করে অর্থনীতিতে।সে সময় বাংলা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উতপাদক, বিতরক অঞ্চল। ইওরোপে এমন কোন ভোগ্য পণ্য তৈরি হয় না যা বাংলা তথা ভারত তথা এশিয়ার বাজারে বিক্রি হতে পারে। অথচ স্বাধীনতার পর আজও পশ্চিমি প্রযুক্তি, জ্ঞান, শিক্ষায় বিপুল আযুত সম্পদ বিনিয়োগ সত্ত্বেও ভারতের অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির তুলনায় নগন্যতম হয়েই রয়েছে। কেন? তাহলে সেই পূর্বের সময়, ব্যবস্থা, কাজকর্মগুলো বোঝা দরকার গভীরভাবে।
ঠিক সেই জন্যই যদুনাথ সরকারের স্মরণ নিয়েছিলাম আমরা। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম পলাশীর ৫০ বছর আগে শেষ দৌর্দণ্ড প্রতাপ মুঘল পাদশাহ আওরঙ্গজেব মারা যান, তাঁর সময় ভারত কেমন ছিল। সেই জন্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন আর আহকমইআলমগিরির অনুবাদ। তো অনেক দিন ধরেই সেই সময়ের বাঙলার অবস্থা জানা বোঝার কাজ করার দিকে মন যাচ্ছিল। বন্ধু ইন্দ্রলীল বিশ্বাসের কারিগরীতে চাইবামাত্রই হাতে এসে গেল জগদীশ নারায়ণ সরকারের লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব।
আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলা বহুকাল বাংলা সুবায় কাটিয়েছেন। সেই সময়টার বাঙলার ইতিহাসে তিনি প্রায় নায়ক না হলেও, মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে বাঙলার সুবাদার হিসেবে। তার সময়ে পর্তুগিজেরা বাঙলার ইতিহাস থেকে অতিক্রান্ত। উত্থান হচ্ছে ডাচ আর ইংরেজদের, এবং তারা তাঁর নেতৃত্বকে সমীহ করছে। ঠিক যে কারণে আমরা পরম পত্রিকায় ডাচ বা মুঘল অর্থনীতি বা পলাশির পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রাম বুঝতে চাইছি, ঠিক সেই কারণে সেই সময়ের বাংলায় কাটানো গুরুত্বপূর্ণ আমলার জীবন আর তার সময়কে বুঝতে চাইছি, বুঝতে চাইছি সেই সময় বাংলা কোন জাদুতে সারাবিশ্বে অগ্রগণ্য ছিল। তাই এই বইটির অনুবাদ।
এই বইটা নিয়ে অসাধারণ একটা মুখবন্ধ লিখেছেন আচার্য যদুনাথ সরকার মশাই। ভারতের ইতিহাস বিশ্লেষণে অসাধারণ এই ঐতিহাসিকের অবদান চাপা পড়ে গিয়েছে বাম আর নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকদের রমরমায়। অথচ তার পরবর্তী প্রজন্মের ঐতিহাসিক বা ইতিহাসকে কিভাবে এগিয়ে দিতে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আচার্য মশাই। এমন কোন বিশেষণ নেই যা তিনি তার প্রশস্তিতে বর্ণনা করেন নি অনুজসম লেখক সম্বন্ধে। অথচ দুজনেরই এক সময় নিয়ে কাজ। জগদীশ নারায়ণের বইটি পড়ে তার নিজের সেই সময়ের বইটির তথ্যের প্রচুর ঘাটতি চোখে পড়ছে তা তিনি ছোট্ট মুখবন্ধে জানাতে ভোলেন নি। অসাধারন সেই হৃদয়বত্তা, যার উত্তপে তিনি জগদীশ নারায়ণকে আবাধে বিচরণ করতে দিয়েছেন নিজের সংগৃহীত পারসিক পাণ্ডুলিপির গ্রন্থাগারে। সেই মুখবন্ধ অনুবাদ প্রথম প্রকাশনায় গেল। এর পর থেকে সরাসরি চলে যাব তাঁর বই অনুবাদে।
