কয়েকদিন আগেই
পড়ছিলাম সঞ্জয় পাসোয়ানের কালচারাল ন্যাশনালিজম এন্ড দলিত বইটি। আমরা, বঙ্গীয়
পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ বা গঠিত হতে চলা উইভার, আরটিজান ট্রাডিশনাল
আর্টিস্টস গিল্ডের সদস্য, যারা গ্রামজ উতপাদন ব্যবস্থা, প্রযুক্তি আর সংগঠন বিষয়ে
অল্পস্বল্প নজর দিয়েছি। আমাদের পথচলা দর্শনের সঙ্গে, এই বইটির ভাষ্য কিছুটা হলেও
মিলে যায়। তাঁর বক্তব্য ব্রিটিশ উপনিবেশপূর্ব সময়ে ভারতে দলিতদের অবস্থান খুব
খারাপ ছিল না – এই ভাষ্যে কিন্তু তিনি জাত ব্যবস্থায় কোনভাবেই উচবর্ণের অবস্থান
সমর্থন করছেন না - আমরাও। তিনি বাল্মিকী, বেদব্যাস, কবীর থেকে রবিদাসের জীবনী
আলোচনা করেছেন। দক্ষিণের এজাভা পরিবারের নারায়ণ গুরুর কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। আমরা
এখানে বাংলার নানান সম্প্রদায়ের কথা বলতে পারি। সঞ্জয়জী জোর দিচ্ছেন এডাম সমীক্ষার
বাংলা-বিহারের শিক্ষা ব্যবস্থার তথ্যে, যেখানে তথাকথিত বর্ণাশ্রমের উপরের দিককার
মানুষদের থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক-ছাত্র ছিলেন দলিত মানুষেরা।
আজ ভারতে দলিত
আন্দোলন নতুন উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে। অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াইটা তো করতেই হবে, তার আগে
প্রয়োজন আমার কি ছিল, সে বিষয়ে নিরন্তর আলোচনা, যার একটি ঝাঁকি আমরা সঞ্জয়
পাসোয়ানজীর বইটিতে পেয়েছি, নিজেরা আলোচনা করছি পরম নামক এক চটি মাসিক পত্রিকায়। কি
হারিয়েছি, তার হাহুতাশ তো আছেই। কিন্তু যে কেন্দ্রিভূত দর্শনের জাতিবিদ্যা তৈরি
হয়েছে ভারতে বিগত কয়েক শতক ধরে ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চায়, তাকে সবার আগে প্রশ্ন করতে
হবে। হাজার হাজার বছর ধরে বিকেন্দ্রীভূত, বৈচিত্র্যময়, আসাধারণ এক সভ্যতার
ভিত্তিভূমি গড়ে তুলেছেন মূলত দলিতেরা – তাই ভারত সভ্যতা শুদ্র সভ্যতা – দলিত
সভ্যতা – এটা বলতে হবে। তাঁরাই পারেন কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে নিজেদের দর্শন দিয়েই প্রশ্ন
করতে। বড় পুঁজির দর্শনের ভেতরে দাঁড়িয়ে তা হয়ত হবে না। নতুনভাবে দেখতে হবে বড়
পুঁজি ভিত্তিক লুঠেরা পশ্চিমি গণতন্ত্র, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্বের ভিত্তিকে – নিজেদের
তৈরি পঞ্চায়েতি গণতন্ত্র, নিজেদের বিকশিত জ্ঞানচর্চার মহিমা দিয়ে। ভারতে তৃণমূল
স্তরে আজও সেই দর্শনে টিকে থাকার উদ্যম রয়েছে।
দুঃখের বিষয় সেই
উদ্যমের অভাব রয়েছে ইংরেজি শিক্ষিতদ দলিত নেতৃত্বের মধ্যে। তাঁদের অধিকাংশই বড়
পুঁজির তৈরি করা বিজ্ঞনের অংশ হতে চান, হতে চান এই উৎপাদন ব্যবস্থার একটি শৃঙ্খল।
বিনীতভাবে বলার চেষ্টা করব শিক্ষিত দলিত নেতাদের এই তাত্ত্বিক অবস্থানে বড় পুঁজিরই
লাভ – যখন তাঁরা বলেন ‘একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে সমাজ
ও সভ্যতায় অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটেছে। সমাজের সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রও
প্রসারিত হয়েছে বহুল্যাংশে। আজ প্রত্যন্ত-অজপাড়াগাঁয়ে বসবাসকারী নিতান্ত আখ্যাত,
হত-দরিদ্র মানুষও আগামী দিনে উন্নত সভ্যতার সংস্পর্শে এসে নিজের জীবন গড়ার স্বপ্ন
দেখে... ইত্যাদি(সমাজ বিপ্লবে মতুয়াধর্ম, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, সঙ্ঘাধিপতি, মতুয়া মহা
সংঘ, শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর স্বর্ণ-সংকলন, পাতা ১৭)’। এ নিয়ে এখন তর্কে প্রবেশ করব
না। তোলা রইল।
ভারতকে দলিত
সভ্যতা বলতে গেলে নিজেদের জোরের জায়গা, কেন আমরা আলাদা, আমরা কি গড়ে তুলেছিলাম,
সেটা জানাতে হবেই। ‘উন্নত সভ্যতা’বিশিষ্ট ‘একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই চরম
উৎকর্ষের’ কেন্দ্র বড় শরিকের দর্শনের অনুবর্তী হয়ে হাতেগোণা মানুষ হয়ত স্বচ্ছল
থাকতে পারবেন, পিঠ চাপড়ানি পাবেন, কিন্তু নিজস্ব সভ্যতার যে পরিচয় গড়ে উঠেছিল কয়েক
সহস্র বছর ধরে, সেই পরিচয় তৈরি হবে না।
No comments:
Post a Comment