ইওরোপিয় এবং ইওরোপবিদ্য মানুষদের তৈরি ইতিহাস সূত্র মোটামুটি জন সাধারণের ধারণা হয়েছে, লন্ডনের রাস্তায় ডাকাবুকো ভবঘুরে সন্তানেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে এদেশে আসত। পোড়া ভারতীয় উপমহাদেশে কেইবা মরতে আসে। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য বলছে, ভারতের লোভনীয় কোম্পানির চাকরির জন্য মুখিয়ে থাকতেন লন্ডনের উচ্চবংশের মানুষেরা।
এই প্রবন্ধের প্রথম অংশে দেখব কোম্পানির চাকরির শর্তাবলী; আর দ্বিতীয় অংশে কর্নওয়ালিসের সময় কারা কারা চাকরি পেয়েছেন তাঁর একটা তালিকা।
--
১৬০০ সালে প্রথম এলিজাবেথের আমলে ভারত এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে নিরঙ্কুশ ব্যবসার ফর্মান পেয়ে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, মালয় অঞ্চল থেকে ব্যবসা শুরু করলেও, পরের দিকে মূলত ভারতকে তাদের ব্যবসার ঘাঁটি তৈরি করে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যবসা দেখাশনার কাজে প্রয়োজন ছিল বিপুল পরিমান কর্মচারীর, যারা সরাসরি কোম্পানির খাতায় বেতন ভুক্ত হয়েই থাকত। ভারতে কোম্পানির চাকরির নিম্নতম পদটির নাম ছিল রাইটার বা শিক্ষানবিশ। বয়স হত মোটামুটি ১৪ থেকে ১৭র মধ্যে আর সাধারণ অঙ্ক আর ব্যবসায়িক খাতাপত্র কিভাবে রাখার মোটামুটি জ্ঞান রয়েছে – এমন বালকেরা এদেশে কোম্পানির চাকরি করতে আসার ছাড়পত্র পেত। বিবাহিত হলেও আপত্তি ছিল না। বিবাহিতদের স্ত্রী নিয়ে আসার অধিকার ছিল। লন্ডনের ব্যবসায়িক পরিবারের ছোট ছেলেরাই সাধারণত এই অসীমতম লাভজনক চাকরিতে নিযুক্ত হত। তবে সরাসরি কোম্পানির অংশিদারের নিকট আত্মীয় এই চাকরিতে বহাল থাকতে পারত না – কিন্তু লন্ডনের ধনীরা তাদের সন্তানদের জন্য সবার আগে ভারতে চাকরির জন্য উমোদরি করা শুরু করত কোম্পানির অংশিদারদের আমদরবারে।
কোম্পানির চাকরিতে উন্নতির মোটামুটি গতে বাঁধা রাস্তা ছিল। ভারতে আমলাতন্ত্র নিয়ে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা পর ১৭০৬ সালে কোম্পানির যে আমলাতান্ত্রিক পরিকাঠামো তৈরি হয়, তা বজায় ছিল প্রায় দেড়শ বছর, ভারত জাতীয়করণ না হওয়া পর্যন্ত। পাঁচ বছর রাইটার পদে শিক্ষানবিশী করার পর পরের তিন বছর জুনিয়র মার্চেন্ট পদে চাকরি। তার পরে চাকরির সব থেকে উঁচু পদ সিনিয়র মার্চেন্ট। চাকরির মেয়াদকালের ওপর নির্ভর করত পদন্নোতি। সব থেকে প্রবীন সিনিয়র মার্চেন্ট প্রবেশাধিকার পেত ফ্যাক্টর কাউন্সিলে – যারা আসলে আঞ্চলিক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করত – এক একটা এলাকার ব্যবসার ঘাঁটিকে বলা হত ফ্যাক্টরি বা কারখানা। বিশেষ উদ্যমী/বুদ্ধিমানেরা কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের পদেও নির্বাচিত/মনোনীত হতেন।
চাকরি বিষয়ে ১৭৭১ সালে কলকাতায় এক শিক্ষানবিশ তাঁর বাড়িতে লিখছে, pays in general great regard to seniority of service… and indeed in the service here supercessions [sic] are not common. In an office if one is put over the rest all those are provided for and nobody serves under his junior। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার আগে তাদের এদেশের সব ঋণ মিটিয়ে দিতে হত। এঁদের সক্কলকে কোম্পানির নিয়ম মেনে চলতে হত। লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁরা ব্যক্তিগত ব্যবসা করতেন বটে কিন্তু সে ব্যবসা কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসাকে বিপদে ফেলে নয়। এঁরা মাইনে পেতেন, কিন্তু তা তাদের রোজগারের ছোট অংশ ছিল – বড় রোজগার ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসা। কোম্পানি এই বেআইনি ব্যবসাকে মান্যতা দিয়েছিল। তবে যে সব পণ্য ছিল কোম্পানির মূল রোজগারের বাহন, যেমন ভারতীয় কাপড়, বা মসলা ইত্যাদির ইওরোপ-এশিয় ব্যবসা করা যেত না। কিন্তু আন্তঃএশিয় ব্যবসায় তাঁরা অংশগ্রহণ করতে বাধা ছিল না। তাতে কোম্পানি আর ব্রিটিশ রাষ্ট্রের দুমুখো সুবিধে ছিল ১। বিভিন্ন বন্দরে সেই পণ্যগুলির কর দিতে হত ২। উদ্বৃত্ত ফিরে আসত লন্ডনেই, যা সেদেশেই বিনিয়জিত হত।
--
অষ্টাদশ শতকে ভারত তথা কলকাতায় রাইটারের চাকরি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। এ তথ্য পাচ্ছি আর্থার এসপিনাল, কর্নওয়ালিস ইন বেঙ্গল পুস্তকে। আজও ভারতে ধারণা রয়েছে লন্ডনের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ঝড়তি পড়তি ডাকাবুকো যুবকেরাই ভারতে নির্বাসিত হতেন কোম্পানির কাজে। অথচ এসপিনালসহ অনেকের কাজে এবং তত্কালীন নানান নথি সাক্ষ্যে প্রমাণিত এর থেকে বড় মিথ্যে আর কিছু হয় না। ১৮৩০ সালেও প্রখ্যাত ব্যারন অথবা ব্যারনেটদের পুত্ররা কলকাতায় জাহাজঘাটায় নামত রাইটাররূপে।
এসপিনাল বিশদে সে সময়ের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের আত্মীয়দের কথা বিশদে উল্লেখ করেছেন। অন্যতম প্রধাণ ও প্রখ্যাত আমলা জি এফ গ্রান্ট সাতবছর সেনা বাহিনীতে চাকরি করে রাইটাররূপে কর্মজীবন শেষ করেন। কর্নওয়ালিসের অন্যতম প্রধান জেলা অফিসার টমাস ল(১৭৫৬-১৮৪৬), ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড এলিনবরোর তুতো ভাই কার্লাইলের বিশপএর পুত্র। ১৭৮৯তে জেলা কালেক্টরের পদ থেকে কয়েক বছর পর গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলে উন্নীত হওয়া পিটর স্পিকি, প্রখ্যাত ক্যাপ্টেন স্পিকির পুত্র। কর্নওয়ালিসের সময়ের অন্যতম কালেক্টর সি এইচ পুরলিং কোম্পানির এক ডিরেক্টরএর পুত্র। ত্রিহুতের কালেক্টর রবার্ট বাথরাস্ট, নরউইচএর বিশপের ভাই। ১৭৭২এ ভারতে আসা রবার্ট লিন্ডসে, আর্ল অব ব্যালকারেসের পুত্র। কাউন্সিলের অন্যতম মেম্বর, চার্লস স্টুয়ার্ট(১৭৪৩-১৮২১) লর্ড ব্ল্যানটাওয়ারের কনিষ্ঠ পুত্র।
এসপিনাল তাঁর পুস্তকে, তত্কালীন প্রখ্যত এক পত্রিকা, আলেকজান্দারের ইস্ট ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনএর ১৮৩৪এ একটি প্রবন্ধ উল্লেখ করছেন, অন দ্য নাম্বার অব রাইটার্স এপয়েন্টেড ফ্রম হোম ইন দ্য লাস্ট ফাইভ ইয়ার্স থ্রি অয়ার সন্স অব নোবলম্যান, ৮ ওয়ার ব্যারোনেটস সন, ২১ সনস অব ক্লারজিমেন, ৫৬ সনস অব কোম্পানিজ সিভিল সার্ভেন্টস, ৭৪ সনস অব অফিসার্স ইন দ্য কোম্পানিজ আর্মি, ৩৭ সনস অব অফিসার্স ইন হিজ ম্যাজেস্টিজ আর্মি অর নেভি, ১৪৫ সনস অব মার্চেন্টস, ব্যাঙ্কার্স, প্রফেসনাল মেন, এন্ড ডেন্টলমেন অন্ড এইট সনস অব ডেরেক্টর্স। নীলকর, ধাতু ব্যবসায়ী, কোম্পানির অংশিদার হেস্টিংসের বন্ধু পার্লামেন্টারিয়ান জন প্রিন্সেপের দুই ছেলে থবি আর জেমস প্রিন্সেপ ভারতে চাকরি করতে আসেন। জেমস প্রিন্সেপ প্রখ্যাত হন কমলাকান্ত বিদ্যালঙ্কারেরমত পণ্ডিতের সাহায্য নিয়ে(না পুরো কাজটি কমলাকান্ত করেছিলেন?) খরোষ্টি আর ব্রাহ্মী লিপির রহস্য ভেদ করায়। কলকাতায় তাঁর নামে একটি স্মৃতি স্তম্ভ আর ঘাট রয়েছে। জেমসের ভাই থবি, রাইটার থেকে কোম্পানির উচ্চপদস্থ আমলা হন।
No comments:
Post a Comment