জগদীশ নারায়ণ সরকার
অন্যদিকে কুতুব শাহ দিল্লিতে তাঁর দূত মুল্লা আবদুস সামাদকে পাদশাহের রাজসভায় গিয়ে জানাতে বলেন, আদিল শাহের সমস্ত অভিযোগ মিথ্যে, গান্ডিকোটা দখল গোলকুণ্ডার চুক্তি অনুযায়ী হয়েছে, সেটা ক্ষমতা প্রদর্শন নয়। আদিল শাহ মীর জুমলার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অশালীন। তাতে তাঁর সেনাপতির সম্মান হানি হয়েছে। তিনি তাঁর দূতকে আরও অভিযোগ করতে বলেন, কুতুব শাহ, আদিল শাহকে বার বার বলেছিলেন যদি কোন মতবিরোধ হয় তাহলে তিনি যেন তা পাদশাহের কাছে জানিয়ে তাঁর থেকে পরিষ্কার করে ভবিষ্যতের কৃত কর্তব্য জেনে নেন। তিনি আদিল শাহের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য শয়তানি চাল(হরকৎ নাহানজার) চালার অভিযোগ আনেন এবং বলেন যে যে আদিল শাহ গোপনে কর্ণুলের সিদ্দি ঝাউহরকে দিয়ে গাণ্ডিকোটা আর গুটি এবং তাঁর আশেপাশের এলাকায় অভিযান চালাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমন কি এই কাজের বিরুদ্ধে তিনি তার বোন বড়ি সাহেবাকে(আদিল শাহের স্ত্রী)র মধ্যস্থতা চেয়েছিলেন। কুতুব শাহ, তাঁর বিজাপুরী দূত হাজি নাসিরাকে নির্দেশ দেন, তিনি যেন সুলতানকে চাপ দিয়ে ঝাউহরকে নিবৃত্ত করেন এবং এবং যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তাকে হুমকি দেন; যে কোন ভাবে তাকে চাপে রাখতে তাকে বলেন সুলতান। তিনি স্বীকার করেন, আদিল শাহের সঙ্গে তাঁর এই বিরোধ তাদের যৌথ স্বার্থের বিরোধী, এবং তাঁর ফলে হয়ত তাদের শক্তিশালী শত্রুর হাতকেই শক্ত করা হবে, যারা এ ধরণের ঘটনা ঘটার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। মীর জুমলা নিজে খান মহম্মদ ইখলাস খান এবং কুর্ণুলের সুবাদার সিদ্দি আবদুল ওয়াহবকে কে চিঠি লিখে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
কথার যুদ্ধের পর শস্ত্রের যুদ্ধ লেগে গেল দুপক্ষের মধ্যে। এই ঘটনা ১৪ জানুয়ারি ১৬৫২ সালের সেন্ট জর্জের একটা চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, ‘গোলকুণ্ডা আর ভিজাপুরের মুর(মুসলমান)দের মধ্যে যুদ্ধ লেগেছে, দূর থেকে জেন্টু (রয়াল) রাজা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে, যাতে সে তাঁর দুরবস্থা বদলাতে পারে...’
আদিল শাহ খনইখানান, খান মহম্মদকে মীর জুমলার অধিকার করা দুর্গ দখলের জন্য পাঠায়। গাণ্ডিকোটায় যাওয়ার পথে চন্দ্রগতিতে একটা দুর্গ দখল করেন। আক্রমণকারীরা বাইরে থেকে কামান দাগে আর দুর্গের বাসিন্দারাও তাঁর জবাব দেয়। কিন্তু আদিল শাহের পক্ষে এত পরিমান গোলা বর্ষণ করা হয় যে দুর্গের আর কেউ বেঁচে ছিল না। এরপর তারা দুর্গ ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে মীর জুমলার গাণ্ডিকোটায় আক্রমনের জন্য অভিযান শুরু করে। তাদের পরিকল্পনা ছিল দুর্গ আর গোটা গ্রামকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া।
মীর জুমলার সেনাবাহিনীতে ছিল মুঘল, আফগান, পাঠান এবং রাজপুতদের বিশাল ফৌজ। তিনি বহু কষ্টে তাদের সংগ্রহ করেছেন এবং তাদের দক্ষতার জন্য তিনি খুব গর্বিতও ছিলেন। এই বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি খানইখানানের বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। দুর্গের পিছনের দিকে গিয়ে বাহিনীকে তিনি কয়েকটা টুকরো করে ভাগ করলেন নানান কৌশলগত যায়গায় রাখলেন। তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মহম্মদ খান লোদি একটি গাড়িতে তুলে তাঁর পিছিনে বিশাল বাহিনী জড়ো করা হল। যুদ্ধে তাঁর মুখোমুখি হলেন বীজাপুরি সেনাপতি বাজি ঘোরপাড়ে(মুঢৌলএর)। যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই বিজাপুরী অশ্বারোহী বাহিনী বিপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীকে বল্লম নিয়ে দুপাশ থেকে আক্রমন করে, প্রচুর হতাহত হয়।
মুহম্মদ খান লোদি ঘোড়া থেকে পড়ে যান এবং তাঁর মাথা থেঁতলে যায় সেনাবাহিনীর মধ্যে পড়ে গিয়ে, তাঁর মধ্যেই প্রচুর সেনা নিহত হল। গাণ্ডিকোটা থেকে বাজি ঘোড়পাড়ে মীর জুমলাকে বহিষ্কার করল। দুর্গের অধিবাসীরা দূরের জঙ্গল আর পাহাড়ে গিয়ে লুকোল। বিজাপুরী ঐতিহাসিক বিজয় গর্বে লিখছেন, ‘কুতুব শাহের সেনাবাহিনীতে মীর জুমলার মত শক্তিশালী সেনানায়য়ক, সাধারণ একজন উজির বাজি ঘোরপাড়ের হাতে পরাজয় স্বীকার করলেন, এবং মুঠি খোলা ধুলোর মত মিলিয়ে গেলেন।’ এই অপমান জনক হারের পর মীর জুমলা তাঁর উকিলের মার্ফৎ খান মহম্মদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব পাঠালেন এই শর্তে, ১) দু লাখ পঞ্চাশ হাজার হুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, যতক্ষণনা এই অর্থ পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ কিছু ঘোড়সওয়ার বন্দী থাকবে, ২) গোণ্ডিকোটা এবং কোক্কানুর দেশটি মীর জুমলার হাতে অর্পণ করতে হবে।
আদিল শাহ শান্তি চাওয়ায় খান, মীর জুমলার উকিলকে সম্মান জানালেন, এই শর্ত তারা মেনে নিচ্ছেন এই কারণে যে, দুর্গের এবং দুই পক্ষের ক্ষতির অর্থ দুর্গে রক্ষিত অমেয় পরিমাণ সম্পদের বিনাশ সাধন। আদিল শাহ এই চুক্তি মেনে নিলেন। স্বাক্ষর হল ১৬৫২ সালের ১৪ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যের কোন এক সময়ে – শর্ত হল – ১) মীর জুমলা যে গোণ্ডিকোটা আর কোক্কানুর দেশ দখল করে ছিলেন সেটি তাঁর দখলে থাকবে; ২) খান মহম্মদ পেল ৫ লাখ ৫০ হাজার হুণ অর্থ এবং মণিকারের চোখ ছানাবড়া হওয়ার মত বিশালাকার চারটি হীরে, এগুলি সব আদিল শাহের সভায় পাঠানো হল।
হারের পর মীর জুমলা আর বীজাপুরী সেনানায়ক খান মহম্মদ যৌথ বাহিনী নিয়ে কর্ণাটক উচ্চভূমির রাজধানী পেনুকোণ্ডা। যদিও সিদ্দি রাইহান শোলাপুরী(যার অভিভাভক, অম্বর কালা সুলতানের নির্দেশে নিহত হয়) সেরায় স্থানীয় রাজাদের সঙ্গে মিলে বিদ্রোহী হয়েছিলেন – বিশেষ করে মহীশূরের রাজা, যিনি জগদেব দেশ দখল করেন, এবং কর্ণাটক আর মুলুন্দে ইনকিলাব আনেন, এবং তার বাহিনীতে ৪ লক্ষ পদতিক, ৪০০০০ হাতি ছিল। খান মহম্মদ এ সব নিয়ে চিন্তা করতে রাজি ছিলেন না। পেনুকোণ্ডা আক্রমন করেন এবং রাজা শান্তি চুক্তি চান এবং দুর্গ পরিত্যাগ করে কান্দর্পিতে চলে যান, পেণ্ডুকোটার নাম হয় তাখাতইমুবারক।
