মন্বন্তর আর তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া
মন্বন্তরের পর সবার আগে যারা ব্রিটিশ সরকারের কাছে রিলিফ
চাইতে এলেন, সরকার তাঁদের বলল খাওয়ার দেব, কিন্তু তোমাদের বাপু রেলপথের শ্রমিক
হিসেবে কাজ করতে হবে। অর্থাত
পেটচুক্তি কাজ। সদাশয়
ব্রিটিশ সরকারের হিসেবে মন্বন্তরের রিলিফও দেওয়া হল, আবার একই সঙ্গে তাদের বিনা
ব্যয়ে রেল লাইন পাতাসহ নানান কাজে এক্কেবারে বিনা শ্রমের মূল্যে কাজ করিয়ে নেওয়া
হল।
গণতান্ত্রিক ইংরেজ মন্বন্তরের রিলিফের সঙ্গে জুড়ে দিলেন রেলরাস্তা তৈরি করার কাজ। সরাসরি উদ্দেশ্য
ব্রিটেনে খাদ্যদ্রব্য আর শিল্পের জন্য নানান কাঁচামাল আর পণ্য দ্রব্য তৈরি করে
নিয়ে যাওয়া। পরোক্ষ
উদ্দেশ্য ভারতের রায়তদের কাছ থেকে আরও অর্থ উসুল।
৫ শতাংশ
নিরাপদ, সুনিশ্চিত বিনিয়োগের শর্তে যে বিনিয়োগ এল তার বড় অংশ চলে গেল সরাসরি
ব্রিটেনে শিল্পদ্রব্য তৈরি হতে, আর কিছু খুদকুঁড়ো মিলল সাম্রাজ্যের ভারতীয়
বন্ধুদের। সব
থেকে বড় কথা, মন্বন্তরের শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে ফেলা মানুষের দরকার খাদ্য আর সেই
খাদ্য তারা পেলেন হয়ত, কিন্তু মহার্ঘ শ্রমের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে। অনেকেই
ব্রিটিশ-আমেরিকিয় ইহুদি লেখকদের, প্রচারমাধ্যমের প্রচারে জার্মানির নাজি
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা জানেন, সে কথা বলতে চোখের জল বেরিয়ে আসে। ভারতেই
ব্রিটিশেরা মন্বন্তর উত্তর সময়ে রিলিফ দেওয়া শর্তে রিফিউজিদের নিয়ে রেল পথ পাতার
নাম করে যে শুধু খেতে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দেশ জোড়া যে ক্যাম্প চালিয়েছেন তার
ব্যাপ্তি কোনওভাবেই নাজি ক্যাম্পের তুলনায় ঊন-ন্যুন নয়। অথচ সে কথা
ভারতে আদৌ আলোচনা হয়!
শুধু খাওয়ার
পাওয়ার লোভ দেখানোর বিনিময়ে রেলরাস্তা তৈরি করতে গিয়ে কত মানুষ না খেতে পেয়ে খুন
হয়েছেন তার কোনও লেখাজেখা নেই। মন্বন্তরের পর
শুধু খাওয়ার লোভ দেখিয়ে আরও কয়েক কোটি মানুষ মেরেছে ব্রিটিশরা – মন্বন্তর পেরিয়ে আসা প্রায় ভেঙেপড়া শরীর, তার ওপর রেলপথ পাতা সংক্রান্ত
নানান ধরণের কাজ।
ভেঙেপড়া শরীরে অমানুষিক খাটুনি খাটতে গিয়ে এই মানুষেরা যে মারা যাবেন সে তথ্য
কিন্তু ব্রিটিশ প্রশাসন জানত। জেনেও গাধার খাটনি খাটানোর পর যা হওয়ার তা হয়েছে – শুধু খাওয়ার লোভে শ্রম দিতে গিয়ে বহু মানুষকে মেরে ফেলেছে ব্রিটিশ
প্রশাসন, শুধু এ দেশ থেকে ব্রিটেনে ৪০ বছরের খাদ্য সম্ভার তৈরি করতে আর রেলপথের
বিনিয়োগের অর্থ উদ্ধার করতে। একে খুন যদে না বলা যায় তাহলে খুনের সংজ্ঞা নতুন করে লিখতে বসতে হয়। মানুষ খুন করা
সরকারি রিলিফের এই সোনার পাথর বাটিটিকে ব্রিটিশরা নাম ছিলেন রিলিফ সিস্টেম। ভাবা যায়।
ঐতিহাসিক পল
গ্লুমাজ B.M. Bhatiaর 1967র লেখা Famines in Indiaর সূত্রধরে বলছেন, The British solution to this problem was
"famine relief." To build the railroads, the British set up
"famine relief works." A famine would create the condition, such
that, faced with certain death from lack of food, an Indian would be forced to
"choose" to go to a famine relief center, much like a starving famine
victim in Africa would do today. However, once having done this, the individual
lost his caste relations and privileges. Then he was told that if he wanted to
continue to eat, he must work, building the railroad in exchange for food. At
these projects, less than minimum subsistence was the norm, much like a Nazi
forced-labor concentration camp. As yesterday's famine victims dropped dead from
exhaustion and slow starvation on the railroad or irrigation project, today's
famine refugees were making their way into this so-called famine relief system.
This system would today be labeled euphemistically, the "recycling"
of the work force. With the advent of railways, it became easier for
traders to buy up food and other goods when they were cheap, and in some cases,
even when costly, and export them to England—much in the same manner as the
British let the Irish starve during the potato famine, rather than allow the
wheat, barley, and rye grown in Ireland for England to be used to feed the
Irish. Under
these conditions, the nature of famines and scarcities began to change.
Whereas in the past, famine had been a regional phenomenon, under this British
policy food became scarce throughout the country, hitting the poorest in a
devastating manne. It was these famine-stricken poor who then
continued to supply the labor for the relief-works.
অপমানজনক ঘৃণাভরা ভারতে শর্তে পুঁজি নিয়ে এসে, ব্রিটিশ শিল্পবিকাশের
উদ্দেশ্যে রেলরাস্তা তৈরির আর এক উদ্দেশ্য ছিল, ভারতে ব্রিটিশ উনিবেশের জন্য নতুন
ধরণের এক মহাজন শ্রেণীর বিকাশ। ফলে যে সব এলাকায় ভাল চাষ হয়েছে, সেই সব এলাকার শষ্যভান্ডার মহাজনদের
মাধ্যমে দখল করল ব্রিটিশ। এ সব
ভাল ফলন এলাকার চাষের পরের কম দামের প্রথম উত্পাদিত শষ্য অনেক আগেই মহাজনদের হাত
ঘুরে ব্রিটিশ বণিকদের কবলে চলে যেত। এরপর ঔপনিবেশিক অর্থনীতির সূত্র ধরে এইসব এলাকায় সেই সব শষ্যের দাম বাড়ত
আকাশছোঁয়া হয়ে। এই বাড়তি
দামের শষ্য ব্রিটিশ বণিকেরা হয় আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করত, নয়ত সেই এলাকার
মানুষের কাছে সেই বাড়া দামেই বিক্রি করে অত্যাধিক মুনাফা করত। প্রাথমিকভাবে
কৃষকদের কাছ থেকে এই শষ্য ধারেই কিনত মহাজনেরা, অথচ কৃষক যখন বাজার থেকে কিনছে,
তখন তাকে কিনতে হচ্ছে নগদ অর্থে। একে ভাটিয়া বলছেন একধরণের ধারের দাসত্ব।
রেলরাস্তা ধরে যে মন্বন্তর ঘটেছে তার ব্যাপকতা বোঝাযাবে ভারতের রেলপথের
বিস্তারে। ১৮৫৭তে
ভারতে ২৮৮মাইল রেল রাস্তা ছিল। ১৮৬১তে সিটি হল ১,৫৯৯ মাইন। ১৮৬৫তে আরও বেড়ে দাঁড়াল ৩৩৭৩মাইন। ১৮৮১তে ৯৮৯১ মাইল, ১৮৯৫তে ১৯,৫৫ মাইল আর ১৯১৪তে ৩৫,৬৫৬ মাইল। এই বিস্তৃত
রেলরাস্তা জুড়ে শষ্য রপ্তানির পরিমান দাঁড়াল ১৮৬৭-৬৮তে ১২,৬৯৭,৯৮৩ হাজার ওজন
থেকে ১৮৭৭-৭৮এ ১৮,৪২৮,৬২৫ হাজার-ওজন। আদতে ভারতেক জনগণের প্রতি উপনিবেশের শাসকদের খুনের মানসিকতা প্রকাশ পায় এই
তথ্যে যে, ১৮৭৬-৭৮ ভারতে প্রচুর মন্বন্তর ঘটে। এবং তথ্যে
পরিস্কার, সেই বছরে ধান রপ্তানি হয়েছে ৩০.৩ মিলিয়ন হাজার ওজনে আর ১৮৯১-৯২তে গম একই
পরিমান রপ্তানি হয়েছে।
গণতান্ত্রিক ব্রিটিশ সরকার মন্বন্তরের সময়, বাড়তে থাকা এই রপ্তানিকে অবাধ
বাণিজ্যের দোহাই দিয়ে সমর্থন করছেন, এবং তাদের বাণিজ্য নীতি পরিবর্তন করার বিপক্ষে
রায় দিচ্ছেন সরাসরি। গ্লুমাজ অভিযোগ করছেন, "civil commotion and unrest in Bombay
against continuing exports of food grains from the presidency at a time when
the people faced the threat of famine. The government of India, however, refused
to change its food policy and steadfastly clung to the view so far held that,
'even in the worst conceivable emergency, so long as trade is free to follow
its normal course, we should do far more harm than good by attempting to
interfere....' "
ঔপনিবেশিক এই তত্বের সরাসরি প্রতিধ্বনী আমরা আজও শুনতে পাই দেশে দেশে
ছাউনিতে সেনা বাহিনী রেখে দেশগুলির সার্বভৌম কব্জা করা আমেরিকা সরকারের। সেদিনের
গণতান্ত্রিক ব্রিটিশেরমত, আজকের সবথেকে বড় গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা, অবাধ
বাণিজ্যের দোহাই দিয়ে দেশগুলির আন্তর্জাতিক শষ্য চলাচল অথবা শষ্য বাণিজ্য নীতিকে
উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রায়নির্দেশিকা জারি করে, বিশ্বব্যাঙ্ক আর আন্তর্জাতিক অর্থ
ভান্ডারের ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে। ক্রমশঃ ইওরো-ব্রিটিশ-আমেরিকা ব্যবসায়ী কার্টেলের হাতে আজকের আন্তর্জাতিক
শষ্য বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ায়, সমগ্র বিশ্ব একসময়কার ব্রিটিশ মদতপুষ্ট
একেরপরএক ভারতীয় মন্বন্তরের অবস্থায় পড়তে চলেছে।
এ প্রসঙ্গে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা না বললে
বোধহয় ব্রিটিশ গণহত্যার শিকার বাঙলা-বিহারের মৃত মানুষের পাহাড়ের ওপর গড়েওঠা
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিভূমিটুকু স্পষ্ট হবে না। বিয়াল্লিশ নিয়ে
প্রচুর বাক্য, প্রচুর কাগজ ব্যয় হয়েছে, কিন্তু ছিয়াত্তর নিয়ে ঐতিহাসিক-বুদ্ধিজীবিদের
স্পষ্ট কোনও ধারণাই নেই অথবা এ সম্বন্ধে
মাথাব্যথাও নেই। শুধুমাত্র অনন্দমঠের ভাসা ভাসা বর্ণনা বাদ দিলে
ভয়ঙ্কর, শিরদাঁড়ায় ঠান্ডাস্রোত বইয়ে দেওয়া এই মন্বন্তর অথবা খুন যাই বলা যাক,
ছিয়াত্তর নিয়ে বাঙলায় খুব ভাল কাজ হয়নি বলা চলে। সেই প্রথম বাঙলার
মন্বন্তর ঘটিয়ে শুধু বাঙলা নয়, এর পর প্রায় একশ বছর ধরে সমগ্র ভারত মহাদেশেই লুঠের
সঙ্গে সঙ্গে প্রায় আড়াইশ মহামারী নামক গণহত্যায় হাত পাকাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। মানুষের মৃত্যু তখন
শুধু কয়েকটি বিবৃত সংখ্যামাত্র।
No comments:
Post a Comment