যদুনাথ সরকারের দুটি বই অনুবাদ করতে গিয়ে প্রচুর মানুষ পাশে দাঁড়িয়ে সেটি সংশোধন, সম্মার্জন করে দিয়েছেন, উৎসাহ পেয়েছি প্রায় প্রত্যেকের কাছে। ভুল ত্রুটির দিকে নজর টানলে কৃতজ্ঞ থাকব।
জানি বহু মানুষেরই মূল বইটা ইংরেজিতে পড়া, আমাদের মত কিছু অশিক্ষিত অন্ধকারে হাতড়ানো মানুষ বাদ দিয়ে। এই অনুবাদটা তাঁদের কারোর জন্য নয়। আমারা যারা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইতিহাসের কিছু ভুলে যাওয়া কুড় খোঁজার কাজ করছি, তাঁদের জন্য। কারোর বাহুল্য মানে হলে স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যাবেন। এই কাজ কারোর যদি কাজে লাগে সেই সময়টাকে বুঝতে, জানতে তাহলেই সংগঠনের পক্ষে অনুবাদক কৃতজ্ঞ থাকবে।
প্রথম সংস্করণের প্রশস্তি
ইন্দো-মুসলমান ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীর অবদানের জন্য সর্বপ্রথমে লেখককে অভিবাদন জানাই। একাগ্র মনে এবং অত্যন্ত গভীরে গিয়ে সাত বছর ধরে তিনি মীর জুমলার জীবন অবলম্বন যে বইটি লিখেছেন, সেটিতে নতুন নতুন নানান সব তথ্য রয়েছে। বেশ কিছু যায়গায় আমার হিস্টোরি অব আওরঙ্গজেবএর বেশ কিছু তথ্য শুধরেও দিতে হবে। কেউ যদি মনে করেন এই বইটা আমার বইএর সুখপাঠ্য সংস্করণ তাহলে তিনি মিথ্যে ভাবছেন। যদিও এই দুই বইএর আলোচিত সময়সীমা, ১৬৪৭-১৬৬৩র মধ্যেকিছুটা মিল রয়েছে, কিন্তু তা এটা আমার বইটিতে ব্যবহৃত তথ্যের অনুলিখন নয়।
বর্তমান লেখক যেন ইতিহাসের ওপর অনুবীক্ষণ যন্ত্র ধরেছেন। আর আমি দূরবীক্ষণ যন্ত্র ধরে ইতিহাস পর্যালোচনা করছি। এ ছাড়াও তিনি এমন কিছু বিষয়, ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেগুলি আমি আলোচনাই করিনি। ফলে বইটির মৌলিকতার মূল্য অসাধারণ। মাত্র একটা উদাহরণই দেওয়া যাক, এই বইটির প্রথম আট পাতা ছাড়া মীর জুমলার জীবনীর সঙ্গে আমার বইটির তথ্যাবলীর বিন্দুমাত্র মিল নেই। মীর জুমলার অনুসৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ব্যবসাকর্ম, ইওরোপিয় বণিকদের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে বিশদে তথ্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন লেখক। এছাড়াও সুজার বিরুদ্ধে মীর জুমলার আক্রমণের ঘটনাবলী, আমার বইতে আমি সংক্ষেপে আলোচনা করেছি, এই বইতে বিপুল বিশদে, বিস্তৃত আকারে আলোচনা রয়েছে।
