জগদীশ নারায়ণ সরকার
খ) গোলকুণ্ডা
১৬৪৫এর আগেই বিজাপুর যত তাড়াতাড়ি পশ্চিম কর্ণাটক দখল করতে পেরেছিল, ঠিক সেই দ্রুততায় গোলকুণ্ডা পূর্ব কর্ণাটকের উচ্চ এলাকা(বালাঘাট) দখল করতে পারে নি। ১৬৪২ সাল পর্যন্ত কুডাপ্পার জেলার উত্তর-পূর্ব দিকের শুধু কাম্বমই দখল করতে পেরেছিল গোলকুণ্ডা। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যেতে বেশ সময় লেগেছিল।
কর্ণাটক দখলের লড়াইতে পেছনে পড়ে থাকতে ইচ্ছুক ছিলেন না সুলতান আবদুল্লা কুতুব শা, তিনি এই কাজে তার সরইকাহিল মীর মহম্মদকে অবস্থা বদলাবার দায়িত্ব দিলেন। মীর মহম্মদ বললেন তিনি সম্পূর্ণ অবস্থার পরিবর্তন করে দেখিয়ে দেবেন। ওয়ারিস জানাচ্ছেন, ‘কুতুবউলমুল্কের একজন নায়েকও এক একর জমি দখল করতে না পারলেও মীর জুমলা বিশাল বিশাল দুর্গ দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন’।
২। মীর জুমলার প্রথম যুদ্ধযাত্রা
বিজয়নগরের অবস্থা এওই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে সুলতানের স্বপ্ন শুধু সাকার হওয়া সময়ের অপেক্ষা ছিল মাত্র। এর রাজা ভেঙ্কটপতি বা তৃতীয় ভেঙ্কট(১৬৩০-৪২) তার প্রথম পাঁচ বছরের রাজত্ব কালে তার রাজ্যের মধ্যেই বিদ্রোহের আঁচ পাচ্ছিলেন। জিঞ্জির নায়কের সঙ্গে তাঁর চুক্তির প্রভাবে অসস্তুষ্ট হয়ে তাঞ্জোর আর মাদুরার নায়েক ১৬৩৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেলেন। এর আগে উপর্যুপরি বীজাপুরী আক্রমনে রয়্যালদের সম্পদ আর আত্মরক্ষার দক্ষতা ভেতর থেকে ক্ষয়ে গিয়েছিল। এর পর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিল নিজের পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তাঁর ভাইপো শ্রী রঙ্গ কাকার সঙ্গ ছেড়ে বীজাপুরের পক্ষে যোগ দেয়। ফলে তৃতীয় ভেঙ্কট মাদ্রাজপত্তম আর পুনামাল্লির (৪০০০০ সেনা বাহিনীর) প্রধান ভেলুগতি তিম্মা, দামরালা ভেঙ্কটার সাহায্য সত্ত্বেও খুব বেশি লড়াই দিতে পারেন নি।
১৫০২/১৬৪২এর এপ্রিলে ৪০০০০ পদাতিক, ৪০০০ ঘোড়সওয়ার আর গোলান্দাজ, আলি রাজা খাঁ(কোন্ডাভিডুর সরইলস্কর, রাজাকীয় বাহিনীর প্রধান), গাজি আলি বেগ(মারাঠা অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান), আলম খাঁ পাঠান, আইনুল মুল্ক, সুজাউলমুল্ক, দাদাজী কান্তিয়া এবং আসির রাও, ভেঙ্কটা রেড্ডি এবং অন্যান্য নাইকোয়ারের মত বেশ কিছু হিন্দু এবং মুসলমান সেনাপতি নিয়ে এগিয়ে চললেন। বাজার দরে খাবার কেনা হল, খবর চালাচালির জন্য রাজসভার সঙ্গে বিভিন্ন একালায়(ডাকচৌকি)পায়রার ডাকের ব্যবস্থা করা হল।
উপকূলের সেনা শিবির কোণ্ডাইভু থেকে থেকে সৈন্য নিয়ে মীর মহম্মদ নেল্লোরের সমতলে কোন বড় প্রতিরোধ ছাড়াই পৌঁছলেন এবং স্থানীয় দুর্গের সেনাদের আক্রমণ রুখে আটটা বড় দুর্গ দখল করতে সক্ষম হলেন। এর পরে আরও দক্ষিণের দিকে আসবেন মনস্থ করলেন। কিন্তু তাঁর জন্য চাই রাজধানী থেকে দক্ষ সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কর্মী। বিশেষ করে যদি সেই অঞ্চলের সুরক্ষিততম দুর্গ ডুম্বুরু(বা দান্দারুলু) দখল করতে হয়। ২০-১-১০৫২/১১ এপ্রিল ১৬৪২ সালে দুর্গের ট্রেঞ্চ খোঁড়া শুরু হল। তারপরে তিনি আরমাগাঁও আর পুলিকটের মধ্যের শ্রীহরিকোটা দ্বীপ এবং ২১ এপ্রিল ১৬৪২ সালে আরও কিছু দুর্গ দখল করলেন রয়্যাল, টিম্মা আর দামারলা ভেঙ্কটের যৌথ বাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে। ভেঙ্গে পড়ে রয়্যাল চিত্তোরের পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন এবং ছ মাসের মধ্যে, ১০ অক্টোবর ১৬৪২ সালে মারা গেলেন। তাঁর উত্তরাধিকারী হিওসেবে শ্রী রঙ্গ সিংহাসনে আরোহন করলেন তৃতীয় শ্রী রঙ্গ রূপে ২৯ অক্টোবর ১৬৪২-১৬৮১।
শ্রীহরিকোটা দখল আসলে মীর জুমলার রণনীতর চাতুর্য প্রমান করে। শ্রীহরিকোটা উত্তরে আরমাগাঁও এবং দক্ষিণে পুলিকটের মধ্যে গোঁজ হয়ে রইল। ফলে খুব তাড়াতাড়ি তিনি আরমাগাঁওএর আশেপাশের এলাকা দখল করতে পারলেন। যদিও একটা বড় অংশ তখনও শ্রীরঙ্গ’র আয়ত্তে ছিল – তিনি বিপুল পরিমান সৈন্যদল ভেঙ্কটগিরি আর আরমাগাঁওতে তেরি রেখেছিলেন। ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের নথির মন্তব্য সূত্রে পাচ্ছি, আরমাগাঁও এলাকার নায়েকদের ‘দেশ থেকে তাড়া খেয়ে বেড়াতে হচ্ছে, একদিকে রয়্যাল অন্য দিকে সুলতানি সেনার চাপে তারা ব্যতিব্যস্ত। মুসলমানেরা চাওলা গেলডানকেতে মূল শিবির তৈরি করেছে’। তাঁদের বিশ্বাস হচ্ছিল যে খুব কম সময়ের মধ্যে এলাকাটি মুসলমান শাসনের আওতায় চলে আসবে। তারা রঙ্গ করে লিখল, ‘একদিকে গোলকুণ্ডার রাজা, অন্যদিকে বিজাপুরের রাজার শাঁড়াশি আক্রমন, অথচ দেশিয়রা(জেন্টুজ) নিজেদের মধ্যে বিভেদের খেলায় মত্ত। ফলে তারা আর তাঁদের দেশের শাসন ধরে রাখতে পারবে না।’
নেল্লোরকে মূল ঘাঁটি করে বর্ষার পরপরই গোলকুণ্ডার সেনা বাহিনী ঝটিতি আক্রমণ করে নাকবাত, রাপুর (১৯.১০.১০৫২/৩১ ডিসেম্বর ১৬৪২) কাল্লুর(২৪.১০.১০৫২/৪.১.১৬৪৩) দুর্গ দখল করে ফেলল। প্রথম দুর্গটির সেনাবাহিনী আক্রমনকারীদের কথা শুনে পালিয়ে গেল। আর দ্বিতীয় দুর্গের লড়াইতে গোলকুণ্ডা ১০-১২ হাজার ঘোড়সয়ারওয়ালা আদিবাদী সাংগ্রেজরাজকে বিশাল জঙ্গলের মাঝে ফেলে হারাল। জঙ্গল পরিষ্কার করে আক্রমণকারীরা সেখানে মীর মহম্মদের নেতৃত্বে দুটো ছোট দূর্গ তৈরি করল। মুসলমান সেনা নেতার অধীনে ছিলেন যেমন দুজন মুসলমান নেতা খাইরাত খাঁ এবং সৈয়দ মহম্মদ মাজানদারানি ছিলেন, তেমনি ছিলেন দুজন রেড্ডি ভাই ভেঙ্কট আর তিম্মা আর রাওয়াজী কান্তিয়া। কুল্লুরের দুর্গ দখলের যুদ্ধ প্রায় একমাস স্থায়ী হয়(২৪-১০-৫২/৪-১-৪৩ শেষ শাওয়াল ১০৫২ জানুয়ারি ১৬৪৩)। রয়্যাল বিশাল সেনা বাহিনী নিয়ে তিরুপতিতে অপেক্ষা করছিলেন(মার্চ এপ্রিল ১৬৪৩)।কিন্তু তাঁর বাহিনীর বিপক্ষের জোরদার যুদ্ধের এবং অস্ত্রশস্ত্রের খবর আর বাহনীর মধ্যেই অসন্তোষ যেমন কালাহস্তির দামারালা ভেঙ্কটা এবং টুপাক্কি কৃষ্ণাপ্পা, কুতুবশাহীদের মনোবল বাড়িয়ে ভেল্লোরে চলে গেলেন। অন্যদিকে মীর মহম্মদ তাঁকে জোরজার না করে উদয়গিরিতে পৌঁছে গেলেন। উদয়গিরি তখন দুই শক্তির মধ্যে নিষ্পেষিত হচ্ছে। এটি ভালিকোণ্ডা পাহাড়ে অবস্থিত এবং এটি প্রায় অগম্য, শুধু একটি ঢোকার রাস্তাওয়ালা দুর্গ। মীর মহম্মদ মাল্লাইয়া নামক হিন্দু সেনাপতিকে প্রচুর সোনা ঘুষ দিয়ে, তাঁর থেকে গুপ্ত প্রবেশ পথ জেনে নেন(জুনের মাঝামাঝি, ১৬৪৩)। একের পর এক দুর্গের পতনের খবরের সঙ্গে প্রায় অজেয় দুর্গ উদয়গিরি পতনের খবর এল সুলতানের কাছে, ১০.৪.১০৫৩/১৮ জুনে ১৬৪৩, তিনি বিজয়ী সরইখাহিলকে মীর জুমলা পদের অভিষিক্ত করেন। তিনি রাজসভায় গিয়ে বিজয় উপহার দেন সুলতানকে এবং বেশ কিছু কাল তিনি সেই সভায় থাকেন।
১৬৪২ আর ১৬৪৩ সালে মীর জুমলার বীরত্বে পুলিকটের উত্তরের উপকূল এলাকার অধিকাংশই দখলে নিয়ে আসতে পারলেন সুলতান কুতুব শাহ। যে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন মীর, তা হতে পারল তাঁর সামরিক বীরত্ব আর কূটনৈতিক চাতুর্যের দ্বারা, এবং বিজয়নগরের রাজপরিবারে দুটি অদক্ষ রাজা তৃতীয় ভেঙ্কট আর তৃতীয় রঙ্গ’র মধ্যে বিভেদ বীজে। ভেঙ্কটের অসুবিধেগুলো আগেই আলোচনা করা হয়েছে, আর শ্রী রঙ্গর সঙ্গে ভেঙ্কটের বিপুল ঝগড়ার জন্র শ্রী রঙ্গের সিংহাসনে আরোহন উনিশ দিন পিছিয়ে যায়। এই অবস্থা ব্যবহার করে গোলকুণ্ডা। নতুন রাজাকে অভিজাতদের অধিকাংশরই পছন্দ হয় নি বিশেষ করে কালাহস্তির ভেলুগতি ভায়েদের(দামারালা ভেঙ্কটাদ্রি বা ভেঙ্কটা এবং আয়াপ্পা)। এরা দুইভাই আগের রাজত্বে মোটামুটি রাজ্য পরিচালনা করত। এই বিক্ষুদ্ধরা জুটল গিয়ে গোলকুণ্ডার দলে। তাঁর ভেঙ্গে পড়া রাজত্বে শ্রী রঙ্গা কখোনো গোপনে কখোনো সরাসরি গিরগিটির মত মত, রঙ, আনুগত্য বদল করা অভিজাতদের মুখোমুখি হলেন। এর পাসাপাশি তাকে দু’দিকে চেপে ধরল বিদেশি সেনাবাহিনী, কখোনো যৌথভাবে কখোনো একা।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment