বাংলার গ্রাম উদ্যমীদের জন্য বিশ্ববঙ্গ মন্ত্রকের দাবি
মূল বিতর্কে ঢোকার আগে দেখে নেওয়া যাক গ্রাম উতপাদকেদের বাংলা বাজার কতটুকু। বাংলায় অন্তত ৫০ লক্ষ ছোট উদ্যমী, ৭ লক্ষর বেশি তাঁতি এবং অন্তত ৩ লক্ষ পরম্পরার অভিকর শিল্পী রয়েছেন – মোট ৬০ লক্ষ। এবারে বোঝা যাক – যদি প্রত্যেককে মাসে দুহাজার টাকা রোজগার করতে হয়, তাহলে নিশ্চই বছরে ন্যুনতম ১ লাখ টাকার উতপাদন এবং ব্যবসা করতে হবে। তাহলে ৬০ লক্ষ গুণ ১ লক্ষ – অর্থাৎ ন্যুনতম ৬০ হাজার কোটির ব্যবসা দেয়।
বাংলার ক্ষেত্রফল এবং জনসংখ্যা ভারতের গড় জনসংখ্যার কাছাকাছি – এই অঙ্কের সঙ্গে যদি আমরা রাজ্যগুলির গুণিতক করে ফেলি তাহলে যে অঙ্কটা দাঁড়াবে তা চোখ কপালে তোলার মতই। তাও তো কৃষি এই উদ্যমের বাইরে রাখা গিয়েছে। ফলে কর্পোরেট ব্যবসার উচ্চতার ফানুষ চুপসে যায়। তাই এই বিশাল বিপুল অর্থনীতির জোরে ২০০৮এর ইওরোপ আমেরিকার বিষকে নীলকণ্ঠের মত ধারণ করে গ্রাম ভারত, কপ্ররপোরেট ভারতকে উদ্ধার করে আর সেই বেল আউটের জেরে কর্পোরেট অর্থিনীতির ফাণ্ডামেন্টাল কত জোরদার সেই ফানুসে বাতাস ভরে বড় পুঁজি পোষিত ফেউয়েরা।
ফিরি আমাদের বিতর্কে – জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দক্ষতা, নিজের বাজার, নিজস্ব প্রযুক্তি, নিজের কাঁচামাল, আর নিজের এলাকায় শ্রম বাজারের ব্যবস্থাপনা নিজের হাতে রাখার গ্রাম উদ্যমের জন্য কেন এমএসএমই মন্ত্রকের বাইরে আমরা একটা আস্ত মন্ত্রকএর দাবি জানাচ্ছি সেই যুক্তি-প্রতিযুক্তিতে। আমাদের প্রতীতি প্রমান করতে আমরা একটা পথ নিয়েছি – দুটি বিষয়ের তুলনা।
বিতর্কে ঢোকার আগে বলে নেওয়া দরকার এমএসএমই উদ্যোগীরা আমাদের ভাই। সেই উদ্যোগীদের সঙ্গে পরম্পরার গ্রামীন উদ্যোগের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু দুটি উদ্যম আলাদা। তাদের মধ্যে শুধু উৎপাদন করা ছাড়া কোন কিছুতেই যে মিল নেই তা আমরা পরে দেখিয়েছি।
এসএমএসই ক্ষেত্রের সমস্যা
ক। ন্যুনতম বিনিয়োগের শর্ত - সেবা ক্ষেত্রে ১০ লক্ষ টাকা, উতপাদনে ২৫ লক্ষ টাকা
খ। বিনিয়োগ খোঁজার সমস্যা - সাধারণত উদ্যোগীর নিজের বিনিয়োগে সাধারণত ব্যবসা শুরু করতে পারে না। ফলে প্রধানতম বিচার্য সেই ব্যবসা ব্যঙ্ক ঋণের উপয়োগী (ব্যাঙ্কেবল) কি না – সে বিনিয়োগ কোথায় পাবে এবং তা প্রক্রিয়া করে উৎপাদন তৈরি করবে। আদতে বড় পুঁজির ওপর নির্ভরশীল ছোট উদ্যমের বাঁচা মরা কিন্তু বড় পুঁজির আবহেই নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণত ব্যাঙ্ক যেহেতু বড় পুঁজিরই উদ্যম, সেহেতু বড় পুঁজির অনুসারী আদতে বড় পুঁজির ইচ্ছে অনিচ্ছের(কেউ কেউ বলেন অর্থনৈতিক আর ব্যবস্থাপনার তত্ত্ব – আদতে তা ইচ্ছেই – যাকে ব্যবস্থাপক আর অর্থনীতিবিদেরা তত্ত্বে রূপান্তরিত করেছেন) ওপরে নির্ভরশীল। আদতে তার অস্তিত্বের ওপর বড় পুঁজির অদৃশ্য হাত সবসময় ক্রিয়া করে। সে বিন্দুমাত্র নির্ভরশীল নয়।
গ। মূলত কাঁচামালের জন্য উদ্যমীকে নির্ভর করতে হয় বড় পুঁজির উতপাদনের বা ক্রিয়ার ওপর। কাঁচামালও সাধারণত তাকে জোগাড় করতে হত কিছু দিন পূর্বে রাষ্ট্রের দয়ায়(যারা আদতে পুঁজি নিয়ন্ত্রিত) আজ বড় পুঁজির দয়ায়।
ঘ। প্রযুক্তি - প্রযুক্তি তার নিজস্ব নয়। তাকে সেটা কিনতে হয়। তার পিছনে প্রচুর সময় অর্থ পরিশ্রম ব্যয় হয়। আর নতুন প্রযুক্তি এলে তাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার বিনিয়োগ, শ্রমশক্তি তার জন্য ব্যয় করার পরিকল্পনা করতে হয়।
ঙ। দক্ষতা – সাধারণত সেটাও উদ্যমীর থাকে না। তাকে হয় সেটা গাঁটের কড়ি ফেলে অর্জন করতে হয়, না হয় ভাড়া নিতে হয় কর্মীরূপে
চ। গত দুদশকে কলকাতার আশেপাশের বড় পুঁজির শিল্পের আবনতির সঙ্গে অনুসারী শিল্পের হ্রাসের মধ্যে একটা তাত্ত্বিক সাজুজ্য রয়েছে – হাতে গোণা ব্যতিক্রম ছাড়া, এমএসএমই উদ্যম বড় পুঁজি শিল্পের অনুসারী। ফলে এলাকায় বড় পুঁজির বাড়া হ্রাসের সঙ্গে তাঁর ভাগ্য জড়িয়ে রয়েছে।
ছ। আর যদি যে স্বাধীন উতপাদক হয় – তাহলে তার উৎপন্নের বাজার খুঁজতে হয় নিজেকেই, লড়াই করতে হয় বাজারে থাকা বড় প্রতিযোগীর সঙ্গে, বাজারের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে থাকে না।
জ। তাকে যন্ত্র চালাতে সরাসরি নির্ভর করতে হয় বিদ্যুতের ওপর। তাঁর দাম, তা পাওয়া, তাঁর গুণমান সব নির্ভর করে বড় পুঁজির ইচ্ছের ওপর।
কিন্তু এর তুলনায় বাংলার পরম্পরার গ্রামীণ ছোট উদ্যোগীদের নিজস্ব জোরের জায়গাটি দেখি -
১। বিনিয়োগ বিন্দুমাত্রই বড় সমস্যা নয় – সে তার জীবনে ১০ লক্ষ টাকা হয়ত রোজগারই করে না - অথচ সে তার নিজের কারখানার মালিক – সেটা তৈরি করতে সে ব্যাঙ্ক বা সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকে না। ফলে তাঁর উদ্যম পুঁজি নির্ভর নয় – ব্যাঙ্কের দরজা সে হয়ত তাঁর জীবনে একবারও মাড়ায় না, ফলে চাইলেও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা মার্ফত বড় পুঁজি তাকে দখল করতে পারে না। সে স্বাধীন। সে নিজের সমাজের সঙ্গে যুক্ত। তাকে রাষ্ট্র পুঁজি কেউই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে না।
২। কাঁচামাল সমস্যা নয়। শাঁখ, ধাতু আর তাঁতের সুতো(আমরা সাঙ্গঠনিকভাবে চেষ্টা করছি বাংলায় তাঁতপ্রধান গ্রামে সুতো চাষের – তাহলে এই জিনিসটিরও ওপরে তাঁতিদের নিয়ন্ত্রণ এসে যাবে। তাকে আর মিলের খারাপ সুতোর ওপরে নির্ভর করতে হবে না)। ছাড়া কাঁচামাল সাধারণত উদ্যোগী তার গ্রামের আশেপাশ থেকেই সংগ্রহ করে।
৩। তাকে দক্ষতা সংগ্রহের জন্য আলাদা করে পাঠ নিতে হয় না। পরম্পরার ছোট উদ্যোগীদের মূল কাঠামো হল তার বংশপরম্পরায় বয়ে যাওয়া সামাজিক দক্ষতা, যে দক্ষতা সে চারিয়ে দিয়ে যায় তার উত্তরপ্রজন্মের কাছে বা তার সমাজে।
৪। তার জোর বংশপরম্পরার সামাজিক বাপ-দাদার জ্ঞান। তার জ্ঞান সে হয় তার পরিবারের লোককে বা তার কর্মচারীকে দিয়ে যায় – ফলে সমাজে নিত্যনুতন দক্ষতা আর জ্ঞানে নতুন নতুন উদ্যোগী তৈরি হয়।
৫। প্রযুক্তির জন্যও তাকে কাউকে পয়সা দিতে হয় না, যন্ত্র সারাই করতে তাকে এমন কিছুই খরচ করতে হয় না বা যন্ত্র খারাপ হলে দক্ষ যন্ত্রবিদের জন্য তাকে হাপিত্যেস করে বসে থাকতে হয় না – সে সারাইয়ের দক্ষতা তার নিজের না হয় গ্রামেই না হয় আশেপাশেই থাকে – নতুন প্রযুক্তি এলে পুরোনোকে ফেলে দিয়ে, তা সংগ্রহ করতে দৌড়োদৌড়ি করতে হয় না। নতুন প্রযুক্তি জোগাড় এবং কেনার জন্য বিনিয়োগ আর তা চালাবার জন্য শ্রমিক খুঁজতে হয় না। তার জোর বংশ পরম্পরার নিজস্ব সামাজিক প্রযুক্তি – এখনও জং না পড়া লোহা তৈরি করেন ডোকরা কামার – বড় রোলিংমিল নয়; আজও ভাল সুতো, শাড়ি, জামাকাপড় তৈরি হয় তাঁতে – কাপড় মিলে নয়; আজও সূক্ষ্ম শাঁখে কাজ হয় হাতে, যন্ত্রে নয়।
৬। আর বাজার সাধারণত তার নিজের, হাতের কাছের হাট, বাজার বা গঞ্জ, না হলে কাছের শহর।
৭। ছোট উতপাদকেদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার নিজস্ব উতপাদনের ইতিহাস, নিজস্ব প্রযুক্তির গর্ব, আর ঐতিহ্য যা বাংলার জ্ঞানচর্চা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে – একদা বাঙ্গালার বিশ্বপরিচিতির সঙ্গে জড়িয়ে।
৮। আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা এই উদ্যমে গ্রামের বা স্থানীয় শ্রমশক্তির নিয়োজন হয়। গ্রামের শ্রমিক আরও বেশি কাজ পায়। তাদের কাজ খুঁজতে গ্রামের বাইরে আর যেতে হয় না। আর বিনিয়োগের হারের তুলনায় গ্রামীন ছোট উদ্যোগে অনেক বেশি মানুষ নিয়োজিত হন, তাতে বেকার সমস্যার সমাধান হয়।
৯। আর যেহেতু তার উদ্যম বিদ্যুৎ নির্ভর নয়, রাসায়নিক নির্ভর নয় মূলত প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে তাকে উৎপাদন করতে হয় তাই তাকে বড় পুঁজির উতপাদনের সঙ্গে লড়াই করতে হয় না, তার উৎপাদন অনেক বেশি দামে শহুরে বাজারে বিকোয় – তার রোজগার, রাজ্যের রোজগার আর গ্রামের স্বনির্ভরতা বাড়ে। গান্ধীজীর গ্রামস্বরাজের স্বপ্ন সাকার হয়।
১০। এরা কেউ রাজ্যসরকার বা কেন্দ্র সরকারের ভর্তুকি বা বিনিয়োগ পেতে উতসাহী নয়। ফলে এই উদ্যোগী তৈরি করতে সরকারের বিন্দুমাত্র অর্থ ব্যয় হয় না; বরং সরকারের সঙ্গে গ্রামে বসে উৎপাদন করা উদ্যোগী গ্রামন্নয়নের কাযে অংশিদার হয়। তাকে আর উতপাদনের জন্য শহরে আসতে হয় না।
১১। আর জ্ঞান প্রযুক্তির প্রজ্ঞা নিজের পরিবারে বা সমাজে থাকে তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে যায়। তাই দেশকে জ্ঞান আর প্রযুক্তি কেনার জন্য গাঁটের কড়ি বিনিয়োগ করে বড় পুঁজিকে উৎসাহিত করতে হয় না।
ফলে তাকে আলাদা করে যদি গ্রামীণ ছোট উতপাদকেদের উতসাহিত করা যায়, তাহলে যেমন গ্রামের টাকা গ্রামে থাকে, রাজ্যের টাকা রাজ্যে থাকে, তেমনি দক্ষ শ্রমিক রাজ্য ছেড়ে বিদেশে রোজগারের জন্য পাড়ি দেয় না।
ফলে এই মানুষদের উদ্যম কোনভাবেই এমএসএমই দপ্তরের অধীন হতে পারে না। যে দপ্তর ন্যুনতম দশ লাখ টাকা বিনিয়োগ করাকে তাঁর আধীনে থাকার উদ্যমীর চরিত্রভাবে, সেই এমএসএমই দপ্তরের অধীন গ্রাম পরম্পরার জ্ঞান, দক্ষতা, নিজের বাজার আর প্রযুক্তি নির্ভর উদ্যমীরা হতে পারে না। গ্রাম উদ্যমীরা স্বাধীন, তাঁরা পুঁজি নির্ভর নয়। তারাই ভারত – তাঁর ইন্ডিয়া নয়। তারাই গ্রাম ভারতের প্রতিনিধি। বাংলা, ভারতের গর্বের প্রতিনিধি। তাঁরা হস্ত শিল্পী নয়, তাঁরা গ্রাম উদ্যমী।
মূল বিতর্কে ঢোকার আগে দেখে নেওয়া যাক গ্রাম উতপাদকেদের বাংলা বাজার কতটুকু। বাংলায় অন্তত ৫০ লক্ষ ছোট উদ্যমী, ৭ লক্ষর বেশি তাঁতি এবং অন্তত ৩ লক্ষ পরম্পরার অভিকর শিল্পী রয়েছেন – মোট ৬০ লক্ষ। এবারে বোঝা যাক – যদি প্রত্যেককে মাসে দুহাজার টাকা রোজগার করতে হয়, তাহলে নিশ্চই বছরে ন্যুনতম ১ লাখ টাকার উতপাদন এবং ব্যবসা করতে হবে। তাহলে ৬০ লক্ষ গুণ ১ লক্ষ – অর্থাৎ ন্যুনতম ৬০ হাজার কোটির ব্যবসা দেয়।
বাংলার ক্ষেত্রফল এবং জনসংখ্যা ভারতের গড় জনসংখ্যার কাছাকাছি – এই অঙ্কের সঙ্গে যদি আমরা রাজ্যগুলির গুণিতক করে ফেলি তাহলে যে অঙ্কটা দাঁড়াবে তা চোখ কপালে তোলার মতই। তাও তো কৃষি এই উদ্যমের বাইরে রাখা গিয়েছে। ফলে কর্পোরেট ব্যবসার উচ্চতার ফানুষ চুপসে যায়। তাই এই বিশাল বিপুল অর্থনীতির জোরে ২০০৮এর ইওরোপ আমেরিকার বিষকে নীলকণ্ঠের মত ধারণ করে গ্রাম ভারত, কপ্ররপোরেট ভারতকে উদ্ধার করে আর সেই বেল আউটের জেরে কর্পোরেট অর্থিনীতির ফাণ্ডামেন্টাল কত জোরদার সেই ফানুসে বাতাস ভরে বড় পুঁজি পোষিত ফেউয়েরা।
ফিরি আমাদের বিতর্কে – জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দক্ষতা, নিজের বাজার, নিজস্ব প্রযুক্তি, নিজের কাঁচামাল, আর নিজের এলাকায় শ্রম বাজারের ব্যবস্থাপনা নিজের হাতে রাখার গ্রাম উদ্যমের জন্য কেন এমএসএমই মন্ত্রকের বাইরে আমরা একটা আস্ত মন্ত্রকএর দাবি জানাচ্ছি সেই যুক্তি-প্রতিযুক্তিতে। আমাদের প্রতীতি প্রমান করতে আমরা একটা পথ নিয়েছি – দুটি বিষয়ের তুলনা।
বিতর্কে ঢোকার আগে বলে নেওয়া দরকার এমএসএমই উদ্যোগীরা আমাদের ভাই। সেই উদ্যোগীদের সঙ্গে পরম্পরার গ্রামীন উদ্যোগের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু দুটি উদ্যম আলাদা। তাদের মধ্যে শুধু উৎপাদন করা ছাড়া কোন কিছুতেই যে মিল নেই তা আমরা পরে দেখিয়েছি।
এসএমএসই ক্ষেত্রের সমস্যা
ক। ন্যুনতম বিনিয়োগের শর্ত - সেবা ক্ষেত্রে ১০ লক্ষ টাকা, উতপাদনে ২৫ লক্ষ টাকা
খ। বিনিয়োগ খোঁজার সমস্যা - সাধারণত উদ্যোগীর নিজের বিনিয়োগে সাধারণত ব্যবসা শুরু করতে পারে না। ফলে প্রধানতম বিচার্য সেই ব্যবসা ব্যঙ্ক ঋণের উপয়োগী (ব্যাঙ্কেবল) কি না – সে বিনিয়োগ কোথায় পাবে এবং তা প্রক্রিয়া করে উৎপাদন তৈরি করবে। আদতে বড় পুঁজির ওপর নির্ভরশীল ছোট উদ্যমের বাঁচা মরা কিন্তু বড় পুঁজির আবহেই নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণত ব্যাঙ্ক যেহেতু বড় পুঁজিরই উদ্যম, সেহেতু বড় পুঁজির অনুসারী আদতে বড় পুঁজির ইচ্ছে অনিচ্ছের(কেউ কেউ বলেন অর্থনৈতিক আর ব্যবস্থাপনার তত্ত্ব – আদতে তা ইচ্ছেই – যাকে ব্যবস্থাপক আর অর্থনীতিবিদেরা তত্ত্বে রূপান্তরিত করেছেন) ওপরে নির্ভরশীল। আদতে তার অস্তিত্বের ওপর বড় পুঁজির অদৃশ্য হাত সবসময় ক্রিয়া করে। সে বিন্দুমাত্র নির্ভরশীল নয়।
গ। মূলত কাঁচামালের জন্য উদ্যমীকে নির্ভর করতে হয় বড় পুঁজির উতপাদনের বা ক্রিয়ার ওপর। কাঁচামালও সাধারণত তাকে জোগাড় করতে হত কিছু দিন পূর্বে রাষ্ট্রের দয়ায়(যারা আদতে পুঁজি নিয়ন্ত্রিত) আজ বড় পুঁজির দয়ায়।
ঘ। প্রযুক্তি - প্রযুক্তি তার নিজস্ব নয়। তাকে সেটা কিনতে হয়। তার পিছনে প্রচুর সময় অর্থ পরিশ্রম ব্যয় হয়। আর নতুন প্রযুক্তি এলে তাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার বিনিয়োগ, শ্রমশক্তি তার জন্য ব্যয় করার পরিকল্পনা করতে হয়।
ঙ। দক্ষতা – সাধারণত সেটাও উদ্যমীর থাকে না। তাকে হয় সেটা গাঁটের কড়ি ফেলে অর্জন করতে হয়, না হয় ভাড়া নিতে হয় কর্মীরূপে
চ। গত দুদশকে কলকাতার আশেপাশের বড় পুঁজির শিল্পের আবনতির সঙ্গে অনুসারী শিল্পের হ্রাসের মধ্যে একটা তাত্ত্বিক সাজুজ্য রয়েছে – হাতে গোণা ব্যতিক্রম ছাড়া, এমএসএমই উদ্যম বড় পুঁজি শিল্পের অনুসারী। ফলে এলাকায় বড় পুঁজির বাড়া হ্রাসের সঙ্গে তাঁর ভাগ্য জড়িয়ে রয়েছে।
