ভারতের অঙ্ক
দর্শন এবং ইতিহাসকার চন্দ্র কান্ত রাজুর দারুণ একটা দুপাতার হিন্দি প্রবন্ধ দলিত
ঔর বিজ্ঞান। যদিও আমরা পশ্চিমি মতে ভারতীয় ইতিহাসে যুগ বিভাজনে বিশ্বাস করি না,
বলতে পারি প্রাচীন থেকে মধ্যযুগে বাংলার দলিতেরা শুদ্ররা মূলত তান্ত্রিক, বৌদ্ধ,
এবং পরে ইসলামি রাজত্বের অংশ হয়ে ঈর্ষনীয় বৌদ্ধিক, কৃষ্টিগত এবং অকেন্দ্রিভূত উৎপাদনভিত্তিক
বিশ্বজোড়া বাণিজ্য বিকাশের স্তরে পৌছে ছিল। রাজুজী তাঁর কালচারাল ফাউন্ডেশন অব
ম্যাথেমেটিক্স শুরুই করছেন আর্যভট(এই নামের বুৎপত্তি নিয়ে কয়েকদিন আগেই একটা
প্রকাশনা দিয়েছিলাম। আশাকরি সেটি মাথায় রয়েছে – শুধু বলি, ক্ষমতায় থাকা মানুষজন
যখন আর্যভটকে সুচতুর ভাবে আর্যভট্ট বলতে শুরু করে, সেই উচ্চারণকে পাঠ্যপুস্তকের
অংশ করে দেন তখনই ইতিহাসকে নতুন করে দেখতে হয়)এর জ্ঞানচর্চার অবদান দিয়ে। তিনি
বিলছেন, আর্যভট used a numerical technique of
solving differential equations to compute precise sine values। আজও মঙ্গলে চন্দ্রযান
পাঠাতে সেই পদ্ধতিতেই গণনা করতে হয়। এবং আর্যভট প্রথম গোল পৃথিবীকে তুলনা করেছেন কদম্বের
সঙ্গে তাঁর গোলধ্যায়৭এ।
গত কয়েক দশকে
ঔপনিবেশিক পশ্চমি লুঠেরা বড় পুঁজি নির্ভর কেন্দ্রিভূত প্রযুক্তি/বিজ্ঞানকে উচ্চতর
বিশ্বজ্ঞনের শ্রেণীতে ফেলে ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানকে দেশজ জ্ঞান হিসেবে দাগিয়ে
দিয়েছে এবং এটি আমরা সোনা মুখে মেনে নিয়েছি, ঠিক যেমনভাবে ভুলে ভরা পশ্চিমে কলণবিদ্যাকে
উচতর জ্ঞানার্জন বলা হয়েছে। এই যুক্তিতে বলা হচ্ছে নিম্নবর্ণের ভাগ্যভাল তাঁরা এই
উচ্চজ্ঞানচর্চার বেদীতে আরোহন করছেন। অর্থাৎ কেউ কেউ সফল হচ্ছেন মাত্র, সেটি নিয়ম
নয়। কিন্তু ভারতে আর্যভট একমাত্র অউচ্চবর্ণ ছিলেন না। বলা যাবে না তিনি দলিত
হিসেবে ভারতীয় জ্ঞানচর্চায় ব্যতিক্রম ছিলেন। ঠিক তাঁর পাঁচ দশক পরে আবির্ভূত
হয়েছিলেন দ্বিতীয় আর্যভট। কৌসাম্বী বা আম্বেদকরের মতে এই সময়ে কিন্তু মনুস্মৃতি
সঙ্কলিত হচ্ছিল। তবুও কিন্তু দ্বিতীয় আর্যভট তৈরি হয়েছিলেন। আর পঞ্চম শতের পাটনার আর্যভটের
অনুগামী হিসেবে ১৫শ শতে এলেন দক্ষিণ ভারতের উচ্চতম জাতের নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ,
যিনি আর্যভট পদ্ধতির অঙ্কবিদ্যাকে চারিয়ে নিয়ে গেলেন নতুন উচ্চতায়। নীলকান্তের
পুঁথি শীর্ষক সোমস্তুভমএ তিনি আর্যভট সম্বন্ধে ভাষ্য লিখছেন। আমাদের নতুন করে
ঔপনিবেশিক সময়ের তৈরি করা বিভাগকে নতুন করে ভাঙ্গার চিন্তা করতে হবে যেখানে বলা
হয়েছে ভারতের জ্ঞানচর্চায় দলিতদের স্থান ছিল না, এবং দুস্তর ভৌগোলিক ব্যবধান ছিল
বিন্ধ্যর দুপাশে।
ভারতে জাতিভেদ একটা
বাস্তব কাঠামো। সেটা যেমন বাস্তব, তেমনি ভারতীয় জ্ঞানচর্চায়, উতপাদন-বিতরণ
ব্যবস্থায় অউচ্চবর্ণের, দলিতদের অবদান উচ্চবর্ণদের থেকে অনেক বেশি। সেটা আরও ঘোর
বাস্তব। গত প্রকাশনায় বাংলার উৎপাদন-বিতরণ, জ্ঞানচর্চার পরিবেশ বর্ণনাতে তা কিছুটা
চুম্বকে বলা গিয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা এবং তার ধ্বজাধারীদের জ্ঞানচর্চায় নব্য
পশ্চিমি জ্ঞানচর্চকদের সূত্রে ভারতে এক্কেবারে অন্য ধরণের জাতিবাদী আখ্যান তৈরি
হল। যে ভিত্তিভূমি গড়ে গিয়েছিলেন পূর্বের অব্রাহ্মণ জ্ঞানতাত্ত্বিকেরা, সেই
ভিত্তিভূমিকে অস্বীকার করার প্রবণতা শুরু হল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ছাতায়।
তাঁর জ্বলন্ত
উদাহরণ হয়ে উঠলেন আর্যভট। তাঁর জাতি চরিত্র পালটে ফেলার উদ্যম গ্রহণ করা হল। নামের
বানান উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে পাল্টে দিয়ে তাঁকে দেখানো হল ব্রাহ্মণ রূপে। ব্রহ্মগুপ্ত
কিন্তু তাঁর গুরুর নাম আর্যভট লিখেছেন অন্তত একশ বার তাঁর রচনায়। যে মানুষটি পাইএর
মান নির্ণয় করলেন, দশমিক ব্যবস্থাকে জোর ভিত্তি দিলেন, আর্ভটিয়া লিখলেন, আল
খোয়ারজমি যার নাম উল্লেখ করেছেন তাঁর রচনায়, যিনি সাইন(জ্যা), কোসাইন(কোজ্যা),
ভারসাইন(উতক্রমজ্যা), ইনভার্সসাইন(অতক্রম জ্যা), সাইন নামতা(টেবল) নয়, দশমিকের পরে,
শুন্য থেকে নব্বই ডিগ্রি পর্যন্ত ৩.৭৫ ডিগ্রি অন্তরে ভার্সসাইন (1 − cos x) তালিকা সঠিক চার সংখ্যা পর্যন্ত
গণনা করেছিলেন, আজও মঙ্গলগ্রহে উপগ্রহ পাঠানো হয় আর্যভটের অঙ্ক কষার পদ্ধতিতে, সেই
মানুষটার জাতি চরিত্র পাল্টে দিলেন আধুনিক ভারতের জ্ঞানচর্চকেরা।
No comments:
Post a Comment