মহম্মদ গওয়ান, মালিক অম্বর এবং মীর জুমলা - এই তিনজন অভিজাতকে ভারতকে উপহার দিয়েছিল পারস্য (এখানে আমি পারস্য শব্দটা ব্যবহার করেছি শিয়া শব্দটা বোঝাতে)। ভারতের রঙ্গমঞ্চে এই তিনজন প্রায় অতিমানব (সুপারম্যান) তাঁদের সমস্ত দক্ষতা অধীতবিদ্যা আর জ্ঞান ঢেলে দিয়েছেন যুদ্ধ, কূটনীতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা আর ব্যবসা ব্যবস্থাপনায়। এই তিন রাজার প্রতিনিধির(কিংস অব মেন) মধ্যে মীর জুমলার ভাগ্য বিড়ম্বিত। তাঁর তুলনায় অন্য দুজন অনেক বেশি শান্তি ভোগ করেছেন। নিজেদের রাজ্যে তাঁরা সর্বোচ্চ মন্ত্রীত্বের পদে আরোহণ করেছিলেন। মীর জুমলা সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্বাসদ পাননি, তিনি বরাবই সেবা করে গিয়েছেন, বরাবরই তিনি অধস্তন কর্মচারীই থেকেছেন। এই বইতে মীর জুমলার বিস্তৃত জীবনের মাত্র সতের বছরের কাজ বিস্তৃত হয়েছে। কোন মানুষের চরিত্র বোঝা যায়, কতটা বিরোধিতা তিনি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করছেন, ভাগ্য কতটা তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং সেই লড়াইটা তিনি কতটা সাহসিকতায় লড়ছেন, সেই প্রেক্ষিতে। আমি যে তিনজনের কথা বললাম, মীর জুমলা তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতর।
এ ছাড়াও ঐতিহাসিক নথি-তথ্যাবলী সূত্রও মীর জুমলার প্রতি অনেক বেশি সদয়। তাঁর জীবনীকার ইওরোপিয় বণিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার সূত্র সেই সময়ের প্রায় দৈনন্দিন ঘটনা আলোচনা করেছেন। তাঁর জীবনের বিশাল অংশ কেটেছে দাক্ষিণাত্যের গোলকুণ্ডায়। পারসিক ঐতিহাসিকদের লেখা সুলতানি যুগের ইতিহাসে এবং দিল্লির ইতিহাসে তার বহু কর্মের উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও কচ্ছ এবং অসমের যুদ্ধ যাত্রার বিশদ দিনপঞ্জী (ডায়েরি) লিখে গিয়েছেন শিহাবুদ্দিন মহম্মদ তালিশ। তালিশের নাম আবুল ফজলের কৃতির সঙ্গে তুললীয়। এছাড়াও ব্রিটিশ আর ডাচেদের কুঠির নানান তথ্য এবং তারিখ তাঁর যুদ্ধ যাত্রা এবং অর্থনৈতিক কাজকর্মের সঠিক সময় নির্দেশ করে। এই বিপুল তথ্যপঞ্জী অন্য কোন মধ্যযুগের আভিজাতর বীরের জীবনে পাই না।
এই সব অসামান্য তথ্যাবলী মীর জুমলার জীবনী লিখতে ব্যবহৃত হয়েছে। লেখক অধিকাংশ পারসিক পাণ্ডুলিপি থেকে তথ্যাবলী উদ্ধার করছেন আমার গ্রন্থাগার থেকে, সে সব অমূল্য গ্রন্থ ভারতের অন্য কোথাও নেই। সেই সব তথ্য জড়ো করে সেগুলি ভিত্তি করে তিনি যে জীবনীটি লিখেছেন, সেটা পড়ে বলতে পারি বোধহয় তিনি কোন ঘটনা, কোন বিষয়ই ফাঁক ছেড়ে যান নি। ড জগদীশ নারায়ণ সরকার মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে যে ধরণের সুগভীর কাজ করেছেন, সাম্প্রতিক ইতিহাসে সে ধরণের কাজ হয়েছে কিনা সন্দেহ। গেজেটিয়ার বা সার্ভের কোয়ার্টারইঞ্চ মানচিত্র নিয়ে প্রত্যেকটা যায়গার নাম তিনি উদ্ধার করেছেন।
মধ্যযুগের ভারতে মীর জুমলা অন্যতম মহান চরিত্র। সেই মানুষটির বিশ্বস্ত জীবনী বইএর আকারে উপস্থিত হল।
যদুনাথ সরকার
৬ জুন ১৯৫১
No comments:
Post a Comment