Thursday, February 11, 2016

উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা: কৃষি লুঠ কথা


রিচারিয়াজীর সাক্ষাৎকার২
ক্লঃ ডাঁই করে ধানের বীজ আনার সমস্যা কি ছিল?
রিঃ সেগুলি ভাইরাস আর পোকা মুক্ত হবে না। আপনি বিপুল পরিমান আমদানি করতেই পারেন – সেগুলি নির্দিষ্ট রাসায়নিকে প্রক্রিয়া করে নিতে হবে – দেখে নিতে হবে তাতে কোনও জীবানু, রোগ বা পোকা রয়েছে কি না তাঁদের দাবি তাঁরা তা করেই পাঠায়। তবুও সেগুলিতে পোকা লাগার আশংকা থাকে। বিশেষ করে নতুন পরিবেশে এসে, নতুন রোগ, নতুন পোকা লাগার প্রচুর স্মভাবনা থেকেই যায়। ফলে সেই প্রজাতি চাষ করলে দেশে সেই রোগ, বা ভাইরাস ছড়িয়ে গিয়ে দেশের প্রজাতিগুলো নষ্ট করে দিতে পারে। এরকম করেই টুংগ্রো ভাইরাস এদেশে এসেছিল।
ক্লঃ মানে, জেনেশুনে এমন কোন প্রজাতি এদেশে নিয়ে আসা যায় যাতে নির্দিষ্ট কোন ভাইরাস ধরতে পারে?
রিঃ টিএন১ আর আইআর৮ তাঁরা জেনেশুনেই এদেশে নিয়ে এসেছিল। তারাও তো ধান বিশেষজ্ঞ।
ক্লঃ আপনি যে তাইচুং প্রজাতি চাষ করেছিলেন, আর তাঁরা যেটি নিয়ে এসেছিল, এই দুটির মধ্যে পার্থক্ত কি ছিল?
রিঃ আমি যেটি বেছেছিলাম, সেটি ভাইরাস, পোকা আর রোগ প্রতিরোধক ছিল। যখন বীজ বিপুল পরিমানে আসে, সেগুলি সমমানের(হেটারোজিনিয়াস)হয় না। তার থেকে আমাকে বেছে নিতে হবে, কোনটা আমি চাইছি। এই রকম হাজারো তাইচুং গাছের মধ্যে কয়েকটা আমি বেছেছিলাম। সেগুলি চাষ করেছিলাম। আর আপনি যদি গোটা বস্তার বীজ একসঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করেন তাহলে ভাল খারাপ তো একসঙ্গে মিশে যাবে।
ক্লঃ তার মানে সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে এটির ভারতে আগমন।
রিঃ মোটামুটি এই সময়েই এসেছিল। আমিই প্রথম মানুষ যে আবিষ্কার করি, বিপুল পরিমানে বিদেশ থেকে আসা বীজ বেছে বেছে ব্যবহার না করলে, এবং এই বীজের সঙ্গে আসা ভাইরাস(যেমন টুংগ্রো বা ট্রানজিটরি) অবাধে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের দেশের উতপাদনের হারের ওপর প্রভাব ফেলবে। আজ দেশিয়(এক্সটিক) প্রজাতির মধ্যে বেঁটে গাছগুলি চাষ হচ্ছে।
ক্লঃ আমাদের মনে রাখতে হবে, আমেরিকা, যে দেশে ধান হয়ইনা বলা চলে, সেই দেশ আমাদের দেশের ধান গবেষণা আর কোটি কোটি জণগনের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করল।
রিঃ এইভাবেই তাঁরা জেতে। যদি সিআরআরআই কাজ করতে পারত, তাহলে কোটি কোটি ডলার ঢেলে  আইআরআরআইএর তৈরি করার কোন মানে ছিল? তারা এমন একটি দেশের খোঁজ করছিল, যেখানে তাঁরা নিজের ইচ্ছে মত কৃষি গবেষণা নিয়ন্ত্রণ আর ইচ্ছে মত ধানের প্রজাতি চাষের কাজে ইন্ট্রোডিউস করতে পারবে। প্রথমে তাঁরা রকফেলার ফাউন্ডেশন ট্রাস্টকে কেন্দ্রিয় ধান গবেষণা কেন্দ্রকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, যাতে তাঁরা সেটি বিলয় করে ভারতে আন্তর্জাতিক ধান্য গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। আমি তখন সদ্য  কেন্দ্রিয় ধান গবেষণা কেন্দ্রতে যোগ দিয়েছি।
যখিন এই বিষয়টা  আমার কাছে এল, তখন আমি এর বিরোধিতা করেছিলাম, যে ভারতে এরকম আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা অস্বাস্থ্যকর উদাহরণ হবে, কেননা, এতে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আমার প্রস্তাব ছিল কেন্দ্রিয় ধান গবেষণা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ নিরপেক্ষ সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠুক, একে রকফেলারদের হাতে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না। যতই হোক এটি একটি বেসরকারি সংস্থা। সে সময় ভারত সরকারেরও এই মত ছিল। এর পরে ১৯৬০ সাল নাগাদ এটি ম্যানিলায় নিয়ে যাওয়া হল। কেন্দ্রিয় ধান গবেষণা কেন্দ্র কিন্তু ভাল কাজ করছিল। দেশিয় প্রজাতিগুলি থেকে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে সেগুলির উৎপাদন হার ৩০-৪০ শতাংশ বাড়ানোর কাজ করেছিলাম। আরও অন্যান্য কাজ করছিলাম  - যেমন আইসোটপ দিয়ে ইত্যাদি।হঠাত আমাদের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। সমস্ত উদ্যম গিয়ে নিহিত হল উচ্চফলনশীল বীজ তৈরির কাজে – টিএন১ আর আইআর৮এর বেঁটে প্রজাতি ব্যবহার করে, যেগুলিতে বেশি বেশি সার লাগে। এগুলির সঙ্গে আমাদের দেশের নানান বীজ মিশিয়ে নতুন উচ্চ ফলনশীল বেঁটে ধান গাছের বীজ তৈরি করা হল। তার মেনে যদি  আপনি এই দুই প্রজাতির জিন ব্যবহার না করছেন, তাহলে আপনি উচ্চফলনশীল ধান পাচ্ছেন না। আমরা ভুলে গেলাম এ ধরণের জিন আমাদের নিজেদের দেশের ধান গাছে রয়েছে।
আইসিএআর এই চাপে বেঁকে গেল। আমি কিন্তু আমার বিরোধিতায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এই প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন রবার্ট শ্যান্ডলার। তাদের বক্তব্য ছিল আমাদের যে সব দেশি ধানের জার্মপ্লাজম ছিল তাতে বেঁটে প্রজাতির জিন ছিল না। সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। আপনি এই প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ান তাহলে আপনার চাকরি বাঁচে, আর যদি বিরোধিতা করেন, তাহলে আইসিএআর আপনার পদাবনতি ঘটাবে, আপনার শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে দেবে। আমাকে সেটাই করেছিল।
ক্লঃ তাহলে তাঁরা আপনাকে অবসর নিইয়ে চাড়ল?
