১৭৬৭ থেকে ১৭৭০ পর্যন্ত প্রায় সেনা নামিয়ে নাটোর থেকে গড় বার্ষিক ২৭ লক্ষ
আদায় হয়েছিল। ৭০-৭২এ
সাড়ে একুশ লক্ষের বেশি আদায় হল না। নাজিম রেজা খাঁ আর মহারাজ সিতাব রায় রায়তদের ওপর চাপ কমাবার জন্য
কোম্পানির কাছে আবেদন করলেন। খাজনাতো কমলই না, বরং আগামী বছরের খাজনা বেড়ে গেল। ১১৭২এ খুনি দেবী
সিংহের ইজারা শুরু হয় কয়েক বছর আগে। দেবী সিংহের দারোগারা রায়তদের খাজনা আদায়ের জন্য অসম্ভব অত্যাচার করত। তার অত্যাচারে
জমিদারদেরও রক্ষা ছিলনা। অন্তত
আটজন জমিদারের জমিদারি খাজনা অনাদাযের অজুহাতে জলের দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। টেপা, মন্থনা
আর বামনডাঙার জমিদার মহিলা ছিলেন। জমিদারেরা বাড়ি থেকে পালিয়ে রাণী ভবানীর অশ্রয়ে আশ্রয় নেন।
সারা ছিয়াত্তর সন ধরে এই দুর্ভিক্ষের প্রকোপ চলেছিল। একবছর ধরে
চললেও আদতে এর ভয়াবহতা আর ব্যাপকতা অন্যসব দুর্ভক্ষের ব্যপকতাকে ছাড়িয়ে যায়। দুভিক্ষের সময়
ব্যাপক মহামারী দেখা দেয়।
রাজধানী মুর্শিদাবাদে মারাত্মক গুটিবসন্ত। অগ্নিকাণ্ডে বহু মানুষ পুড়ে মারা যান। দিনাজপুর,
পুর্ণিয়ায় শষ্যগোলাও পুড়ে খাক হয়ে যায়। আগুণ লাগলে আগুণ নেভাবার জল পাওয়া যেত না।
কাজের অভাবে আর আয়ের অন্যপথ খোলা না থাকায়, সাধারণ মানুষের খাওয়ার চরিত্র
বদলেগেল। চালের
বদলে ঘাস আর ফসলের বদলে শেকড় খেত। জেমস স্টুয়ার্ট মিল আর ওয়ারেন হেস্টিংসেরমতে সে সময় বাঙলার এক তৃতীয়াংশ
জনগণ, প্রায় এক কোটি মানুষ মারা যান। এই দুর্ভিক্ষে বাঙলার চিরাচরিত কৃষক সমাজের শিরদাঁড়া বরাবরের জন্য ভেঙে
যায়। উইলিয়ম
হান্টার বলছেন বাঙলা বিহারের প্রতি ষোলজনের ছজন প্রাণ হারান। কোম্পানির
আর্থিক নীতি আমলাদের দুর্ণীতিপরায়ণতাই এই মন্বন্তরের জন্য দায়ি- মুর্শিদাবাদের
ফ্রান্সিস সাইকস আর রিচার্ড বিচারের সঙ্গে ক্লাইভের প্রতিষ্ঠিত সোসাইটি ফর
ট্রেড বাঙলার দুর্ভিক্ষের জন্য দায় এড়াতে পারে না। রেজা খাঁ
দুর্ভক্ষের বছরে মুর্শিদাবাদের শষ্যবোঝাই নৌকো আটক করে কম দামে সেই শষ্য কিনে
অসম্ভব বেশি দামে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা লাভ করেন। মুর্শিদাবাদ
ছাড়া আন্তঃজেলা শস্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল।
কোম্পানি সরকার দুর্ভিক্ষের শুরুতে চাল মজুদ করা
শুরু করে দেয়। চার্লস গ্রান্টের হিসেবে, সরকার সেনাবাহিনীর জন্য
৬০ হাজারমণ চাল মজুদ করে। কলকাতায় খাদ্যশস্য সরবরাহ করতে গিয়ে গ্রামীণ
বাঙলা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। রাজমহল আর ভাগলপুর সব খাদ্যশস্য মুঙ্গেরের সেনা
নিবাসের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। এছাড়াও দুর্ভক্ষের বছরে রাজস্ব আরও কড়াকড়ি করে
আদায় হয়। সুপারভাইজারেরা আর গোমস্তারা নিজ আর কোম্পানি
লাভের জন্য বলপ্রয়োগ করতে শুরু করেন। দুর্ভিক্ষের সময় বাঙলার জনগণ একতৃতীয়াংশ হয়ে
পড়ায় সাধারণ রাজস্ব আদায় কম হওয়ার বদলে বেশি আদায়ি হয়। সরকার এই দুর্ভক্ষ
রোধে বাঙলা বিহারের তিন কোটি মানুষের জন্য নব্বই হাজার টাকা ব্যয় করে। রেজা খান
মুর্শিদাবাদে এক তহবিল তৈরি করেন, কোম্পানি ৪০ হাজার, মুবারক উদদৌল্লা ২৬,৮৯৩ আর
রেজা খাঁ দেন ১৯,৬০৭ টাকা। এ তহবিল অপ্রতুল হওয়ায়, আরও ৬৫,১৯৩ টাকা
দুর্ভক্ষের জন্য ব্যয় হয়। রেজা খাঁ সাতটি লঙ্গর খোলেন। রাজধানীতে রোজ সাত
হাজার লোক লঙ্গরে প্রসাদ পেত। তবুও দুর্ভিক্ষেতে অর্তের পরিত্রাতা হিসাবে যে দুজনকে
গ্রামীণ বাঙলা আজও মনে রেখেছে তারা দুজন কেনো রাজপুরুষ নন, একজন মহিলা জমিদার রাণী
ভবানী আর অন্যজন অকৃতদার দাতা হাজি মহসিন।
No comments:
Post a Comment