রিচারিয়াজীর সাক্ষাৎকার১
ক্লদ আলভারেজঃ
ধান বিষয়ে আপনার কাজ কিছু বলুন।
রিচারিয়াঃ যেখানে
যখন কাজ করেছি, সেখানে যে ধান পেয়েছি তা সংগ্রহ করা আমার নেশা ছিল। তার বৈচিত্র
আমায় মুগ্ধ করত। ধান আমার ভালবাসার বিষয়।
যেই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত, তাকেই আমি নতুন ধান দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতাম। ১৯৫৯
পর্যন্ত বিহারে এবং তার পরে কটকে এসে এইভাবে আমি প্রচুর ধানের প্রজাতি সংগ্রহ করি।
এখানে আমি তাইওয়ানের ৬৭টা প্রজাতি নিয়ে কাজ শুরু করি। দেখলাম একটা দুটো স্তবকে
বেঁটে ধান হচ্ছে। সেগুলি নিয়ে বেশ উতসাহিত হয়ে পড়ি। ৬৭টির মধ্যে দুটো বা তিনটে
নিয়ে শুরু হল তাইচুং নেটিভ ১(টিএন১)এর জয় যাত্রা। আমিই প্রথম ব্যক্তি, যে এটি
দেখি। এগুলি নিয়ে মাঠেই গবেষণা শুরু করি। এর মধ্যে একটি দেখলাম রোগ আর পোকা থেকে
বেঁচে যাচ্ছে।
ক্লঃ কিভাবে
আন্তর্জাতিক ধান্য গবেষণা সংস্থা, কেন্দ্রিয় ধান্য গবেষণা সংস্থার এই কাজটি চুরি
করল? কেননা আপনি সে সময় ধানে প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ। আন্তর্জাতিক ধান্য গবেষণা
সংস্থার নির্দেশক রবার্ট শ্যান্ডলার যখন চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন, তখনও তিনি একটাও ধান
গাছ দেখেন নি।
রিঃ আন্তর্জাতিক
ধান্য গবেষণা সংস্থা শুরু হয় ১৯৬২ সালে। শ্যান্ডলার কটকে আসতেন বৈজ্ঞানিক হিসেবে।
আমি তাঁকে ঘুরিয়ে সব দেখাই। যখন তাঁকে আমি মাঠে নিয়ে বল্লাম, ‘এই প্রজাতিটা প্রতি
একরে ৯০০০পাউণ্ড ফলন দেয়, এবং পোকাও লাগে না।’ এখানেই আমার ভুল হয়েছিল। আমি তাঁকে
সব বিশদে না বললেই পারতাম। তার উত্তরে তিনি জানালেন এটি সাধনার ব্যাপার। আমি বললাম
সেই কাজটি আমি করে ফেলেছি। তিনি সেই তথ্য টূকে নিলেন।
শ্যান্ডলার
দিল্লি ফিরে গিয়ে কেন্দ্রিয় ধান্য গবেষণা সংস্থাকে আইআর৮ আর টিএন১ নিয়ে কাজ করতে
বললেন। বললেন এই দুটি প্রজাতি ভারতে কৃষি বিপ্লব এনে দেবে।
সেই সময় আমি কৃষি
ভবনে ধান কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। ড বি পি পাল আমাকে জানালেন দুপুরে খাওয়ার সময়
তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন। রকফেলার ফাউন্ডেশনের ড কামিন্সও সেই বৈঠকে ছিলেন –
যদিও তিনি সদস্য ছিলেন না। ড পাল আমার বললেন যদি কামিন্স আমাদের কথাবার্তায় থাকেন
তাহলে কেমন হয়। ড পালের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, তিনি টিএন১কে
আন্তর্জাতিক ধান্য গবেষণা সংস্থাকে দিচ্ছেন। তাঁরা সেটি নিয়ে ভারতে চাষ করাবেন।
আমি বললাম ড পাল আপনি ভুল করছেন। এটি এখনও মাঠে যাবার জন্য তৈরি নয়। রোগ পোকার
আক্রমণ থেকে এটি এখনও বাঁচবে না। আর প্রচুর ভাইরাস রয়েছে এতে। এর বীজ নিয়ে যদি
আপনি চাষ করতে শুরু করেন, তাহলে জমিগুলোর
ভাইরাস ছড়িয়ে যাবে। আমি যে মাঠে চাষ করছি, তাতেও প্রচুর ভাইরাস দেখাতে পারি
আপনাকে। তিনি বললেন কি আর করা যাবে – এটাকে ওরা বিমানে করে আমাদের উপহারস্বরূপ
পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি জানালাম আমি এই সিদ্ধান্ত মানছি না। আমি এই ধান আমদানি করার
বিরোধী।
ক্লঃ কিভাবে আপনার
কাজে শ্যান্ডলার মাথা গলাতেন?
রিঃ আরেকবার তিনি
সিআরআরাইএর ৩১১ প্রজাতিটি এনেছিলেন – এটিও রোগে ভর্তি আর পোকা লাগার সম্ভাবনা ছিল।
আমার অনুমতি ছাড়াই তিনি এটি আমার কর্মচারীকে দেন। তখন আমরা সিআরআরাইতে সেমিনার
করছি। ফিলিপিন্সের বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক আমার ডাকে এসেছিলেন। তিনি কর্মচারীদের
নির্দেশ দেন এর একটি গোছা সিআরআরাইতে থাকবে অন্যটি কোর্ডিনেটেড রাইস রিসার্চ
সেন্টার, হায়দ্রাবাদে যাবে।
সেদিন শ্যান্ডলার
বিমানে করে ফিরে যাচ্ছেন। আমি তার সঙ্গে বিমানবন্দরে সৌজন্য সাক্ষাৎকার করতে যাব। গাড়িতে উঠছি, আমার এক
কর্মচারী এসে আমায় একটি প্যাকেট দিল; আর একটি দিল ড ফ্রিম্যানকে দেওয়ার জন্য,
তিনিও শ্যান্ডলারের সঙ্গে বিমানে যাবেন। ড ফ্রিম্যান তখন হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রটির
দায়িত্বে। তখন বুঝলাম, আমায় অন্ধকারে রেখে ভাইরাসে ভর্তি প্রজাতিটি আইআরারআই থেকে
ভারতকে দেওয়া হল।
আমি তখন আমার
অধস্তনকে বললাম সে একজন বিদেশীর হাত থেকে কি করে এটি নিয়ে ভাগ করল এবং দুজনের জন্য
প্যাকেট করল? যাইহোক আমি প্রশ্ন করলাম সে কি এটির জন্য কোয়ারেন্টাইন শংসাপত্র
নিয়েছে? কেননা আমরা এই শংসাপত্র ছাড়া কোনো জীবিত গাছ আমদানি করতে পারি না। সে বলল,
না।
আমি বিমানবন্দরে
গিয়ে শ্যান্ডলারকে বললাম আমার অজ্ঞাতে আপনি এরকম বহু প্রজাতি আমার কর্মচারী মার্ফত
আমার কেন্দ্রে আর হায়দ্রাবাদে পাঠিয়েছেন। এইগুলির কোয়ারেন্টাইন শংসাপত্র আমি চাই।
তিনি বললেন, আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি আপনার দেশে ভাইরাস ছড়াতে এসেছি? আমি বললাম,
আমি ভাইরাসের প্রশ্নটিই তুলিনি। আপনি তুলেছেন। আমি শুধু শংসাপত্র চেয়েছি। আমাদের
দেশের আইন অনুযায়ী এই শংসাপত্র ছাড়া কোন গাছ গাছালি আমদানি করা যায় না। তাঁর কাছে
কোন কিছু ছিল না। তিনি চলে গেলেন।
আমার কর্মচারী(এক
বা দুজন)দের হাত করে ঘুষ দিয়ে আইআরারআই আমাদের থেকে বহু তথ্য চুরি করেছে যাতে
তাঁরা ধান বিশ্বে এগিয়ে থাকতে পারে।
পরে শুনেছিলাম
শ্যান্ডলার সরাসরি কৃষি মন্ত্রীকে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছিলেন, আমি থাকলে
তাঁরা ভারতে কাজ করবেন না। কৃষি মন্ত্রী ছিলেন সি সুব্রহ্মনিয়ম আমায় অবসর নিয়ে
নির্দেশ দেন। ক্যাবিনেট সেক্রেটারি, পূর্বতন কৃষিসচিব শিবরামন ছিলেন আমার বন্ধু।
তিনি মন্ত্রীকে বলেন, রিচারিয়া সিআরআরআই নিজের হাতে তৈরি করে গড়ে তুলেছেন। আমরা
তাঁকে এখুনি অবসর নিতে বলতে পারি না। তাঁকে ভাল হয় সদ্য শুরু হওয়া রাইস
ডেভেলাপমেন্ট কাউন্সিলে বদলি করা হোক।
শিবরমন আমায়
মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। তার পিএকে বললাম। আমার সাক্কাতকারের সময় হল তার
বাড়িতে সকাল সাড়ে ছটা থেকে সাতটা। পৌছলাম। চুপচাপ। একজন ঘর পরিষ্কার করছেন। তাঁকে
বললাম মন্ত্রীমিহাশয়ের সঙ্গে আমি দেখা করব। তিনি ভেতরে গেলেন। আমি ঢুকলে
মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘প্রথমে আপনি বলেছেন তাইচুং ভাল জাতের ধান। আজ আপনি বিরোধিতা
করছেন? আমি বললাম, আমি একটি বিশেষ প্রজাতির একটির কথা বলেছিলাম। কিন্তু আপনি যদি
বিদেশ থেকে বাছাবাছি না করে ডাঁই করে ধানের বীজ আনেন, তাহলে সেগুলি আমাদের দেশের
ধানের প্রজাতিগুলি ধ্বংস করে দেবে। সেগুলিতে সেই ধানের ভাইরাস লাগবে আর পোকা খেয়ে
ফেলবে। আমি যেটি তৈরি করেছি সেটি আলাদা। তিনি তখন আমায় বললেন, আমি কিছু জানি না,
রফেলাররা যেগুলি পাঠিয়েছে সেগুলি আপনাকে নিতেই হবে। আমি বললাম আমি পারব না। আমি
দোষের ভাগী হতে পারব না। কেউ যদি প্রশ্ন করে এই সংস্থার নির্দেশক এই প্রজাতিটি
ভারতে এনেছিল – সেই দায় আমি নিতে পারব না।
No comments:
Post a Comment