উপনিবেশবাদ বিরোধী চর্চা
আরও কিছু ইওরোপিয় মিথ্যা
মোটামুটি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপস্তক থেকেই কৈশোর মনে যে ধারণাটি গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্যই দেশে ইওরোপিয়রা জাঁকিয়ে বসতে পেরেছে, ফলে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের হাল ধরেছে ইওরোপিয়রা, আর ১৭৫২ সালে শুরু হয়েগিয়েছে শিল্প বিপ্লব – ফলে ভারতীয় বাণিজ্য এবং উৎপাদন মাটি ধরে। কিন্তু একটা কথা বলা দরকার এর থেকে নির্জলা মিথ্যে আর দুটো হয় না। ১৫০০ সালের পর থেকে বিশ্বে সভ্যতাগুলি নিজের কারণে বিলয় হয় নি। পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে উচ্চাবচ হয়েছে। তাঁর পর ৩০০ বছর ধরে এশিয়ার কাছে কিছুটা নিচু হয়েই চলতে হয়েছে ইওরোপকে। কিন্তু ১৮০০ পরের বছরগুলি থেকে আজ পর্যন্ত ইওরোপের প্রাধান্য এশিয়ার মাথা নত করে দিয়েছে।
১৮০০ সালের পর থেকে এশিয়ায় কি ঘটল সে নিয়ে আজও বিতর্ক চলছে। সেই সময়ের ভারত চিন পারস্যের অর্থনৈতিক ইতিহাস আমরা আজও জানি না। বেশ কিছু যুক্তির মধ্যে ফাঁক থেকেই যাচ্ছে – বিশেষ করে ইওরোপ প্রাধান্যমণ্ডিত লেখকদের গবেষণায়।
অষ্টাদশ শতের প্রথম দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, বিশেষ করে ১৭১২ সালে প্রথম বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল কেন্দ্র শাসন মুক্ত হয়ে পড়ে। এখানে একটা কথা জোর দিয়ে বলা দরকার – মোটামুটি এতদিন ধরে পাঠ্য পুস্তকে যা বলা হয়েছে, শেখানো হয়েছে তাঁর বিরোধিতা করেই – কেন্দ্রিয় মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের বাণিজ্য উদ্যম বা শিল্প পরিকাঠামো বিন্দুমাত্র বিপর্যস্ত হয় নি, বা ভেঙ্গে পড়ে নি। এবং ভারতের ইতিহাসে এই বিষয়টি খুব একটা নতুন নয়। যুগে যুগে নানান সাম্রাজ্য এসেছে, চলে গিয়েছে, কিন্তু ভারতের শিল্প কলা, বাণিজ্য বা শিল্প উৎপাদন বিতরণ পরিকাঠামো কিন্তু ভেঙ্গে পড়ে নি, রাষ্ট্র নিরপেক্ষ হয়েই চলেছে ভারতের ব্যবসা বাণিজ্য।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের অর্থনীতির তথ্যের দিকে তাকালে বুঝতে পারি, যে ১৭০৮ সালে ভারত থেকে ব্রিটেন আমদানি করেছে ৪৯০২৫৭ পাউণ্ডের পণ্য, রপ্তানি করেছে ১৬৮৩৫৭ পাউণ্ড। ১৭৩০এ ইংলন্ড আমদানি করে ১০৫৯৭৫৯ পাউণ্ড, কিন্তু তাঁর রপ্তানি কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১৩৫৪৮৪ পাউণ্ড। ১৭৪৮(মারাঠা বর্গীদের হামলার পরে)তে ব্রিটেন আমদানি করছে ১০৯৮৭১২ পাউণ্ড এবং তাঁর রপ্তানি কমছে ২৭২২৪ পাউণ্ডে। এই ঘাটতি ব্রিটেনকে দামি ধাতু দিয়েই শোধ করতে হয়েছে। ১৭১০ থেকে ১৭৪৫ পর্যন্ত ভারতে ব্রিটেন থেকে দামি ধাতু এসেছে ১৭০৪৭১৭৩ পাউণ্ড।
ইতিহাস পালটে গেল পলাশির চক্রান্তের পর, ব্রিটিশদের সঙ্গে বাঙ্গালী/ভারতীয় বণিকদের হাত মেলানোর কারণে। তাঁদের ধারণা ছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁরা বিপুল লাভ তৈরি করতে পারবে – যে জন্য তাঁরা আজও বহুজাতিকদের হাত ধরতে চরম উৎসুক হয়ে থাকে।
শিল্প বিপ্লবের জন্য বাংলার বস্ত্রশিল্পের অবনতি ঘটেছে এই ধারণা মিথ্যে। তাঁর জন্য অসম্ভব ব্রিটিশ পীড়ন আর বাংলার বড় পুঁজির মালিকদের মাথা নোয়ানো দায়ি। ছিয়াত্তরের গণহত্যায়(১৭৭০) বছরগুলোয় এক তৃতীয়াংশ বাঙ্গালী-বিহারী মেরে ব্রিটিশদের রাজস্ব আদায় তার আগের বছরগুলোর থেকে অনেক বেশি হয়েছিল। পলাশী চক্রান্তের লাভ আর তার সঙ্গে আকাশ ছোঁয়া রাজস্ব আদায়ের ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত তৈরি করতে সক্ষম হয়।
শুরু হল ভারত থেকে ব্রিটেনে অর্থ লুঠে নিয়ে যাওয়ার উদ্যম। ব্রিটেনে বাংলা থেকে সোনা আর হিরে জাহাজে করে রপ্তানি করা শুরু হল। বাংলার রূপা ব্যবহৃত হল চিনের চা, রেশম আর পোর্সেলিন কিনতে। আর আমলাদের, বিভিন্ন বাণিজ্য কেন্দ্রের কর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা থেকে যে লাভ হত, বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করত। তার লাভ পৌছত ব্রিটেনে। বাংলার ব্যবসা উদ্বৃত্ত দিয়ে সারা ভারত এবং এশিয়ায় যুদ্ধ করেছে ব্রিটিশ। ১৭৮০ সালে ব্রিটেনে সম্পদ রপ্তানি হয়েছে ১.৮ মিলিয়ন ডলার, যা ভারতীয় রপ্তানির সমান।
ভারতীয় বস্ত্র ১৭৯৮ বা ১৮১৩(২ মিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের) সালেও লন্ডনে রপ্তানি হয়েছে। মনে রাখুন ১৭৫২র শিল্প বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছে – ১৭৭৯ সাল থেকে ১৮১২ পর্যন্ত ব্রিটেনে মিলে তৈরি সুতোর দাম কমেছে নয়ের দশমাংশ।
আরও কিছু ইওরোপিয় মিথ্যা
মোটামুটি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপস্তক থেকেই কৈশোর মনে যে ধারণাটি গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্যই দেশে ইওরোপিয়রা জাঁকিয়ে বসতে পেরেছে, ফলে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের হাল ধরেছে ইওরোপিয়রা, আর ১৭৫২ সালে শুরু হয়েগিয়েছে শিল্প বিপ্লব – ফলে ভারতীয় বাণিজ্য এবং উৎপাদন মাটি ধরে। কিন্তু একটা কথা বলা দরকার এর থেকে নির্জলা মিথ্যে আর দুটো হয় না। ১৫০০ সালের পর থেকে বিশ্বে সভ্যতাগুলি নিজের কারণে বিলয় হয় নি। পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে উচ্চাবচ হয়েছে। তাঁর পর ৩০০ বছর ধরে এশিয়ার কাছে কিছুটা নিচু হয়েই চলতে হয়েছে ইওরোপকে। কিন্তু ১৮০০ পরের বছরগুলি থেকে আজ পর্যন্ত ইওরোপের প্রাধান্য এশিয়ার মাথা নত করে দিয়েছে।
১৮০০ সালের পর থেকে এশিয়ায় কি ঘটল সে নিয়ে আজও বিতর্ক চলছে। সেই সময়ের ভারত চিন পারস্যের অর্থনৈতিক ইতিহাস আমরা আজও জানি না। বেশ কিছু যুক্তির মধ্যে ফাঁক থেকেই যাচ্ছে – বিশেষ করে ইওরোপ প্রাধান্যমণ্ডিত লেখকদের গবেষণায়।
অষ্টাদশ শতের প্রথম দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, বিশেষ করে ১৭১২ সালে প্রথম বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল কেন্দ্র শাসন মুক্ত হয়ে পড়ে। এখানে একটা কথা জোর দিয়ে বলা দরকার – মোটামুটি এতদিন ধরে পাঠ্য পুস্তকে যা বলা হয়েছে, শেখানো হয়েছে তাঁর বিরোধিতা করেই – কেন্দ্রিয় মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের বাণিজ্য উদ্যম বা শিল্প পরিকাঠামো বিন্দুমাত্র বিপর্যস্ত হয় নি, বা ভেঙ্গে পড়ে নি। এবং ভারতের ইতিহাসে এই বিষয়টি খুব একটা নতুন নয়। যুগে যুগে নানান সাম্রাজ্য এসেছে, চলে গিয়েছে, কিন্তু ভারতের শিল্প কলা, বাণিজ্য বা শিল্প উৎপাদন বিতরণ পরিকাঠামো কিন্তু ভেঙ্গে পড়ে নি, রাষ্ট্র নিরপেক্ষ হয়েই চলেছে ভারতের ব্যবসা বাণিজ্য।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের অর্থনীতির তথ্যের দিকে তাকালে বুঝতে পারি, যে ১৭০৮ সালে ভারত থেকে ব্রিটেন আমদানি করেছে ৪৯০২৫৭ পাউণ্ডের পণ্য, রপ্তানি করেছে ১৬৮৩৫৭ পাউণ্ড। ১৭৩০এ ইংলন্ড আমদানি করে ১০৫৯৭৫৯ পাউণ্ড, কিন্তু তাঁর রপ্তানি কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১৩৫৪৮৪ পাউণ্ড। ১৭৪৮(মারাঠা বর্গীদের হামলার পরে)তে ব্রিটেন আমদানি করছে ১০৯৮৭১২ পাউণ্ড এবং তাঁর রপ্তানি কমছে ২৭২২৪ পাউণ্ডে। এই ঘাটতি ব্রিটেনকে দামি ধাতু দিয়েই শোধ করতে হয়েছে। ১৭১০ থেকে ১৭৪৫ পর্যন্ত ভারতে ব্রিটেন থেকে দামি ধাতু এসেছে ১৭০৪৭১৭৩ পাউণ্ড।
ইতিহাস পালটে গেল পলাশির চক্রান্তের পর, ব্রিটিশদের সঙ্গে বাঙ্গালী/ভারতীয় বণিকদের হাত মেলানোর কারণে। তাঁদের ধারণা ছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁরা বিপুল লাভ তৈরি করতে পারবে – যে জন্য তাঁরা আজও বহুজাতিকদের হাত ধরতে চরম উৎসুক হয়ে থাকে।
শিল্প বিপ্লবের জন্য বাংলার বস্ত্রশিল্পের অবনতি ঘটেছে এই ধারণা মিথ্যে। তাঁর জন্য অসম্ভব ব্রিটিশ পীড়ন আর বাংলার বড় পুঁজির মালিকদের মাথা নোয়ানো দায়ি। ছিয়াত্তরের গণহত্যায়(১৭৭০) বছরগুলোয় এক তৃতীয়াংশ বাঙ্গালী-বিহারী মেরে ব্রিটিশদের রাজস্ব আদায় তার আগের বছরগুলোর থেকে অনেক বেশি হয়েছিল। পলাশী চক্রান্তের লাভ আর তার সঙ্গে আকাশ ছোঁয়া রাজস্ব আদায়ের ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত তৈরি করতে সক্ষম হয়।
শুরু হল ভারত থেকে ব্রিটেনে অর্থ লুঠে নিয়ে যাওয়ার উদ্যম। ব্রিটেনে বাংলা থেকে সোনা আর হিরে জাহাজে করে রপ্তানি করা শুরু হল। বাংলার রূপা ব্যবহৃত হল চিনের চা, রেশম আর পোর্সেলিন কিনতে। আর আমলাদের, বিভিন্ন বাণিজ্য কেন্দ্রের কর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা থেকে যে লাভ হত, বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করত। তার লাভ পৌছত ব্রিটেনে। বাংলার ব্যবসা উদ্বৃত্ত দিয়ে সারা ভারত এবং এশিয়ায় যুদ্ধ করেছে ব্রিটিশ। ১৭৮০ সালে ব্রিটেনে সম্পদ রপ্তানি হয়েছে ১.৮ মিলিয়ন ডলার, যা ভারতীয় রপ্তানির সমান।
ভারতীয় বস্ত্র ১৭৯৮ বা ১৮১৩(২ মিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের) সালেও লন্ডনে রপ্তানি হয়েছে। মনে রাখুন ১৭৫২র শিল্প বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছে – ১৭৭৯ সাল থেকে ১৮১২ পর্যন্ত ব্রিটেনে মিলে তৈরি সুতোর দাম কমেছে নয়ের দশমাংশ।
No comments:
Post a Comment