ছ। আর যদি যে স্বাধীন উতপাদক হয় – তাহলে তার উৎপন্নের বাজার খুঁজতে হয় নিজেকেই, লড়াই করতে হয় বাজারে থাকা বড় প্রতিযোগীর সঙ্গে, বাজারের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে থাকে না।
জ। তাকে যন্ত্র চালাতে সরাসরি নির্ভর করতে হয় বিদ্যুতের ওপর। তাঁর দাম, তা পাওয়া, তাঁর গুণমান সব নির্ভর করে বড় পুঁজির ইচ্ছের ওপর।
কিন্তু এর তুলনায় বাংলার পরম্পরার গ্রামীণ ছোট উদ্যোগীদের নিজস্ব জোরের জায়গাটি দেখি -
১। বিনিয়োগ বিন্দুমাত্রই বড় সমস্যা নয় – সে তার জীবনে ১০ লক্ষ টাকা হয়ত রোজগারই করে না - অথচ সে তার নিজের কারখানার মালিক – সেটা তৈরি করতে সে ব্যাঙ্ক বা সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকে না। ফলে তাঁর উদ্যম পুঁজি নির্ভর নয় – ব্যাঙ্কের দরজা সে হয়ত তাঁর জীবনে একবারও মাড়ায় না, ফলে চাইলেও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা মার্ফত বড় পুঁজি তাকে দখল করতে পারে না। সে স্বাধীন। সে নিজের সমাজের সঙ্গে যুক্ত। তাকে রাষ্ট্র পুঁজি কেউই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে না।
২। কাঁচামাল সমস্যা নয়। শাঁখ, ধাতু আর তাঁতের সুতো(আমরা সাঙ্গঠনিকভাবে চেষ্টা করছি বাংলায় তাঁতপ্রধান গ্রামে সুতো চাষের – তাহলে এই জিনিসটিরও ওপরে তাঁতিদের নিয়ন্ত্রণ এসে যাবে। তাকে আর মিলের খারাপ সুতোর ওপরে নির্ভর করতে হবে না)। ছাড়া কাঁচামাল সাধারণত উদ্যোগী তার গ্রামের আশেপাশ থেকেই সংগ্রহ করে।
৩। তাকে দক্ষতা সংগ্রহের জন্য আলাদা করে পাঠ নিতে হয় না। পরম্পরার ছোট উদ্যোগীদের মূল কাঠামো হল তার বংশপরম্পরায় বয়ে যাওয়া সামাজিক দক্ষতা, যে দক্ষতা সে চারিয়ে দিয়ে যায় তার উত্তরপ্রজন্মের কাছে বা তার সমাজে।
৪। তার জোর বংশপরম্পরার সামাজিক বাপ-দাদার জ্ঞান। তার জ্ঞান সে হয় তার পরিবারের লোককে বা তার কর্মচারীকে দিয়ে যায় – ফলে সমাজে নিত্যনুতন দক্ষতা আর জ্ঞানে নতুন নতুন উদ্যোগী তৈরি হয়।
৫। প্রযুক্তির জন্যও তাকে কাউকে পয়সা দিতে হয় না, যন্ত্র সারাই করতে তাকে এমন কিছুই খরচ করতে হয় না বা যন্ত্র খারাপ হলে দক্ষ যন্ত্রবিদের জন্য তাকে হাপিত্যেস করে বসে থাকতে হয় না – সে সারাইয়ের দক্ষতা তার নিজের না হয় গ্রামেই না হয় আশেপাশেই থাকে – নতুন প্রযুক্তি এলে পুরোনোকে ফেলে দিয়ে, তা সংগ্রহ করতে দৌড়োদৌড়ি করতে হয় না। নতুন প্রযুক্তি জোগাড় এবং কেনার জন্য বিনিয়োগ আর তা চালাবার জন্য শ্রমিক খুঁজতে হয় না। তার জোর বংশ পরম্পরার নিজস্ব সামাজিক প্রযুক্তি – এখনও জং না পড়া লোহা তৈরি করেন ডোকরা কামার – বড় রোলিংমিল নয়; আজও ভাল সুতো, শাড়ি, জামাকাপড় তৈরি হয় তাঁতে – কাপড় মিলে নয়; আজও সূক্ষ্ম শাঁখে কাজ হয় হাতে, যন্ত্রে নয়।
৬। আর বাজার সাধারণত তার নিজের, হাতের কাছের হাট, বাজার বা গঞ্জ, না হলে কাছের শহর।
৭। ছোট উতপাদকেদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার নিজস্ব উতপাদনের ইতিহাস, নিজস্ব প্রযুক্তির গর্ব, আর ঐতিহ্য যা বাংলার জ্ঞানচর্চা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে – একদা বাঙ্গালার বিশ্বপরিচিতির সঙ্গে জড়িয়ে।
৮। আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা এই উদ্যমে গ্রামের বা স্থানীয় শ্রমশক্তির নিয়োজন হয়। গ্রামের শ্রমিক আরও বেশি কাজ পায়। তাদের কাজ খুঁজতে গ্রামের বাইরে আর যেতে হয় না। আর বিনিয়োগের হারের তুলনায় গ্রামীন ছোট উদ্যোগে অনেক বেশি মানুষ নিয়োজিত হন, তাতে বেকার সমস্যার সমাধান হয়।
৯। আর যেহেতু তার উদ্যম বিদ্যুৎ নির্ভর নয়, রাসায়নিক নির্ভর নয় মূলত প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে তাকে উৎপাদন করতে হয় তাই তাকে বড় পুঁজির উতপাদনের সঙ্গে লড়াই করতে হয় না, তার উৎপাদন অনেক বেশি দামে শহুরে বাজারে বিকোয় – তার রোজগার, রাজ্যের রোজগার আর গ্রামের স্বনির্ভরতা বাড়ে। গান্ধীজীর গ্রামস্বরাজের স্বপ্ন সাকার হয়।
১০। এরা কেউ রাজ্যসরকার বা কেন্দ্র সরকারের ভর্তুকি বা বিনিয়োগ পেতে উতসাহী নয়। ফলে এই উদ্যোগী তৈরি করতে সরকারের বিন্দুমাত্র অর্থ ব্যয় হয় না; বরং সরকারের সঙ্গে গ্রামে বসে উৎপাদন করা উদ্যোগী গ্রামন্নয়নের কাযে অংশিদার হয়। তাকে আর উতপাদনের জন্য শহরে আসতে হয় না।
১১। আর জ্ঞান প্রযুক্তির প্রজ্ঞা নিজের পরিবারে বা সমাজে থাকে তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে যায়। তাই দেশকে জ্ঞান আর প্রযুক্তি কেনার জন্য গাঁটের কড়ি বিনিয়োগ করে বড় পুঁজিকে উৎসাহিত করতে হয় না।
ফলে তাকে আলাদা করে যদি গ্রামীণ ছোট উতপাদকেদের উতসাহিত করা যায়, তাহলে যেমন গ্রামের টাকা গ্রামে থাকে, রাজ্যের টাকা রাজ্যে থাকে, তেমনি দক্ষ শ্রমিক রাজ্য ছেড়ে বিদেশে রোজগারের জন্য পাড়ি দেয় না।
ফলে এই মানুষদের উদ্যম কোনভাবেই এমএসএমই দপ্তরের অধীন হতে পারে না। যে দপ্তর ন্যুনতম দশ লাখ টাকা বিনিয়োগ করাকে তাঁর আধীনে থাকার উদ্যমীর চরিত্রভাবে, সেই এমএসএমই দপ্তরের অধীন গ্রাম পরম্পরার জ্ঞান, দক্ষতা, নিজের বাজার আর প্রযুক্তি নির্ভর উদ্যমীরা হতে পারে না। গ্রাম উদ্যমীরা স্বাধীন, তাঁরা পুঁজি নির্ভর নয়। তারাই ভারত – তাঁর ইন্ডিয়া নয়। তারাই গ্রাম ভারতের প্রতিনিধি। বাংলা, ভারতের গর্বের প্রতিনিধি। তাঁরা হস্ত শিল্পী নয়, তাঁরা গ্রাম উদ্যমী।
No comments:
Post a Comment