জগদীশ নারায়ণ সরকার
৬। জিঞ্জি
ব্রিটিশদের সঙ্গে মাদ্রাজে সন্ধি করে ১৬৪৭-৪৮এর শীতে মীর জুমলার নেতৃত্বে কুতুব শাহী বাহিনী চলল উত্তর থেকে জিঞ্জির দিকে। সেনাবাহিনী যতই এগিয়ে আসতে থাকে, বিপদের আশংকায় তাঞ্জোরের নায়ক থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মীর জুমলার সঙ্গে সন্ধি করে নিলেন। মীর জুমলার পরিকল্পনা ছিল জিঞ্জিকে উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমন করা। তিনি দক্ষিণ আর্কট জেলার তাঞ্জোরের তাণ্ডিভরম আর আসিউর(আলিউর?) দখল করলেন। মাদুরার তিরুমালার নায়ককে একদা তাঞ্জোরের নায়ক বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তিনি এবারে শোধ নিতে বদ্ধ পরিকর হয়ে আদিল শাহকে তাঁর দূত পাঠিয়ে সমস্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। আদিল শাহ জিঞ্জি দখল করার মনস্থ করেছিলেন, কিন্তু জিঞ্জি গোলকুণ্ডার আশ্রয় চাইল। কুতুব শাহ শাহজাহানকে লিখে জানালেন জিঞ্জি আর তাঞ্জোরের জমিদার তাঁর নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে। আদিল শাহ এই জোটের পূর্বলক্ষ্মণ হয়ত দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝলেন মীর জুমলার কূটনীতিতে এই দুই নায়ক তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ফলে তিনি কুতুব শাহের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠে মুজফফরাউদ্দিন খান মহম্মদ, খানইখানানকে রাজসভায় ডেকে গোলকুণ্ডা রাজ্য লুঠ আর দুর্গকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তাঁর এই আভিযান করতে কিছুটা দেরি করতে হল। শাহজাহানের দূত হামিম মহম্মদ হুসেইন আদিল শাহের রাজসভায় বললেন কুতুব শাহের নির্দেশে মীর জুমলা এই কাজটি করেছেন, এবং তিনি(দূত) দেখবেন যাতে আদিল শাহ যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ পান। তারপর আদিল শাহ শাহজাহানকে অনুরোধ করেন এই এক তৃতীয়াংশ দুই তৃতীয়াংশ আহদনামার ভাগাভাগির বখরার, এবং এই পেশকাশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হোক।
কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৬৪৮এ দেখা গেল এই ভাগাভাগিতে আদিল শাহ খুশি হননি। তিনি কুলবর্গার মুস্তাফা খানকে নির্দেশ দিলেন তুরুমালার নায়ককে নিয়ে জিঞ্জি দখল করার। তাঁর শেষ এবং সব থেকে বড় সৈন্য সজ্জা – ১৭০০০ ঘোড়া, ২০-৩০ হাজার পদাতিক সৈন্য তাঁর সঙ্গে ৩০ হাজার তিরুমালার সৈন্য(সঠিক যুদ্ধাস্ত্র বিহীন অনিয়মিত সেনা দল) যোগ করে মুস্তাফা খান এগিয়ে চললেন। হয়ত ঘটনার এই অগ্রগতি দেখে মীর জুমলা মার্চের ১৬৪৮এর বর্ষায় কাঞ্জিভরমের দিকে এগোলেন। দূরদৃষ্টিতে তিনি বুঝলেন ব্যপ্ত মাদুরা এবং মহিশূরের যৌথ বাহিনী নিয়ে আদিল শাহ ওয়ান্ডিওয়াশের দিকে এগোচ্ছেন। ভেলুগতির মত হিন্দু সেনানায়ক আর তাঁর গোলান্দাজ বাহিনী নিয়ে মীর জুমলা মুস্তাফার আগেই জিঞ্জি পৌঁছবার চেষ্টা করলেন, যাতে জিঞ্জি বীজাপুরের হাতে না পড়ে। বীজাপুরী ঐতিহাসিক জহুরি লিখছেন স্বাভাবিকভাবে মীর জুমলা ‘কিছুটা গণ্ডগোল পাকাতে চাইছিলেন’। জিঞ্জি রাজা এগিয়ে এসে মীর জুমলাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি যে চুক্তি পালন করবেন, এবং বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না, জানালেন। তখন দুটিই সুলতানি বাহিনী মাত্র ১০ মাইল দূরত্বে অবস্থান করছে। রাজা তখন মীর জুমলার বাহিনীর ২ মাইল আগে শিবির ফেলেছেন। মীর জুমলা খুব তাড়াতাড়ি রাজার সঙ্গে যোগ দিলেন। দুটি বাহিনীর মধ্যে এখন তফাত মাত্র আট মাইলের। মুস্তাফা বুঝলেন এই যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমন কার্যকারী হবে না। তিনি আদিল শাহকে খুব তাড়াতাড়ি আরও বাহিনী পাঠাতে অনুরোধ করলেন। আদিল শাহ, ৭-৮০০০ সেনা বাহিনীর নায়ক সেনাপতি ইখলাস খান, রুস্তমইজামান, আফজল খাঁকে মুস্তাফা খাঁয়ের সাহায্যের জন্য পাঠাবেন ঠিক হল। অন্যদিকে কুতুব শাহ মনে করছিলেন আদিল শা রুস্তমকে পাঠিয়েছেন তাঁর হাত থেকে জিঞ্জি আর তাঞ্জোর দখল করার জন্য, তিনি শাহজাহানকে বিজাপুরের এই চুক্তি ভাঙ্গার ঘটনা বিবৃত করে পাঠালেন এবং মীর জুমলাকে কিছু দিন অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিলেন। কেননা তাঁর বিশ্বসা পাদশাহ তাঁর পক্ষেই রায় দেবেন।
দুটি সেনা বাহিনী কোন ঘটনা ছাড়াই পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি বসে রইল। জিঞ্জি কার দখলে থাকবে, এই সিদ্ধান্ত কয়েক দিনের মধ্যেই দুপক্ষের বিরোধে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু বিজাপুর থেকে বাহিনী আসাতে দেরি হওয়ায় এবং আদিল শাহী সেনা বাহিনীতে সেনাপতিদের মধ্যে মতভেদ বাড়তে থাকায় মুস্তাফার ধারণা হল যে আপাতত কিছু দিনের জন্য দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি হোক। মীর জুমলা মুস্তাফার নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ সেনাপতিদের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ করতে শুরু করে দিলেন। তাদের ইচ্ছে কুতুব শাহী বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি বদ্ধ হওয়া।
যত দিন যেতে থাকে জিঞ্জির ভাগ্য কি হবে তা নিয়ে কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিরোধ বাড়তেই থাকল। চুক্তিতে ঠিক হল জিঞ্জি জয়ের পরে মুস্তাফা খান জিঞ্জিতে থাকবে আর মীর জুমলা ফিরে যাবেন গোলকুণ্ডায়। দুজনই প্রকাশ্যে পরস্পরকে সাহায্যের কথা জানাতে থাকলেন। খানইখানান কিছুটা পিছিয়ে রায়চূরে শিবির গাড়লেন। অন্যদিকে মুস্তাফা জিঞ্জির দিকে আগ্রসর হয়ে ত্রিণোমালে চঙ্গম দুর্গ দখল করে রাখলেন। মীর জুমলা জিঞ্জির ৩০ মাইল দূরে তাঁর ভেলোরের আশ্রিত রাজ্য স্বারিগুন্টার শিবিরে ফিরে গেলেন, যেখান থেকে তিনি কুতুব শাহের পক্ষ থেকে প্রশাসন চালাচ্ছিলেন।
৩ জিকাদ ১০৫৮/৯ নভেম্বর ১৬৪৮ সালে মুস্তাফা খান মারা যাওয়ায় সীমান্ত চুক্তিতে ধাক্কা লাগার আশংকা দেখা দিল। প্রতিস্থাপিত সেনাপতিত্বের যায়গায় খান মহম্মদ আসার আগেই জিঞ্জির আবরোধ মালিক রাইহানের নেতৃত্বে হতে শুরু করল। খান মহম্মদ তখন নান্দিয়ালে তাদপার্তি দুর্গ দখলের লড়াই করছিলেন। রাইহান সেনাদের ২৫০০ হুন মাইনে দিয়ে অবরোধ আরও জোরদার করলেন। এই সুযোগ নিয়ে মীর জুমলা একাই জিঞ্জি দখল করার পরিকল্পনা করলেন। তাঁর ধারণা ছিল মুস্তাফা এবং খারিয়িত খান মারা গিয়েছে, তাদের সেনা বাহিনী ছন্নছাড়া হয়ে রয়েছে, সাহজী নিজে মানসিকভাবে দুমড়ে মুচড়ে রয়েছেন, মালিক রাইহান জিঞ্জি দখলের আগেই তিনি জিঞ্জি দখল নেবেন। মীর জুমলার অভিযানের পরিকল্পনার খবর পেয়ে মালিক রাইহান