এই প্রথম লোকফোক মসলিন তৈরির পদ্ধতির একটি অংশ উদ্ধার করল রাজেন্দ্রলাল মিত্রের লেখা থেকে. সেই লেখাটি দুটি অংশে প্রকাশ হবে, প্রথমটি মসলিন তৈরি বিষয়ক, অন্যটি মসলিনের বিভাগ বিষয়ক।
১৮৫৮ সালে নানান শিল্পদ্রব্যের প্রস্তুতি বর্ণনা করতে রাজেন্দ্রলাল মিত্র শিল্পীক দর্শন নামক এক পুস্তক প্রকাশ করেন. এই বইতে নানান ধরণের শিল্পবস্তুর প্রস্তুতি পদ্ধতির বর্ণনা রয়েছে। এর অনেকগুলোই ভারতীয় প্রযুক্তি নয়। তার সঙ্গে কিছু ঐতিহাসিক তথ্যও লেখক জুড়ে দিয়েছেন। অধিকাংশ কিন্তু পাশ্চাত্য শিল্প পদ্ধতিতে তৈরির বর্ণনা। শুধু কয়েকটি দেশি বস্তু(প্রযুক্তি) রয়েছে, সেগুলির মধ্যে ঢাকাই বস্ত্র নামে এক প্রবন্ধে মসলিন তৈরির পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। এর আগে বহু লেখায় মসলিন কাপড়গুলোর নানান বর্ণনা পাওয়া গেলেও এই কাপড় তৈরির বর্ননা এই প্রথম পাওয়া গেল। সেই জন্য এই লেখাটির মূল্য অসীম।
১৮৫৮ সালে নানান শিল্পদ্রব্যের প্রস্তুতি বর্ণনা করতে রাজেন্দ্রলাল মিত্র শিল্পীক দর্শন নামক এক পুস্তক প্রকাশ করেন. এই বইতে নানান ধরণের শিল্পবস্তুর প্রস্তুতি পদ্ধতির বর্ণনা রয়েছে। এর অনেকগুলোই ভারতীয় প্রযুক্তি নয়। তার সঙ্গে কিছু ঐতিহাসিক তথ্যও লেখক জুড়ে দিয়েছেন। অধিকাংশ কিন্তু পাশ্চাত্য শিল্প পদ্ধতিতে তৈরির বর্ণনা। শুধু কয়েকটি দেশি বস্তু(প্রযুক্তি) রয়েছে, সেগুলির মধ্যে ঢাকাই বস্ত্র নামে এক প্রবন্ধে মসলিন তৈরির পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। এর আগে বহু লেখায় মসলিন কাপড়গুলোর নানান বর্ণনা পাওয়া গেলেও এই কাপড় তৈরির বর্ননা এই প্রথম পাওয়া গেল। সেই জন্য এই লেখাটির মূল্য অসীম।
লোকফোকের পক্ষে বিশ্বেন্দু
ঢাকাই বস্ত্র
ঢাকাই বস্ত্র সকলেরই প্রিয়, সকলেই ঐ
মনোহর পরিচ্ছেদের প্রশংসায় ব্যগ্রচিত্ত হন, অতএব ক্ষণৈক তদ্বিষয়ের আলোচনায় বোধ হয়,
কেহই বিরক্ত হইবেন না। অপিচ হিন্দুদিগের শিল্পকর্ম্মে নৈপুণ্য-বিষয়ে এই অনুপম
বস্ত্র এক মহতী ধ্বজ। পৃথিবীর – সকল পারদক্ষ তন্ত্রবায়ের ইহার তুল্য বস্ত্র বপনে
বহুকালাবধি যত্নশীল আছে, কিন্তু অম্মদেশীয় ঐ জয়পতাকার গর্ব্ব খর্ব্ব করিতে অদ্যপি
কেহই সক্ষম হয় নাই। ঢাকাই বস্ত্র যত্পরোনাস্তি সামান্য যন্ত্রে প্রস্তুত
হয়, কিন্তু সেই সামান্য যন্ত্র ও তদ্ব্যবহারকর্ত্তৃদিগের কি আশ্চর্য্য ক্ষমতা, যে
বিলাতের অদ্বিতীয় শিল্পকুশল ব্যক্তিরা বহুমূল্য বাষ্পীয়যন্ত্র সহকারেও তাহার সদৃশ
সূক্ষ্মপরিচ্ছদ প্রস্তুত করণে পরাস্ত হইয়াছে। দুই সহস্র
বত্সর পূর্ব্বে এই অনুপম বস্ত্র প্রাচীন রোমরাজ্যে প্রসিদ্ধ হইয়া হিন্দুদিগের
শিল্প-সাফল্যের অনির্ব্বচনীয় প্রমাণ স্বরূপে গণ্য ছিল।
...ঢাকাই বস্ত্র বয়নের প্রথম ক্রিয়া
সুতা প্রস্তুত করণ। এই কর্ম্ম তদীয় পল্লীগ্রামের স্ত্রীলোকদ্বারা সম্পন্ন
হয়। এই স্ত্রীলোকদিগকে সামান্যলোকে কাটনী বা সূতাকাটনী বলিয়া থাকে। এই কাটনীদিগের
ত্বগিন্দ্রীয় তীক্ষ্ন, এবং তদ্বারা ইহারা সূত্রের সূক্ষ্মতা-তারতম্য যে প্রকার
উত্তমরূপে অনুভব করতে পারে, পৃথিবী মধ্যে এমত আর কুত্রাপি কোন জাতীয়েরা পারে না। অল্পবয়স্কা
স্ত্রীরা সর্ব্বোত্কৃষ্ট সূত্র প্রস্তুত করিয়া থাকে, বয়ঃক্রম ত্রিংশত্ বত্সর অতীত
হইলে, তাহাদিগের নয়ন ও ত্বগিন্দ্রিয়তত্কর্মে অপটু হয়, সুতরাম তাহারা আর তত উত্তম
সূত্র প্রস্তুত করণে সক্ষম থাকে না। পূর্ব্বহ্নে বেলা ১০ ঘটিকা পর্য্যন্ত
ও উপরাহ্নে ৪ ঘটিকার পর সূত্র কাটিবার সময়। এতদ্ব্যতীত অন্য সময়ে রৌদ্র প্রখর
থাকিলে, উত্তম সূত্র প্রস্তুত হয় না। নলনল খাস নামক সর্বোত্কৃষ্ট বস্ত্র
বুনিবার সূত্র অতি প্রত্যুষে কাটিতে হয়, এবং যদ্যপি কাটনীর চতুর্বর্ত্তিত স্থানে
শিশির না থাকে, তবে এক পাত্রে কিঞ্চিত জল রাখিয়া তদুপরি সূত্র কাটিবার প্রযোজন হয়,
নচেত্ সূত্র ছিন্ন ভিন্ন হইয়া যায়।
...ইহার ১৭৫ হস্ত সূত্রের পরিমান এক রতি মাত্র। ফলতঃ ইহার এক
সের পরিমাণে সূত্র বিস্তার করিলে প্রায়ঃ ৪০০ জ্যোতিষীয় ক্রোশ স্থানে ব্যপ্ত হয়!!!
এই অদ্ভুত সূত্র যাদৃশ সূক্ষ্ম, ইহা প্রস্তুত করণের শ্রমও তত্পরিমাণে বহুল। দুই মাস কাল
নিয়মিত পরিশ্রম করিলে এক তোলক পরিমাণ সূত্র প্রস্তুত হয়, সুতরাং উহার মূল্যও
অত্যন্ত অধিক। এক সের সর্বেবোত্কৃষ্ট সূত্র ৬৪০ টাকার ন্যুনে প্রাপ্ত
হওয়া যায় না।
সূত্র প্রস্তুত হইলে ফেটী অথবা লুটীর
আকারে রাখিতে হয়। পরে তন্ত্রবায়েরা ঐ ফেটী বা লুটী জলে ভিজাইয়া বংশ
নির্ম্মিত এক চরকিতে বেষ্টন করিয়া ঐ সূত্রকে দুই অংশে পৃথক করে। যাহা উত্তম
তাহা টানার নিমিত্তে ব্যবহার হয়, এবং অবশিষ্টাংশ পড়েনের উপযোগ্য। সূত্র এই
প্রকারে পৃথক২ হইলে টানার সূত্র তিন দিবস নির্ম্মল জলে ভিজাইয়া রাখিতে হয়। চতুর্থ দিবসে উহাহইতে জল নিষ্পীড়ন করত ঐ সূত্র
এক চরকিতে বেষ্টন করিয়া রৌদ্রে শুষ্ক করিতে হয়। অনন্তর তাহা
অঙ্গার-চূর্ণ-মিশ্রিত জলে পুনরায় ভিজাইতে হয়। দুই দিবস
এইরূপে থাকিলে পর ঐ সূত্রকে পরিষ্কার জলে
ধৌত করিয়া ছায়ায় শুষ্ক করা যায়। অতঃপর ঐ সূত্র পুনরায় এক রাত্রি কাল পরিষ্কার
জলে ভিজান থাকিলে মাড় দিবার উপযুক্ত হয়। ঢাকা প্রদেশে খৈয়ের মণ্ড ব্যবহার
আছে, এবং উহা সূত্রোপরি লিপ্ত করিবার পূর্ব্বে তাহার সহিত কিঞ্চিত ধুনা মিশ্রিত
করিয়া থাকে। এই প্রকার টানার সূত্র প্রস্তুত হইলে তাহাকে উত্তম,
মধ্যম ও অধম এই তিন শ্রেণীতে বিভাগ করিয়া উত্তম সূত্র বস্ত্রের দক্ষিণপার্শ্বে,
মধ্যমসূত্র বাম পার্শ্বে ও অধম সূত্র মধ্যমভাগে, ব্যবহার করিয়া থাকে।
সর্ব্বোত্কৃষ্ট বস্ত্র-বপন কালেও এই নিয়মের অন্যথা করে না। পড়েন
প্রস্তুত করণে পূর্ব্ববত্ পরিশ্রম নাই। তাহাকে এক-রাত্রি-কাল জলে ভিজাইয়া
তত্পর দিবস প্রাতে মণ্ডে লিপ্ত করিতে হয়, পরন্তু টানার সূত্র এককালে প্রস্তুত হয়,
পড়েনের সূত্র প্রত্যহ প্রস্তুত করিতে হয়, এককালে এক থানের ব্যবহারোপযোগি সূত্র
প্রস্তুত করিলে তাহা নষ্ট হইয়া যায়।
পূর্ব্ব প্রকারের সূত্র প্রস্তুত হইলে
যথা নিয়মে বপন কর্ম্ম আরম্ভ হয়, কিন্তু স্থানসঙ্কীর্ণতা প্রযুক্ত তাহার বিস্তার
বিবরণে অধুনা নিরস্ত থাকিতে হইল। মলমলখাস নামক বস্ত্র বপনের উত্তম সময়
আষাঢ়, শ্রাবণ এবং ভাদ্র মাস। এতদ্ভিন্ন অন্য সময়ে তত্কর্ম্ম করিতে
হইলে তাঁইতের নীচে কিঞ্চিত জল রাখিয়া কেবল প্রাতঃকালেপরিশ্রম করত তাহা সম্পন্ন
করিতে হয়।
ঢাকা প্রদেশে যে সকল স্থানে বস্ত্র
প্রস্তুত হয় তন্মধ্যে মলমলখাস, সরকার আলি, ঝুনা, রঙ্গ, আব-রওয়াঁ, খাসা, শবনম,
আলাবলী, তাঞ্জেব, তরন্দম, সরবন্দ, সরবতি কমিয, ডোরিয়া, চারখানা এবং জামদানী, এই
কএক প্রকার বস্ত্র সর্ব্বপ্রসিদ্ধ।
No comments:
Post a Comment