রিঃ ১৯৬৬তে আমাকে তিন মাসের নোটিশ দিল – যখন সিআরআরআই পুরোপুরি আইসিএআরএর অধীনে চলে গেল, ৩১ মার্চ ১৯৬৬। ১ জানুয়ারি আমায় নোটিশ ধরাল। যাতে আমি আইসিএআরএ যোগ দিতে না পারি। আমি যদিও আইসিএআরএ যোগদিতে ফর্ম ফিলাপ করেছিলাম। আমার ধারণা ছিল প্রবীণতার দিক থেকে আমার নির্দেশক হব।
আমি ওড়িশা হাইকোর্টে আইসিএআর আর কৃষি মন্ত্রকের বিরুদ্ধে কেস ঠুকে দিলাম। আমার উলিক বলল, এত তারাতাড়ি আমার মক্কেলকে কেন অবসর নোট বলছ? সে যদি আরও কয়েকমাস চাকরি করে সম্মাঞ্জনকভাবে অবসর নিতে পারে তাহলে তোমার আপত্তি কোথায়? তাঁদের কাছে উত্তর ছিল না। আমার একটি মামলায় সরকার দুটি পাখি মারতে চাইল – আমি যদি এই তারিখে অবসর নিই তাহলে তাঁদের লোক স্বামীনাথন নির্দেশক হয়ে বসে। আর আমায় যদি তাঁরা তাড়িয়ে দিতে পারে তাহলে বিনা বাধায় তাঁদের ইচ্ছে মত উচ্চফলনশীল ধানগুলির চাষ তাঁরা শুরু করতে পারে।
দুবছর, তিনবছর, চার বছরেরো বেশি সময় চলে গেল। আমাকে কটক ছেড়ে যেতে হবে। কত দিন আআর আমি নির্দেশকের বাংলো আটকে বসে থাকব? তাঁরা আমার বিরুদ্ধে সমন জারি করবে। এক সময় দেখাগেল জলের লাইন কেটে দিয়েছে। আর কি কি হয়েছে তা না বলাই ভাল। আমার উকিল বললেন বাড়ি ফিরে যান। আমি ওনাকে বললাম, আপনি প্রধান বিচারপতিকে বলুন আমার বিচার দেরি হওয়ায় আমার ওপর কি মানসিক অত্যাচার  হয়েছে। কোনো কোনো দিন আমি আদালতে গিয়ে ফিয়ে এসেছি।
আমি স্ত্রীকে প্রশ্ন করলাম আমার কি করা উচিত? আমার সন্তানকেও মানুষ করতে হবে। তাঁরা বলল আমি যদি মামলা তুলে নিই তাহলে তাঁরা আমাকে ফাওতে যেতে দেবে। স্ত্রী বললেন, নিজে যা ভাল মনে কর করবে। তবে তোমায় একটা কথা বলি, তুমি যদি মামলা তুলে নাও জনগণ বলবে, রিচারিয়ার কোনো দুর্বলতা ছিল, ঘোটালা ছিল। তাই শেষে সে মামলা তুলে নিয়ে ফাওতে চলে গেল আমি তাঁর মতে মত দিলাম।
আমি স্ত্রীর কথা মত স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে ধার করে কটকে গেলাম। উকিলকে তাঁর প্রাপ্য দিয়ে প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করলাম। তিনি ভারিত সরকার আর আইসিএআরকে নোটিশ ধরালেন। তাঁরা এত দিন পরে উত্তর দিল। আমরা রিচারিয়াকে বিজ্ঞানী বলে মনেই করি না। তাই তাঁকে আইসিএআর থেকে অবসর নিতে বলেছি। তাঁরা রিচারয়াকে বিজ্ঞানী বলে মনে করেন না বলেই তাঁর আবেদনপত্র ধর্তব্যের মধ্যে আনেন নি। আমি জিতলাম। তাঁরা আমায় যদি বিজ্ঞানী মনে নাই করে তাহলে তাঁরা আমায় তিন মাসের নোটিশ দিল কেন?
ফলে রায় কার্যকর করতে হবে।  তাঁরা আমায় সিআরআরআইতে ডাকলেন।আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। আমার কাগজপত্র তখন ভোপালে পাঠালেন সই করার জন্য – যাতে আমি নির্দেশক হিসেবে গিয়ে আমার দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারি। আমি বললাম আমি এখন যোগ দেব না। আমার সব কাগজ নিয়ে নেওয়া হয়েছে। পদ্মনাভনকে বললাম, আমি এখানে একমাস কাজ করব। তাঁর পরে যে কেউ আমার থেকে দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারে। তিনি বললেন ঠিক আছে তাই হবে। পরের দিন যখন আমি ইন্সটিটিউটে গেলাম, আমার ঘরে দুটো তালা পড়েছে। আমার সব গবেষণাপত্র, আরও সব গুরুত্বপূর্ণ নথি পেলাম না। আজও সেগুলো পাই নি।

No comments: