প্রাচীন বাংলার গৌরব পুস্তক থেকে. হরপ্রসাদ এই পুস্তকে বাঙলার দশটি গৌরবের বিষয় আলোচনা করেন. সেই প্রবন্ধগুলো থেকে রেশমটির অংশ লোকফোক উদ্ধার করেছে. পরে আরও কয়েকটি গর্ব বিষয়ক লেখা প্রকাশ করবে লোকফোক.
বিশ্বেন্দু
...ইওরোপীয়েরা চীনদেশ হইতে রেশমের পোকা আনিয়াছিলেন এবং
অনেক শত বত্সর চেষ্টা করিয়া তাঁহারা রেশমের কারবার খুলিতে পারিয়াছেন। ..ইওরোপে
খ্রীস্টের প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে স্থলপথে চীনের সহিত রেশমের ব্যবসা চলিত। অনেকে মনে
করেন, এই রেশমের ব্যবসার জন্যই পাঞ্জাবের শক রাজারা বেশী করিয়া সোনার টাকা চালান। ইওরোপে রেশমের
চাষ ইহার অনেক পরে আরম্ভ হইয়াছে।
কিন্তু আমরা চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে দেখিতে পাই, বাংলা
দেশে খ্রীস্টের তিন চারি শত বত্সর পূর্বে রেশমের চাষ খুব হইত। রেশমের খুব
ভাল কাপড়ের নাম পত্রোর্ণ অর্থাত পাতার পশম। পোকাতে পাতা খাইয়া যে পশম বাহির করে
সেই পশমের নাম পত্রোর্ণ। সেই পত্রোর্ণ তিন জায়গায় হইত – মগধে, পৌণ্ড্রদেশে ও সুবর্ণকুড্যে। নাগবৃক্ষ,
লিকুচ বকুল আর বটগাছে এই পোকা জন্মিত। নাগবৃক্ষের পোকা হইতে হলদে রঙের রেশম
হইত, লিকুচের পোকা হইতে যে রেশম বাহির হইত তাহার রঙ গমের মত, বকুলের রেশমের রঙ
সাদা, বট ও আর আর গাছের রেশমের রঙ ননীর মত। এই সকলের মধ্যে সবর্ণকুড্যের
পত্রোর্ণ সকলের চেয়ে ভাল। ইহা হইতেই কৌষেয় বস্ত্র ও চীনভূমিজাত চীনের পট্টবস্ত্রেরও
ব্যখ্যা হইল।
উপরে যে টুকু লেখা হইল, তাহা প্রায়ই অর্থশাস্ত্রের
তর্জমা। অর্থশাস্ত্রে যে অধ্যায়ে কোন কোন ভাল জিনিস রাজকোষে
রাখিয়া দিতে হইবে তাহার তালিকা আছে, সেই অধ্যায়ের শেষ অংশে ঐ সকল কথা আছে। অধ্যায়ের নাম কোষপ্রবেশ্যরত্নপরীক্ষা। এখানে রত্ন শব্দের অর্থ কেবল হীরা জহবরত নয়, যে পদার্থের
যাহা উত্কৃষ্ট সেটির নাম রত্ন। এই রত্লের মধ্যে অগুরু আছে, চন্দন
আছে, চর্ম আছে, পাটের কাপড় আছে, রেশমের কাপড় আছে ও তুলার কাপড় আছে। যে অংশ তর্জমা
হইল, তাহাতে মগধ আ পৌণ্ড্রদেশের নাম আছে, এই দুইটি দেশ সকলেই জানেন। মগধ – দক্ষিণ-বেহার। আর পৌণ্ড্র - বারেন্দ্রভূমি। সুবর্ণকুড্য
কোথায়! প্রাচীন টীকাকার বলেন, সুবর্ণকুড্য কামরূপের নিকট। কিন্তু
কামরূপের নিকট যে রেশম এখন হয় তা ভেরেন্ডাপাতায় হয়। আমি বলি
সুর্ণকুড্যের নাম শেষে কর্ণসুবর্ণ হয়। কর্ণসুবর্ণও মুর্শিদাবাদ ও রাজমহল
লইয়া। এখানকার মাটি সোনার মত রাঙা বলিয়া এ দেশকে কর্ণসুবর্ণ, কিরণসুবর্ণ বা সুবর্ণকুড্য
বলিত। এখানে এখনও রেশমের চাষ হয় এবং এখানকার রেশম খুব ভাল। নাগবৃক্ষ
এখানে খুব জন্মায়। নাগবৃক্ষ শব্দের অর্থ নাগকেশরের গাছ। নাগকেশর বাংলার আর কোনওখানে দেখাযায় না কিন্তু এখানে
অনেক দেখা যায়। লিকুচ মাদারগাছ। মাদারগাছেও রেশমের পোকা বসিতে পারে। বকুল ও বটগাছ
প্রসিদ্ধই আছে। কৌটিল্য যে ভাবে চীনদেশের পট্টবস্ত্রের উল্লেখ করিলেন,
তাহাতে বোধ হয়, তিনি চীনদেশের কাপড় অপেক্ষা বাংলার রেশমী কাপড় ভাল বলিয়া মনে
করিতেন। রেশমী কাপড় যে চীন হইতে বাংলায় আসিয়াছিল, তাহার কোনও
প্রমাণই অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যায় না। চীনের রেশম তুঁতগাছ হইতে হয়। বাংলার রেশমের
তুঁতগাছের সহিত কোনও সম্পর্ক নাই। সুতরাং বাঙালী যে রেশমের চাষ চীন
হইতে পাইয়াছে, এ কথা বলিবার জো নাই। এখন পরিষ্কার করিয়া বলিতে হইবে যে,
রেশমের চাষ বাংলাতেও ছিল, চীনেও ছিল। তবে তুঁতগাছ দিয়া রেশমের চাষ সর্বত্র
ছাড়াইয়া পড়িয়াছে। ভারতবর্ষের অন্যত্র যে রেশমের চাষ ছিল, এ কথা চাণক্য
বলেন না। তিনি বলেন, বাংলায় ও মগধেই রেশমের চাষ ছিল। কারণ,
পৌণ্ড্রও বাংলায়, সুবর্ণকুড্যও বাংলায়। চাণক্যের পরে কিন্তু ভারতবর্ষের
নানান স্থানে রেশমের চাষ হইত।
...অর্থশাস্ত্রে আমরা যে সংবাদ পাইলাম, সেটি বাংলার বড়ই
গৌরবের কথা। যদি বাঙালীরা সকলের আগে রেশমের চাষ করিয়া থাকেন, তাহা
হইলে ত তাঁহাদের গৌরবের সীমা নাই। যদি চীনেই সর্বপ্রথম উহার আরম্ভ হয়,
তথাপি বাঙালীরা চীন হইতে কিছু না শিখিয়াই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবে যে রেশমের কাজ
আরম্ভ করেন, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। কারণ, তাঁহারা ত আর তুঁতপাতা হইতে আর
রেশম বাহির করিতেন না, এ কথা পূর্বেই বলিয়াছি। যে সকল গাছ
বিনা চাষে তাঁহাদের দেশে প্রচুর জন্মায়, সে সকল গাছের পোকা হইতেই তাঁহারা নানা
রঙের রেশম বাহির করিতেন। চীনের রেশম সবই সাদা, তাহা রঙ করিতে হয়। বাংলার রেশম
রঙ করিতে হইত না, গাছবিশেষের পাতার জন্যই ভিন্ন ভিন্ন রঙের সুতা হইত। আর এ বিদ্যা
বাংলার নিজস্ব, ইহা কম গৌরবের কথা নয়।
No comments:
Post a Comment