[বয়স হচ্ছে, তেজ কমছে বুঝতে পারছি]
মুখে বুকে প্রমিতভাবেই আলাদা, ইওরোপমন্য প্রগতিশীল ভদ্রলোকেদের চরিত্রের প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের যৌবনে ছোটলোক বিরোধিতা আর শেষ বয়সে ছোটলোকেদের কোলে ফিরে আসাকে খুব একটা দোষ দিতে পারছি না। তিনি যা করেছেন সব প্রমিত সমাজের উপকারের জন্যে। আজকালের প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারীদের মত নিজের বা নিজের পরিবারের জন্যে একফোঁটা কিছুই করেন নি - বিলাস বলতে ছিল শুধু মরক্কোর চামড়ায় বই বাঁধানো। আন্দোলনে সবার আগে নিজের ছেলেকে বিয়ে দিয়ে উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। সেই ছেলে উন্মার্গগামী হলে তাকে তাঁর সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেন। শেষ বয়সে ইওরোপমন্যতার খোঁয়ারি ভেঙ্গে যখন বুঝলেন অপাত্র ভদ্রবিত্তদের জন্যে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় শ্রেষ্ঠ মেধা, শ্রেষ্ঠ লবিত্ব, শ্রেষ্ঠ তেলবাজি, চাটুবাজি করেছেন, ভুল সমাজ আর প্রভু বেছেছেন, তখন তিনি ছোটলোকেদের স্মরণাপন্ন হলেন। কারমাটার যাওয়া তার প্রথম চয়েস ছিল না। সেখানে গিয়ে তিনি আরশোলা আর হাঁপানির যোগসূত্র খুঁজে পেয়ে হাঁপের ওষুধ তৈরি করেন সাঁওতালদের থেকে অর্জিত জ্ঞানে(এই তথ্যটা আমাকে পি ব্যানার্জীর ছাত্র জানিয়েছিলেন)।
গত কালের আসামের মনসামঙ্গল ওজাপালি লেখায় দেখিয়েছি কিভাবে প্রমিত সমাজ গোটা অপ্রমিত সমাজের নানা ধারা আত্মস্থ করছে এবং অপ্রমিত সমাজে যে সেগুলির চল ছিল সে স্মৃতির কোনও লেখ্য তথ্য রাখছেন না। সেই সূত্র দিচ্ছেন প্রমিত সমাজ-স্মৃতি থেকে। অপ্রমিত সমাজে তো আর লেখার চল নেই।
ধরা যাক অয়ুর্বেদের কথা - এটি সংহিতা - অর্থাৎ তথ্য জোগাড় করে লেখা - প্রাথমিক গবেষণাযোগ্য তত্ত্ব লিখন নয়। অর্থাত চরক সুশ্রুত এবং বাঙালি ভগভট্ট আলাদাভাবে তাত্ত্বিক চারণে আকাশ থেকে দৈববানী হিসেবে পান নি - বরং নানান পরম্পরার সমাজে প্রচলিত নিদানগুলি নিয়ে নিদান সংকলন বানাচ্ছেন - যেমন বিদ্যাসাগর মশাই কারমাটারে গিয়ে করেছেন। ধ্রুপদীওয়ালারা কোন নিদান কোন সমাজ থেকে নিচ্ছেন, সে সূত্র রাখছেন না - মনে হচ্ছে এটি স্বয়ম্ভূ - আদতে তা চুরিই। এটার মাস্টার ইওরোপ - ভারতীয়রা তাও সূত্র কিছুটা ছেড়ে যায় - ইওরোপিয়দের টুকলি অতীত এক্কেবারেই লেপাপোঁছা। ভাল ছাত্রর মত বোঝার উপায় ক্রুড চোতা নয়, বই থেকে মাথায় টুকলি করে সব অদৃশ্য চোতার মত পরীক্ষার হলে উগরে দিয়ে আসছে। এরাই মেধাবী হিসেবে পরিচিত হচ্ছে।
অথবা আগে বর্ণিত আসামের মনসামঙ্গল দেওধনী - ওজাদের নাচের চলন দেখে বুঝবেন কি জটিল হস্তসঞ্চালন এবং পদসঞ্চালন - দেখতে ধ্রুপদী নাচের মত। বৌ যখন গবেষণা করছিলেন তখন ধ্রুপদী জগত থেকে তাকে বলে দেওয়া হল এগুলি ওরা ধ্রুপদী ধারা থেকে নকল করে দেশিয় করণ করেছে। নানান প্রমিত বইতে তাইই লেখা আছে - যেমন প্রখ্যাত পণ্ডিত মহেশ্বর নেওগের বই। আপনারা কি বলতে পারেন মেচ/রাভা/কুড়মি/সাঁওতাল সমাজ তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আয়ুর্বেদ থেকে স্রেফ টুকেছে? কিন্তু তা অসম্ভব। গোটাটা ধারাটা প্রমিত ব্যবস্থা অপ্রমিত সমাজ থেকে চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে - এবং আমি নারায়ণ এবং ললিতার সঙ্গে গবেষণা করতে না গেলে জানতেই পারতাম না এই প্রমিত চুরিগুলি - হস্তমুদ্রা থেকে পদসঞ্চালন, অষুধ তৈরি থেকে চিকিৎসা নিদান দেওয়া - সব নানা স্তরের সংস্কৃতওয়ালারা পরিশীলিত টুকন করেছে অবলীলায়। ভরতনাট্যমের যা আঢাউ সত্রীয়ায় তা মাটি আখরা। নাচের মৌলিক একক। সত্রীয়ায় তা স্থানীয় অসংস্কৃত নামে পরিচিত। কারণ এটা ধ্রুপদী হয়েছে হালে। শুভঙ্কর লাহিড়ীর শ্রীহস্তমুক্তাবলীর সমস্ত কিছুই সত্রিয়ার অধ্রুপদীত্ব থেকে নেওয়া।
বিদ্যাসাগর মশাই যখন প্রমিতদের উদ্ধারে রত তখনথেকেই এই সব দুষ্কর্ম চলছে সারা ভারতে ইংরেজিদর তাত্ত্বিকতায় ইওরোপিয় ক্ল্যাসিক্যালতা নকল করে ধ্রুপদীত্ব তৈরির বাসনায়। ফলে ছোটলোকেদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্যে জ্ঞানচুরি, ঐতিহ্যচুরিই একমাত্র পথ। যা কিছু সৃষ্টি করেছে তো ছোটলোকে। ভদ্রলোকেদের সংখ্যা কত?
বিদ্যাসাগর মশাইকে এই প্রেক্ষিতে মনে হয় দেখতে হবে। এই প্রমিত ভদ্রলোকিয় চৌর্যবৃত্তির আবহাওয়ায় বিদ্যাসাগর মশাই ভাষাকে উদ্ধার করছেন যবনী মিশেল থেকে। এক্কেবারেই ভদ্রলোকিয় প্রকল্প। তিনি যখন বুঝলেন, তখন তার জীবনীশক্তি শেষ। তার জীবনের সেরা সময় দিয়ে গিয়েছেন অকালকুষ্মাণ্ড ভদ্রদের জন্যে যারা তাকে মাথায় করে রাখল, কিন্তু তার জীবনযাত্রাটা নিল না।
No comments:
Post a Comment