Thursday, November 24, 2016

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৯ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার
দ্বিতীয় অধ্যায়

কর্ণাটকে মীর জুমলা
প্রথম পর্ব

কর্ণাটক এবং কর্ণাটকে মুসলমান উপস্থিতির ইতিহাস
কর্ণাটক বা কর্ণাট শব্দটা প্রাথমিকভাবে ব্যবহার হয়েছিল সাধারণভাবে তেলুগু আর কানাড়ি জনগণ, তাঁদের ভাষা ইত্যাদি বোঝাতে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শব্দের ব্যবহার সংকুচিত হয়ে শুধু বোঝাতে থাকে কানাড়ি জনগণ আর ভাষাকে। ‘কর্ণাটক দেশ’ বলতে আক্ষরিকভাবে শুধু বোঝায় উত্তরভূমি বা বালাঘাট। মুসলমান শক্তি দক্ষিণভারতে প্রথমে পৌঁছায় ঘাট, মহীশূর, তেলেঙ্গানার অংশ যার নাম কর্ণাটা অঞ্চলে। কিন্তু যখন বিজয়নগর রাজ্য, পূর্বের তামিল আর তেলুগু এলাকার দিকে সরে যেতে বাধ্য হল, সে সময় কর্ণাট শব্দটা পূর্বের সমতল দেশ বা পণঘাট নামে চিহ্নিত হল। পূর্বতন বিজয়নগর রাজ্য, দাক্ষিণাত্যের সুলতানি সাম্রাজ্যের দুই অংশে বিভক্ত হল, উত্তরে তুঙ্গভদ্রাকে সীমারেখা করে বালাঘাট আর পণঘাট নিয়ে বীজাপুরি কর্ণাটক আর হায়দ্রাবাদী কর্ণাটকরূপে। ব্রিটিশেরা কর্ণাট শব্দটা ব্যবহার করল ঘাটের নিচের অংশটা, যার মধ্যে রয়েছে মাদ্রাজ, তামিলনাড়ুর নেল্লোর, এবং কর্ণাটকের নবাবের প্রশাসনিক এলাকাগুলি। ফলে মহীশূর দেশ যদিও আদতে সত্যিকারের কর্ণাটক, যাকে আজ আর কর্ণাটক বলা হয় না, বরং আধুনিক ভূগোলে যে কর্ণাটক দেখানো হয় সেটা হল মাদ্রাজের নিচু জমি বা করমণ্ডল উপকূল, যা ইতিহাস দ্বারা বিন্দুমাত্র সিদ্ধ নয়।

কানাড়ি দেশ অতীত থেকেই তাঁর উর্বর জমি, ধাতু, হাতি এবং ধনসম্পদের জন্য প্রখ্যাত ছিল। কিন্তু মাদ্রাজের সমুদ্র উপকূল আর পূর্ব ঘাটের মধ্যে যে পূর্ব কর্ণাটক বা পণঘাট, সেটি পশ্চিম কর্ণাটিক বা বিজাপুরী কর্ণাটকের থেকে হাজার গুণে জনবলী, সম্পদশালী এবং উর্বর। এর হিরের খণি, উর্বর জমি, পুরোনো হিন্দু সাম্রাজ্যের লুকোনো সম্পদের আকর্ষণে আওরঙ্গজেব কর্ণাটক দখল করতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। শাহজাহানকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘এটি গোলকুণ্ডার মত বড় এবং ধনশালী রাজ্য’। দাক্ষিণাত্যের দুটি বিভাগ মুলুন্দ আর কর্ণাটক ছিল ধনী এবং উর্বর দেশ। মহামেডাননামার লেখক, ঝাউরইবনঝাউরি লিখছেন, এর জলবায়ূ মনোরম, আর বাতাস সুখকর। বর্ষা যথেষ্ট হয়। সপ্তদশ শতে চাষে সে সিরিয়া আর মিশরের থেকেও এগিয়েছিল। তার ‘শস্যাগার যেন আকাশকে চুম্বন করত’। ছোট ছোট কসবাগুলি জনবসতিতে পূর্ণ এবং সাধারণ জনগণ সমৃদ্ধশালী। প্রত্যেকটি পরিবার যেন ইরাণের ফরিদুন এলাকার মত সমৃদ্ধশালী। এমন কোন দিন যায় নি, যে দিন কোন চাষী তাঁর জমির উদ্বৃত্ত, ভিক্ষা দিত না। সোনালী আকাশ ছোঁয়া গাছগুলি গোলাপজাম, ডালিম, এবং আঙ্গুরের মত সুস্বাদু ফলদায়ী – এতই মিষ্ট আম খুব দুর্লভ। এই দেশ তার অধিবাসী তাঁর ভ্রমনকারীকে প্রকৃতি সম্পদ ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছে, ফুলে, পাখির ডাকে সাজানো বাগানে। থেভনট আরও বলছেন, এই অঞ্চলে নানান ধরণের সস্তার কিন্তু গুণমানে সমৃদ্ধ পণ্য, ছাগল, ভেড়া, মোরগ সহজেই পাওয়া যায়। উপকূলের বিকশিত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য শহরগুলির মধ্যে নেগাপত্তনম, ত্রিবাঙ্কুর, মায়াল্পুর এবং সান থোম প্রখ্যাত।

এই ধরণের সম্পদশলী দেশ তার প্রতিবেশী বিজাপুর বা গোলকুণ্ডা বা পরের দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের ঈর্ষা উদ্রেক করবেই। সে ক্রমশ ভিতর থেকে ক্ষয়ে গিয়ে, নিজেকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারল না। ১৬৩৬ সালের মে-জুন মাসের শাহজাহান, আদিল শাহ আর কুতুব শাহের মধ্যে যে চুক্তি হয়, তাতে দুটি দক্ষিণী রাজ্য সেই সুযোগে কৃষ্ণা আর তুঙ্গভদ্রার তীর ছাড়িয়ে মহীশূর এবং মাদ্রাজ-কর্ণাটকের হাজারো পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করা ছোট ছোট রাজ্যগুলি এবং কাবেরী ছাড়িয়ে কৃষ্ণা নদী থেকে তাঞ্জোর পর্যন্ত হতোদ্যম বিজয়নগর সাম্রাজ্য দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করল। বিজাপুরের আদিল শাহ দারুলহাব কর্ণাটক গড়ে তুলতে মুলুন্দ অর্থাৎ বেন্দুর, আর মহীশূরের এবং তাঁর পরে কানাড়ি দেশ অর্থাৎ পূর্ব কর্ণাটকের মাদ্রাজের সমতল থেকে ভেল্লোর, জিঞ্জি এবং তাঞ্জোরের কাছের ভালিকাণ্ডাপুরম পর্যন্ত এলাকা দখল করে। অন্যদিকে গোলকুণ্ডার কুতুব শাহ, দক্ষিণ আর দক্ষিণপূর্বের হিন্দু রাজ্যগুলি অর্থাৎ বিজাপুরী দখলিকৃত এলাকার কৃষ্ণার উত্তরপূর্বের অঞ্চল অধিগ্রহণ করে। জোড়া ফলার মত আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শেষ বাতিটি পূর্বে নেল্লোর থেকে পুদিচ্চেরি পর্যন্ত এলাকা আর পশ্চিমে মহীশূর সীমান্তে একটুরো একলা নিয়ে চন্দ্রগিরি রাজ্য টিকে রইল। নিজেদের রাজ্যে সিংহাসন নিয়ে কামড়াকামড়ি, হতবিধ্বস্ত রাজ্যের ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে মাদুরা, জিঞ্জি এবং তাঞ্জোরের নায়কেরা নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করলেন এবং বহুদিনের শত্রুর মত তামিল আর কর্ণাটকিরা এমন লড়াই শুরু করল যে বহিঃশত্রুর আক্রমনে চন্দ্রগিরি এক মন এক প্রাণ হয়ে দাঁড়াতেই পারল না। রায়াল প্রত্যাঘাত করলেও, হতাশ হয়ে দেখলেন, একের পর এক এলাকা তাঁর কবল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই সব কটি ঐতিহাসিক বিষয়, বিশেষ করে রয়াল আর নায়েকদের মধ্যে সম্পর্ক এমন জটিলভাবে পেকে আর বিষিয়ে উঠল, যে আক্রমণকারীদের কাছে দাক্ষিণাত্য দখল করা শুধু সময়ের অপেক্ষা হয়ে উঠল।
(চলবে)

No comments: