কিছু উপলব্ধি। লেখাটা বড়, এড়াতে পারেন
//হিন্দি, ইংরেজি এবং উপনিবেশপূর্ব যোগাযোগের ভাষা চাটগাঁয়ের ভাষা যশোরেরর মানুষ বোঝে না চৈতন্য, শঙ্করদেব কি করে ধর্মমত প্রচার করলেন?// শীর্ষকের আলোচনায় Simool ভাই মন্তব্য করেছিলেন // আমিও আসলে এই বিষয়ে খুঁজছি। মধ্যযুগে বাংলা ভাষার সামাজিক ভিত্তিগুলো জানতে পারলে খুব ভাল হয়। বৈশ্য, কারিগর, অন্ত্যজ, প্রাকৃত পরিমণ্ডলে কোন ভাষার ব্যবহার ছিল? অথবা, রাজদরবারে কোন ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হত? শিক্ষায় বাংলার কি কোনও গুরুত্বই ছিল না? এই সব।// তার উত্তরে যে লেখাটা লিখতে চেয়েছিলাম যেটা তৃতীয় দফায় এসে সম্পূর্ণ হল প্রথামিকভাবে যে কাঠামো আর গতি ছিল সেটা সম্পূর্ণ পালটে গেছে। তবুও লিখলাম।
গত কালও কম্পিউটার ভুগিয়েছে।
বাংলা ভাষা বিষয়ে আমার কতগুলো ধারণা হয়েছে, সেটা একে একে বলি। এটা কিছুটা পড়াশোনা, কিছুটা অনুভব আর একটা বড় অংশ দেশ ব্যাপী হকার এবং বাংলা ব্যাপী কারিগরদের দেখার, বোঝার এবং তাদের থেকে শিক্ষা নেওয়ার ফল বলতে পারেন। এটা মূলত অনির্বাণ নন্দীদা বা Simool Sen ভাইএর সঙ্গে আলোচনা জাত কিন্তু এর অনেক অংশে তারা এবং পাঠকেরা আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন, সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু নিচের যে বিষয়টা লিখব সেটা আমার একান্ত অনুভূতিজাত। উপনিবেশপূর্ব শিক্ষায় সংস্কৃত নির্ভরতার যে মিথ্যে টিকা লাগানো হয়েছে বঙ্গভাগপরবর্তী সময়ে নব্য নবজাগরনীয় বাংলায় কর্পোরেট শিক্ষা, ইংরেজি আর প্রমিত বাংলা চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে সেটা অনেকটা ঠিকই ছিল না – তার কারন নিচে বলব যে বাংলায় প্রমিতভাষা বলে কিছুই ছিল না – যদিও কলকাতা ভিত্তিক ইতিহাস চর্চা গৌড়িয় বা নবদ্বীপিয় বাংলাকে প্রমিত বলে দাবি করেছেন, পলাশীপূর্ব সময় বাংলার ভাষা কৃষ্টির কোনও তথাকথিত কেন্দ্র ছিল না – সেন রাজারা নদীয়া থেকে পালিয়ে আরও এক শতক পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করেন, আমরা চন্দ্র বংশের ইতিহাস জানিই না - সেই কেন্দ্রগুলোর কৃষ্টি ইতিহাস জানিনা। আপনারা ১৮১৮র ওয়ার্ডের কলকাতার টোলের সমীক্ষা পড়লে দেখবেন একমাত্র টোলে উচ্চশিক্ষায় যারা গুরুগিরি করবেন তাদের জন্যে সংস্কৃত বরাদ্দ ছিল তার আগের স্তরে নয়। কারণ অর্থনীতি স্থানিক ছিল – যারা বিদেশে যেত তারা সেই মত তৈরি হত – তাঁরা হাজারে হয়ত গুটিক ছিলেন। যদিও বামপন্থীরা পলাশীপূর্ব শিক্ষা ব্যবস্থাকে সামন্তের করণিক তৈরি করার কারখানা বলছেন, কিন্তু এঙ্গাস ম্যাডিসনের প্রবল খিস্তি খেয়েও(যা বিন্দুমাত্র সঠিক ছিল না) যে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাংলা যার জিডিপি ছিল ৬, সেই বাংলায় এই মানুষদের স্থানীয় অর্থনীতি চালাবার জন্যে প্রয়োজন ছিল। এবং