কিন্তু কর্ণাটকে যুদ্ধ থামার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না। আগের মতই দুর্দমভাবে চলতে লাগল। খান মহম্মদ সভায় ফিরে এসে আক্রমনে বিরতি দিলে শ্রী সঙ্গ রয়াল মহীশূরের রাজার সঙ্গে হাত মিলিয়ে হারানো গড় ফিরে পেতে চাইলেন। তিনি কুতুব শাহী বাহিনীকে ঠেকিয়ে দিলেন। কিন্তু মহীশূরের বাড়বাড়ন্তিকে ছেঁটে দিতে প্রথমে জগদেব দেশ, তারপর কৃষ্ণগিরি দুর্গ দখল করে মহীশূরের দুর্গ অবরোধ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত রাজার চারটি দুর্গ নিজের আয়ত্ত্বে আনলেন। জিঞ্জির দিকে যেতে গিয়ে, গোলকুণ্ডার অধিকৃত এলাকা পার হতে বিজাপুরী সেনানায়ক, মীর জুমলার অনুমতি চাইলেন। বিজাপুরীদের কর্ণাটকের বিভিন্ন অঞ্চলে অগ্রগতিতে শঙ্কিত হলেন মীর জুমলা কেননা তাতে তাঁর আধিপত্যের, ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনায় আঘাত লাগতে পারে। তিনি বিভিন্ন নায়ককে এবং কর্ণাটকের রাজাকেও উসকাতে শুরু করলেন। মহীশুরের নায়ক, বিজাপুরী বিদ্রোহী, সিদ্দি রাইহানের সঙ্গে হাত মেলালেন, সিদ্দি সম্প্রতি মুস্তাফার দখল করা দুর্গগুলি দখল করেছেন। মীর জুমলার আশ্বাসে শ্রী রঙ্গ রয়াল ভেলোরে ফিরে এসে লড়াই দেওয়ার জন্য বড় সেনা তৈরি করার চেষ্টা করতে লাগলেন। বিজাপুরের ঐতিহাসিক লখছেন, ‘আদিল শাহ নির্দেশ দিলেন শ্রী রঙ্গ ঝামেলা শুরু করে দিয়েছে, এবং উকিলের মাধ্যমে মীর জুমলার সঙ্গে কথা বার্তা চলছে। তারা ৫০ লাখ হুন আর ৪৫ টা হাতি মুঘলদের দিতে রাজি। এই বাবদে মীর জুমলা দায়িত্ব নিয়েছে। সে মুঘলদের প্ররোচিত করছে রাজাকে সাহায্যের জন্য এগোতে।’
মীর জুমলার কূটনীতি বিজাপুরের রণনীতিতে পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য করল। খান মহম্মদ তাঁর সব বিজিত ভূমি দুর্গ ইত্যাদি পিছনে ফেলে মহিশূরের নায়কের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এগিয়ে গেল। বিজাপুরের সুলতান, খান মহম্মদকে নির্দেশ দিলেন প্রথমে রয়াল রাজ্যকে আক্রমন করার, যাতে সে মীর জুমলার সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারে। ১৬৫৪ সালের ৭ নভে বিজাপুরী সেনা ভেলোর দখল করে। রয়াল খান মহম্মদের সঙ্গে রাজস্ব বাঁটোয়ারা এবং চন্দ্রাগিরি হাত বদল করার চুক্তি করে। রয়াল উত্তর তাঞ্জোরের আকল নায়েকের জঙ্গলে পালিয়ে যান। রাজত্ব ছাড়া রাজা গভীর জঙ্গলে চরম দারিদ্রে দিন কাটাতে থাকলেন। শেষে একদা তাঁর অধীনস্থ মহীশূরের রাজার আশ্রয়ে থাকলেন।
চন্দ্রগিরি আর মহীশূরের দুই রাজা গোলকুণ্ডা বাহিনী যে সব এলাকা দখল করেছিল সেগুলি তারা দখল করতে চাইল। কিন্তু মাদুরার নায়ক তাদের সাহায্য না করে খান মহম্মদকে মহীশূর বাহিনীকে তাড়াবার এবং পাহাড়ি রাস্তা খুলে দেওয়ার জন্য আবেদন করলেন। আতুর থেকে মাদুরা পর্যন্ত তিনি লুঠ করলেন। মহীশূরের রাজা বালাজী হইবত রাওকে পাঠালেন খান মহম্মদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। তিনি সিদ্দি মাদুদকে পাঠিয়ে ফিরে গেলেন। সিদ্দি, বালাজীর মাথা কেটে নেন। রাজা ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মাদুরার রাজা তাঁর শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য খান মহম্মদকে নগদ অর্থ, ৫০টা হাতি, বিপুল রাজস্বর প্রতিশ্রুতি দিলেন। শ্রী রঙ্গ তাঁর শেষ বন্ধুও হারালেন।
১৬৫৩ সালে দাক্ষিণাত্যের শেষ হিন্দু রাজ্যগুলি নিজের দুর্বলতা, ব্যক্তিগত অসূয়ার জন্য মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে যায়। তবে মহীশূর আর মাদুরা কিছু দিন লড়াই করে। বিজয়নগর রাজ্য মুছে ফেলার একটা বড় কাজ করেছেন আর্দিস্তানি মীর জুমলা, তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা প্রয়োগ করে।
(চলবে)
দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ
No comments:
Post a Comment