একটা কড়া বার্তা পাঠালেন, ‘আপনি দুর্গের এত কাছে আছেন, তাই আপনার এই কাজ আমাদের স্বার্থের বিরোধী। দুর্গের আধিবাসীরা আপনার সাহায্য চায়। আমার মনে হয় আপনি একটু দূরে গিয়েই অপেক্ষা করুণ। আদিল শাহী সেনার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই। যদি কিছু ঘটে যায় তাহলে তাঁর দায়িত্ব আমি নেব না। মুস্তাফা খান হয়ত মারা গিয়েছেন, কিন্তু আমি এখনও জীবিত রয়েছি। আমি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে যাব।’ মীর জুমলাকে স্তব্ধ হতে হল। তিনি ভেলোরের ৪২ মাইল দূরে আরও উত্তরে কুডাপ্পা জয় করতে গেলেন। খান মহম্মদ সরকারি নির্দেশে তাদপার্তি থেকে অবরোধ জোরদার করতে এলেন।
কিন্তু মীর জুমলা জিঞ্জি দখলের সিদ্ধন্ত থেকে সরলেন না। শুরুর দিকে নায়কেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তিনি ১৬৪৬এর সীমান্ত চুক্তি এবং ১৬৪৮এর মুস্তাফার সঙ্গে চুক্তি সত্ত্বেও তাদের বিজাপুরের বিরুদ্ধে উস্কাতে শুরু করলেন। বিজাপুরের রাজকীয় ঐতিহাসিক ঝাউরিইবনঝাউরি লিখছেন, ‘বিশ্বাসঘাতক, দুর্মতি আবদাল্লা, যাকে রয়াল যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল, যে বিজাপুরের সমর্থন ছাড়া এক ইঞ্চিও কর্ণাটকের জমিও দখল করতে পারত না, সে অবিশ্বাসীর(রয়াল) সঙ্গে গোপন চুক্তি করে তাঁর সেনাপতি মীর জুমলাকে পাঠিয়ে হিন্দুর সহায়তায় হিন্দু রাজাদের খেপিয়ে জিঞ্জির সুরক্ষা করতে গেল।’ অনেক দূর থেকে মীর জুমলা খুব দেরি করে এসে পৌছলেন, ততক্ষণে একদিনেই খানইখানান জিঞ্জি দখল করে নিয়েছেন। তাঁর চুক্তি পালন না করে তিনি গোলকুণ্ডার দিকে পালিয়ে গেলেন।
জিঞ্জির পতনের পরেই বিজাপুরী সেনা হাতে তাঞ্জোর আর মাদুরার নায়কেরও পতন হল এবং তেগনাপত্তনমের মত সমুদ্রের আশেপাশের এলাকাগুলো লুঠ, খুনের অত্যাচার চলল। হিন্দু রাজারা রাজস্ব দিতে প্রতিশ্রুত হলেন। ডাচ নথি অবলম্বন করে ফস্টার লিখছেন, ‘ভারতের পূর্বাংশে... মুসলমান শক্তি কানাড়িদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল। বিজাপুরী সেনা, প্রখ্যাত দুর্গ জিঞ্জিকে কেন্দ্রকরে সমগ্র জেলা দখল করল। তেগনাপত্তনমের প্রশাসক করা হল মলয়াকে’। অখুশি রয়াল মহীশূরের মায়কের আশ্রয়ে থাকতে থাকতে বিজাপুরের সঙ্গে যুদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। জেসুইট ধর্মপ্রচারকেদের বক্তব্য, ‘আদিল শাহী সেনা দুটি ক্ষমতাশালী রাজাকে হারিয়ে, অভূতপূর্ব পরিমানে সম্পদ দখল করে, একটাও যুদ্ধ না করে, একটাও সৈন্য না খুইয়ে বিপুল দেশটি জয় করে বিজাপুরে ফিরে যায়’।
কুতুব শাহ আদিল শাহকে অভিবাদন জানিয়ে চিঠি লেখে, সঙ্গে ৪ লাখ হুণ এবং জিঞ্জি পতনের সময় মুঘলদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য চারটি রত্ন উপহারস্বরূপ পাঠায়। তাঁর প্রস্তাব ছিল কর্ণাট আর মুলুন্দএর জঙ্গলটি কারোর অধিকারে নেই, সেটি কুতিব শাহ নিজের অধিকারে নিতে চান, যাতে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আদিল শাহ এতে রাজি হন, গোন্ডিকোটা দুর্গ এবং গোটা কোক্কানুর কুতুব শাহকে দখলের জন্য দিলেন। যাইহোক, সামগ্রিকভাবে দেখা গেল, চুক্তি ভঙ্গ হতে হতে শেষ পর্যন্ত সীমান্ত চুক্তি সেই সময়ের জন্য পালিত হল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment