সাম্প্রতিক পঞ্জীকরণে বিদ্ধ ৪০+ লক্ষ গ্রামীণ বাঙালি। তারা গত আড়াইশ+ বছর কি কি অনাচার অভিচার অত্যাচার দেখেছে(আর প্রতিবাদ করেছে লড়েছে তার মত করে) তার একটা তালিকা করা গেল -
১) পলাশীর পর উদ্দাম অনিয়ন্ত্রিত সম্পদ জ্ঞান লুঠ;
২) পলাশীর পর প্রাথমিকভাবে নুন সুপুরি তামাকের ব্যবসায় কোম্পানির কর্তাদের প্রথম একচেটিয়া দখলদারি;
৩) মীরকাশিমের সময় বাঁশ, চট, খড় ইত্যাদি খুবই ছোট ছোট ব্যবসা দখল করল সাম্রাজ্যবাদী ব্যবসায়ীরা;
৪) মুঘল সম্রাট বাংলা সুবার রাজস্বতোলার দায় তুলে দিল বিদেশি বানিয়া কোম্পানির হাতে। এটা বাঙলার প্রথম অর্থনৈতিক আউটসোর্সিং কাজ;
৫) ১১৭৬এর অনাবৃষ্টির পর ১ কোটি বাঙ্গালি-বিহারীর গণহত্যা - সব থেকে বেশি রাজস্ব আদায়। যেহেতু প্রজাপালক নবাব বা মোঘল শাসকেরা নেই, তাই কৃষককে সহজ শর্তে তাকাভি ঋণ দিয়ে বাঁচার কেউ ছিল না। শুধু হাজি মহম্মদ এবং রাণী ভবানী তাদের সিন্দুক খুলে দিয়েছিলেন। তীব্র স্বরে এই মহীয়সী নারী ধিক্কার জানিয়েছিলেন লুঠের। ৩ কোটি মানুষের উদরপূর্তির জন্যে কোম্পানি দিয়েছিল মাত্র ৯০ হাজার টাকা! কোটি মানুষ উচ্ছেদ হল। বড় অংশ দাস হয়ে ভারতের বাইরে চলে গেলেন বাগিচা শ্রমিক হিসেবে বেঁচে থাকার, উদরপূর্তির জন্যে;
৬) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এল মন্বন্তরনামী গণহত্যার কুড়ি বছরের মধ্যেই। চাষীর জমির অধিকার কেড়ে নিয়ে এশিয়ায় এই প্রথম জমির বাজার তৈরি করল ব্রিটিশ এবং বিপুল জমিহীন কৃষক তৈরি হল; শুরু হল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত লুঠ, চলবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবদি; তারপরে লুঠের রাশ দিয়ে যাবে দেশিয় শাসকদের তাঁবে;
৭) পলাশীর পর থেকে বিশিল্পায়নের ধারা চলছিল, বাংলার রাজস্ব দিয়েই কোম্পানি তার এশিয় ব্যবসার বিনিয়োগ করছিল, এবারে বিপুলাকারে বিশিল্পায়নে নেমে এল পূর্বভারত জুড়ে; ১৮২০র মধ্যে ঢাকা জনশূন্য শহর হল, ফুটি তুলো ধ্বংস করল, বাংলা, ভারত জুড়ে একে একে বিভিন্ন শিল্পকাঠামো বিনষ্ট করল কোম্পানি;
৮) এই সামগ্রিক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতিকে অমিয় কুমার বাগচী বলছেন বিশ্বের সর্বপ্রথম স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট পলিসির প্রয়োগ; এ নীতি আজও প্রয়োগ হয়ে চলেছে না কি;
৯) নবজাগরণের সময় এল। কারিগরদের মৌখিক শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি বিকেন্দ্রিভূত সমাজ বিপুল সংখ্যায় পাঠশালা ইত্যাদির পৃষ্ঠপোষণা করত; স্থানীয় সমাজ, অর্থনীতি সেই পাঠশালাজাত শিক্ষার্থীদের যেভাবে স্থানীয় অর্থনীতি কৃষ্টিতে কাজ লাগাত, উপনিবেশের লুঠ চালাতে চাকুরে প্রয়োজনের মেকলিয় কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত পাঠ ব্যবস্থায় সেই সমাজ নিয়ন্ত্রিত রোজগার চাকরি ব্যবস্থা আর রইল না। সাম্রাজ্যের লুঠের জন্যে প্রয়োজন হল কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণযুক্ত পড়াশোনা। প্রয়োজন হল ইংরেজি শিক্ষিত ইওরোপকে মাবাবা মনে করা শিক্ষিত জন যারা নিজেদের দেশের মানুষদের অশিক্ষিত নোংরা, অইওরোপিয়, অপ্রগতিশীল নামে ঘেন্না করে ঔপনিবেশিক স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট পলিসি নিজের দেশেই প্রগতিশীলতার নাম করে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের নির্দেশ অনুযায়ী প্রয়োগ করবে। এই মগজ ধোলাই হওয়া ইংরেজি শিক্ষিতদের সারা ভারতে এশিয়ায় বিশ্বে লুঠের সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজে লাগানো শুরু হল। বাঙালি হল বিশ্বনাগরিক; উদয় হলেন একেরপর এক মহাপুরুষ। ক্ষমতা চলে যাওয়া মুসলমান সমাজও আস্তে আস্তে নিজেদের এই কেন্দ্রিয় ব্যবস্থায় মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
১০) প্রথমে আসাম ভাগ হল। তারপরে বাংলাভাগ রোখা গেল।
১১) উনপঞ্চাশে আবার চার্চিলের উদ্যোগে একটা প্রবল গণহত্যা হল। এবারে ৫০-৬০ লক্ষ মারা গেল। বাঙালি প্রাক্তন উপাচার্য, বিচারপতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ছুটলেন ব্রিটিশদের কবল থেকে জাপানকে বাঁচাতে;
১২) ছিয়াত্তর আর উনপঞ্চাশের মাঝে প্রচুর গণহত্যা হল, লাখো লাখো বাঙালি মারা গেল;
১৩) তারপর বাংলা ভাগ। লাখো মানুষের ঠাঁইনাড়া হলেন নিজেদের বাপ দিদিমার ভিটে থকে। বিশ্বের অপরিকল্পিত অব্যবস্থার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই পরিকল্পনা।এই অবর্ণনীয় অনাচারও বাঙালি ঔপনিবেশিক নবজাগরনীয় ভদ্রবিত্তকে নাড়াতে পারল না। সে ইওরোপমন্যই থেকে গেল;
১৪) "স্বাধীন" ভারত প্রাণপনে ইওরোপের ছেড়ে যাওয়া স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট পলিসি নতুন নামে - কখোনো শিল্পায়ন, কখোনো গরীবি হটাও, কখোনো শিল্পের কাঠামো তৈরি করার নামে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিল। কোটি গ্রামীণকে উচ্ছেদ করে দেশকে আধুনিক পশ্চিমযোগ্য করে তোলার কাজে ভারতে ৫০ বছরে উচ্ছেদ হয়েছেন অন্তত ৫ কোটির বেশি মানুষ, না ইতিহাস তাদের মনে রাখে নি; মনে রেখেছে যারা সেই উচ্ছেদের পরিকল্পনা করেছিলেন, তাদের;
১৫) তারপরে একাত্তর। কত বাঙালি মারা গিয়েছে সে হিসেব আজও কষা চলছে;
১৬) ভারতে প্রায় সব কটা রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ মদতে আসামে এল পঞ্জীকরণ। ৪০+ লক্ষ বাঙ্গালিকে চিহ্নিত করা হল সম্ভাব্য বিদেশি হিসেবে। বেশ কয়েকজন হিন্দু বাঙ্গালিকে তারকাঁটা পার করিয়েও দেওয়া হল, বিজেপি হিন্দুদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও।
১৭) এবারের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় পঞ্জিকরণ চালু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বিজেপিকে ক্ষমতায় আনার প্রথম ধাপে ১৮টা লোকসভা আসন বিজেপিকে তুলে দিল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি।
No comments:
Post a Comment