আমার অনুভূতি পলাশীপূর্ব প্রশাসনিক কাঠামো বর্তমানে শিক্ষিতদের যে খিস্তি খায় সেটা তার বিন্দুমাত্র প্রাপ্য ছিল না। অমিয় বাগচী কথিত ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট পলিসি পূর্ব সময়ে বাংলাকে রবার্ট ওর্মে কথিত বাংলায় বাণিজ্যের জন্যে বিপুল পরিমান রূপো বা কিছু সোনা ঢুকত সারা বিশ্ব থেকে তার এককণাও বাংলা থেকে বেরোত না - সোনার বাংলা তৈরি করার জন্যে দায়ি যে মানুষেরা তার মধ্যে সে সময়ের প্রশাসনকে আর বিকেন্দ্রিত শিক্ষা ব্যবস্থাও পড়ে - এদের খিস্তি দেওয়াটা মনে হয় ভেবেচিন্তে দেওয়া দরকার।
১) আজকে যে প্রমিত বাংলার কাঠামোটা আমরা দেখছি সেটি প্রবলভাবে ঔপনিবেশিক - ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ইত্যাদিতে গোড়া পত্তন, লুঠের, রাজনীতির জন্যে উচ্চবর্ণ এবং অভিজাতদের জীবনে যে কেন্দ্রিভবনের চাপ নেমে এল সেটাই আদতে আজকের কলকাতিয়া বা ঢাকাইয়া বাংলা। এটার সঙ্গে ঠিক ঔপনিবেশিক সময়ের আশেপাশের দশকগুলিতে বিদ্যাসুন্দর(স্রষ্টা মারা যান ১১৬৭/১৭৬০) বা রামপ্রসাদের(মৃ ১১৮২/১৭৭৫) বাংলার সঙ্গে কোনও মিল নেই। অথচ পশ্চিম দিকের বাংলার কবির কবির গান গীত হচ্ছে তার সময়েই চট্টগ্রামে। তো এরা দুজনই কিন্তু শহুরে মানুষ ছিলেন – তাই প্রমিততা দুজনের মধ্যেই ছিল - কিন্তু প্রমিততার গ্রহীতা ছিল কম।
২) আবার সে সময় বাংলা ছিল এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যবসা কেন্দ্র। হুসেনশাহের সময়ও চিনা বণিকেরা ৬০টার বেশি বাংলার পণ্য(তার মধ্যে কিছু অন্য এলাকার পণ্যও ছিল বাংলা হয়ে যেত) নিয়ে যেতে গিয়ে ৬০০ টি বাংলা বণিজ্য শব্দ চিনা ভাষায় রূপান্তরিত করেন। সেখানেও প্রমিততা ছিল। বা শ্রীলঙ্কার দুই সমাজকর্মী আমায় বলেছিলেন বাংলার সঙ্গে তাদের দেশের ভাষায় অদ্ভুত সাদৃশ্য। সেখানেও স্বাভাবিকভাবে প্রপমিততার সূত্রই দেখি।
৩)কিন্তু যাদের ছড়িয়ে যাবার বা ক্ষমতাকে খুশি করার কোনও দরকার ছিল না – তাদের ভাষা ছিল অপ্রমিত আঞ্চলিক। আজও দুজন এক অঞ্চলের কারিগর চাষি তাদের অঞ্চলের ভাষাতেই ভাব বিনিময় করেন। সেইদিনও করতেন। বা ধরুণ খন পালা দল বা ভাওয়াইয়া গায়ক বা ঝুমুর গায়ক, বা ডোমনি গায়ক বা সত্যপীর গায়ক/দল তাদের প্রাথমিক কর্তব্য স্থানীয় মানুষের কৃষ্টি জ্ঞান আর তথ্য পিপাসা মেটানো। তার জন্যে তাদেরকে প্রমিত বাংলার আশ্রয় নিতে হয় নি। আজও হয় না। যে বর্ধমানের লোহার কারিগর বাংলার ঢাকা আর বিষ্ণুপুরের শাঁখের কারিগরদের জন্যে শাঁখের করাত বানয়ে দেন, তারা কি ভাষায় কথা বলতেন, ভাব প্রকাশ করতেন জানি না।
৪) এবারে শিক্ষার উদাহরণ দেব – এডামের সমীক্ষা – ১৮৩৫-৩৮তে রিপোর্ট জমা –পাঠশালার কাঠামোটা কিন্তু উপনিবেশিকপূর্ব। তিনি জেলা ধরে ধরে সমীক্ষা করেছেন এবং ১,৫৬,০০০ বাংলা বিহারের গ্রামে অর্থাৎ ত্রিহুত থেকে নাটোর অবদি তিনি যে ১ লক্ষ পাঠশালা দেখেছেন সেগুলি স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্যে তৈরি হয়েছে এবং অকেন্দ্রিভূত, রাষ্ট্রের সাহায্যহীন, কেন্দ্রিয় মান্য পাঠতালিকা মুক্ত। ফলে মেদিনীপুরে যা বা যে ভাষায় পড়ানো হত, ত্রিহুতে বা নাটোরে বা বর্ধমানে সেই বিষয় বা সেই ভাষায় পড়ানো হত না, এবং এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে উচ্চবর্ণ ছিল ১৫%। অথচ এডাম যখন নিদান দিচ্ছেন পাঠ্যের ভাষা মাধ্যম কি হবে তিনি স্থানীয় ভাষাগুলিকেকে পাত্তা না দিয়ে মেকলের ইংরেজির মতই বাংলাকে চাপিয়ে দেওয়ার কথা বললেন। তবুও ভারতের এই একমাত্র শিক্ষা সমীক্ষা যেটি বাংলা ভাষায় শিক্ষা দানের কথা বলল, তার পরে এতগুলি শিক্ষা কমিশন হয়েছে, তারা এ কথা বলার সাহসই পেল না কর্পোরেট আর মধ্যবিত্তের চাপে। তাতে হয়ত ভালই হয়েছে তাতে বিদ্যালয় ছুট বেড়েছে, গ্রামাঞ্চলে যতটা হারে কর্পোরেটাইজেশন হওয়ার কথা ছিল তা হয় নি। ২৫ লক্ষ প্রাথমিকে ভর্তি হলে স্নাতকে বসে ৮০ হাজার, পাস বা কর্পোরেট রাষ্ট্রকে সেবা করার ভদ্রলোক উতপন্ন হয় আরও কম।
৫) এবারে আসি প্রযুক্তি শিক্ষায় – দুটো উদাহরণ দেব – কৃষি আর ধাতু – একটি পরাশরের কৃষিবিদ্যা যাকে কৃষি পরাশর বলে জানি আর ভগভট্টের রসরত্নসমুচ্চয়ে এটা পারদ আর লোহার পরিস্রবণ ব্যবহার প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ে। আপনারা যদি এই দুটি পড়েন, আমি পড়েছি অষ্টম শ্রেণীর তথাকথিত ঐচ্ছিক সংস্কৃত ভাষার জ্ঞান অনুসারে, আমি বুঝেছি কিন্তু। অনেকটা বাংলা ঘেঁসা সংস্কৃত বলেই মনে হয়েছে। আপনি যদি সে সময় প্রভূত তান্ত্রিক বইও পড়েন তাহলে এই সংস্কৃতকে পৈশাচীকি বলে মহামহোপাধ্যায়েরা দাগিয়ে দিচ্ছেন – অর্থাৎ আবরণটা সংস্কৃত গন্ধী কিন্তু চলনটা বাংলার।
৬) আদতে পলাশীপূর্ব বাংলা ইতিহাস কি বলে জানি না, কিন্তু ইতিহাস পড়ে আমার মনে হয়েছে সেটা এককেন্দ্রিক ছিল না, ঢাকাই হোক বা মুর্শিদাবাদই হোক বা দেবকোটই হোক বা নদিয়াই হোক – কেন্দ্রিভূত কোনও রাজবংশ রাজত্ব করলেও প্রত্যেক অঞ্চল তার চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠত – রাজধানী বা বড় শহরে কতজনইবা থাকতেন – ঔপনিবেশিক সময়ের মত সব রক্ত এসে কলকাতায় জড়ো হয় নি – সারা বাংলা জুড়েই রাজ প্রাসাদগুলি ছড়িয়ে থাকা প্রমান করে যে বাংলা বহুকেন্দ্রিক ছিল – কলকাতা এবং তাকে ঘিরে অমুক তমুক তসুক রাজবাড়ির ছয়লাপ হল ছিয়াত্তরের এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরেই। ফলে যে কৃষ্টি বাণিজ্য ভাষার মুক্তি অনৌপনিবেশিক সময়ে ছিল সেটা ঔপনিবেশিক সময়ে অন্তর্হিত হয়ে গেল। নবাবি আমলও রাজা জমিদারদের ঘটা করে রাজস্ব দিতে আসতে হত মুর্শিদাবাদে পুণ্যাহের সময় এবং তাদের নবাব খেলাত দিতেন। রাজকার্য শেষে আবার তারা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যেতেন। এই প্রভাব পড়ে নি স্থানিকতায়? কারণ নবাব্রের রাজস্ব দপ্তর থাকলেও কোনও ভাষা বা শিক্ষা দপ্তর ছিল না প্রমিততা অগ্রগতি ইত্যাদির বাহানায় ভাষা শিক্ষা কৃষ্টি চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে।
আর শেষে বলি ব্যক্তি আমি উপভাষা ডায়ালেক্ট নামক ঔপনিবেশিক শব্দকে ঘেন্না করি – এটি আদতে কেন্দ্রিভবনের একটা উপায়।
বাংলা ভাষা বিষয়ে আমার কতগুলো ধারণা হয়েছে, সেটা একে একে বলি। এটা কিছুটা পড়াশোনা, কিছুটা অনুভব আর একটা বড় অংশ দেশ ব্যাপী হকার এবং বাংলা ব্যাপী কারিগরদের দেখার, বোঝার এবং তাদের থেকে শিক্ষা নেওয়ার ফল বলতে পারেন। এটা মূলত অনির্বাণ নন্দীদা বা Simool Sen ভাইএর সঙ্গে আলোচনা জাত কিন্তু এর অনেক অংশে তারা এবং পাঠকেরা আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন, সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু নিচের যে বিষয়টা লিখব সেটা আমার একান্ত অনুভূতিজাত। উপনিবেশপূর্ব শিক্ষায় সংস্কৃত নির্ভরতার যে মিথ্যে টিকা লাগানো হয়েছে বঙ্গভাগপরবর্তী সময়ে নব্য নবজাগরনীয় বাংলায় কর্পোরেট শিক্ষা, ইংরেজি আর প্রমিত বাংলা চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে সেটা অনেকটা ঠিকই ছিল না – তার কারন নিচে বলব যে বাংলায় প্রমিতভাষা বলে কিছুই ছিল না – যদিও কলকাতা ভিত্তিক ইতিহাস চর্চা গৌড়িয় বা নবদ্বীপিয় বাংলাকে প্রমিত বলে দাবি করেছেন, পলাশীপূর্ব সময় বাংলার ভাষা কৃষ্টির কোনও তথাকথিত কেন্দ্র ছিল না – সেন রাজারা নদীয়া থেকে পালিয়ে আরও এক শতক পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করেন, আমরা চন্দ্র বংশের ইতিহাস জানিই না - সেই কেন্দ্রগুলোর কৃষ্টি ইতিহাস জানিনা। আপনারা ১৮১৮র ওয়ার্ডের কলকাতার টোলের সমীক্ষা পড়লে দেখবেন একমাত্র টোলে উচ্চশিক্ষায় যারা গুরুগিরি করবেন তাদের জন্যে সংস্কৃত বরাদ্দ ছিল তার আগের স্তরে নয়। কারণ অর্থনীতি স্থানিক ছিল – যারা বিদেশে যেত তারা সেই মত তৈরি হত – তাঁরা হাজারে হয়ত গুটিক ছিলেন। যদিও বামপন্থীরা পলাশীপূর্ব শিক্ষা ব্যবস্থাকে সামন্তের করণিক তৈরি করার কারখানা বলছেন, কিন্তু এঙ্গাস ম্যাডিসনের প্রবল খিস্তি খেয়েও(যা বিন্দুমাত্র সঠিক ছিল না) যে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাংলা যার জিডিপি ছিল ৬, সেই বাংলায় এই মানুষদের স্থানীয় অর্থনীতি চালাবার জন্যে প্রয়োজন ছিল। এবং আমার অনুভূতি পলাশীপূর্ব প্রশাসনিক কাঠামো বর্তমানে শিক্ষিতদের যে খিস্তি খায় সেটা তার বিন্দুমাত্র প্রাপ্য ছিল না। অমিয় বাগচী কথিত ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট পলিসি পূর্ব সময়ে বাংলাকে রবার্ট ওর্মে কথিত বাংলায় বাণিজ্যের জন্যে বিপুল পরিমান রূপো বা কিছু সোনা ঢুকত সারা বিশ্ব থেকে তার এককণাও বাংলা থেকে বেরোত না - সোনার বাংলা তৈরি করার জন্যে দায়ি যে মানুষেরা তার মধ্যে সে সময়ের প্রশাসনকে আর বিকেন্দ্রিত শিক্ষা ব্যবস্থাও পড়ে - এদের খিস্তি দেওয়াটা মনে হয় ভেবেচিন্তে দেওয়া দরকার।
১) আজকে যে প্রমিত বাংলার কাঠামোটা আমরা দেখছি সেটি প্রবলভাবে ঔপনিবেশিক - ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ইত্যাদিতে গোড়া পত্তন, লুঠের, রাজনীতির জন্যে উচ্চবর্ণ এবং অভিজাতদের জীবনে যে কেন্দ্রিভবনের চাপ নেমে এল সেটাই আদতে আজকের কলকাতিয়া বা ঢাকাইয়া বাংলা। এটার সঙ্গে ঠিক ঔপনিবেশিক সময়ের আশেপাশের দশকগুলিতে বিদ্যাসুন্দর(স্রষ্টা মারা যান ১১৬৭/১৭৬০) বা রামপ্রসাদের(মৃ ১১৮২/১৭৭৫) বাংলার সঙ্গে কোনও মিল নেই। অথচ পশ্চিম দিকের বাংলার কবির কবির গান গীত হচ্ছে তার সময়েই চট্টগ্রামে। তো এরা দুজনই কিন্তু শহুরে মানুষ ছিলেন – তাই প্রমিততা দুজনের মধ্যেই ছিল - কিন্তু প্রমিততার গ্রহীতা ছিল কম।
২) আবার সে সময় বাংলা ছিল এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যবসা কেন্দ্র। হুসেনশাহের সময়ও চিনা বণিকেরা ৬০টার বেশি বাংলার পণ্য(তার মধ্যে কিছু অন্য এলাকার পণ্যও ছিল বাংলা হয়ে যেত) নিয়ে যেতে গিয়ে ৬০০ টি বাংলা বণিজ্য শব্দ চিনা ভাষায় রূপান্তরিত করেন। সেখানেও প্রমিততা ছিল। বা শ্রীলঙ্কার দুই সমাজকর্মী আমায় বলেছিলেন বাংলার সঙ্গে তাদের দেশের ভাষায় অদ্ভুত সাদৃশ্য। সেখানেও স্বাভাবিকভাবে প্রপমিততার সূত্রই দেখি।
৩)কিন্তু যাদের ছড়িয়ে যাবার বা ক্ষমতাকে খুশি করার কোনও দরকার ছিল না – তাদের ভাষা ছিল অপ্রমিত আঞ্চলিক। আজও দুজন এক অঞ্চলের কারিগর চাষি তাদের অঞ্চলের ভাষাতেই ভাব বিনিময় করেন। সেইদিনও করতেন। বা ধরুণ খন পালা দল বা ভাওয়াইয়া গায়ক বা ঝুমুর গায়ক, বা ডোমনি গায়ক বা সত্যপীর গায়ক/দল তাদের প্রাথমিক কর্তব্য স্থানীয় মানুষের কৃষ্টি জ্ঞান আর তথ্য পিপাসা মেটানো। তার জন্যে তাদেরকে প্রমিত বাংলার আশ্রয় নিতে হয় নি। আজও হয় না। যে বর্ধমানের লোহার কারিগর বাংলার ঢাকা আর বিষ্ণুপুরের শাঁখের কারিগরদের জন্যে শাঁখের করাত বানয়ে দেন, তারা কি ভাষায় কথা বলতেন, ভাব প্রকাশ করতেন জানি না।
৪) এবারে শিক্ষার উদাহরণ দেব – এডামের সমীক্ষা – ১৮৩৫-৩৮তে রিপোর্ট জমা –পাঠশালার কাঠামোটা কিন্তু উপনিবেশিকপূর্ব। তিনি জেলা ধরে ধরে সমীক্ষা করেছেন এবং ১,৫৬,০০০ বাংলা বিহারের গ্রামে অর্থাৎ ত্রিহুত থেকে নাটোর অবদি তিনি যে ১ লক্ষ পাঠশালা দেখেছেন সেগুলি স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্যে তৈরি হয়েছে এবং অকেন্দ্রিভূত, রাষ্ট্রের সাহায্যহীন, কেন্দ্রিয় মান্য পাঠতালিকা মুক্ত। ফলে মেদিনীপুরে যা বা যে ভাষায় পড়ানো হত, ত্রিহুতে বা নাটোরে বা বর্ধমানে সেই বিষয় বা সেই ভাষায় পড়ানো হত না, এবং এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে উচ্চবর্ণ ছিল ১৫%। অথচ এডাম যখন নিদান দিচ্ছেন পাঠ্যের ভাষা মাধ্যম কি হবে তিনি স্থানীয় ভাষাগুলিকেকে পাত্তা না দিয়ে মেকলের ইংরেজির মতই বাংলাকে চাপিয়ে দেওয়ার কথা বললেন। তবুও ভারতের এই একমাত্র শিক্ষা সমীক্ষা যেটি বাংলা ভাষায় শিক্ষা দানের কথা বলল, তার পরে এতগুলি শিক্ষা কমিশন হয়েছে, তারা এ কথা বলার সাহসই পেল না কর্পোরেট আর মধ্যবিত্তের চাপে। তাতে হয়ত ভালই হয়েছে তাতে বিদ্যালয় ছুট বেড়েছে, গ্রামাঞ্চলে যতটা হারে কর্পোরেটাইজেশন হওয়ার কথা ছিল তা হয় নি। ২৫ লক্ষ প্রাথমিকে ভর্তি হলে স্নাতকে বসে ৮০ হাজার, পাস বা কর্পোরেট রাষ্ট্রকে সেবা করার ভদ্রলোক উতপন্ন হয় আরও কম।
৫) এবারে আসি প্রযুক্তি শিক্ষায় – দুটো উদাহরণ দেব – কৃষি আর ধাতু – একটি পরাশরের কৃষিবিদ্যা যাকে কৃষি পরাশর বলে জানি আর ভগভট্টের রসরত্নসমুচ্চয়ে এটা পারদ আর লোহার পরিস্রবণ ব্যবহার প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ে। আপনারা যদি এই দুটি পড়েন, আমি পড়েছি অষ্টম শ্রেণীর তথাকথিত ঐচ্ছিক সংস্কৃত ভাষার জ্ঞান অনুসারে, আমি বুঝেছি কিন্তু। অনেকটা বাংলা ঘেঁসা সংস্কৃত বলেই মনে হয়েছে। আপনি যদি সে সময় প্রভূত তান্ত্রিক বইও পড়েন তাহলে এই সংস্কৃতকে পৈশাচীকি বলে মহামহোপাধ্যায়েরা দাগিয়ে দিচ্ছেন – অর্থাৎ আবরণটা সংস্কৃত গন্ধী কিন্তু চলনটা বাংলার।
৬) আদতে পলাশীপূর্ব বাংলা ইতিহাস কি বলে জানি না, কিন্তু ইতিহাস পড়ে আমার মনে হয়েছে সেটা এককেন্দ্রিক ছিল না, ঢাকাই হোক বা মুর্শিদাবাদই হোক বা দেবকোটই হোক বা নদিয়াই হোক – কেন্দ্রিভূত কোনও রাজবংশ রাজত্ব করলেও প্রত্যেক অঞ্চল তার চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠত – রাজধানী বা বড় শহরে কতজনইবা থাকতেন – ঔপনিবেশিক সময়ের মত সব রক্ত এসে কলকাতায় জড়ো হয় নি – সারা বাংলা জুড়েই রাজ প্রাসাদগুলি ছড়িয়ে থাকা প্রমান করে যে বাংলা বহুকেন্দ্রিক ছিল – কলকাতা এবং তাকে ঘিরে অমুক তমুক তসুক রাজবাড়ির ছয়লাপ হল ছিয়াত্তরের এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরেই। ফলে যে কৃষ্টি বাণিজ্য ভাষার মুক্তি অনৌপনিবেশিক সময়ে ছিল সেটা ঔপনিবেশিক সময়ে অন্তর্হিত হয়ে গেল। নবাবি আমলও রাজা জমিদারদের ঘটা করে রাজস্ব দিতে আসতে হত মুর্শিদাবাদে পুণ্যাহের সময় এবং তাদের নবাব খেলাত দিতেন। রাজকার্য শেষে আবার তারা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যেতেন। এই প্রভাব পড়ে নি স্থানিকতায়? কারণ নবাব্রের রাজস্ব দপ্তর থাকলেও কোনও ভাষা বা শিক্ষা দপ্তর ছিল না প্রমিততা অগ্রগতি ইত্যাদির বাহানায় ভাষা শিক্ষা কৃষ্টি চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে।
আর শেষে বলি ব্যক্তি আমি উপভাষা ডায়ালেক্ট নামক ঔপনিবেশিক শব্দকে ঘেন্না করি – এটি আদতে কেন্দ্রিভবনের একটা উপায়।
(লেখাটি হয়েছে দায়ে পড়ে - এটা লেখার কোনও যোগ্যতা নেই ।)
No comments:
Post a Comment