জয়দেবকৃতি
জয়দেব মিশ্র। আধুনিক বিশ্বায়িত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত শহুরেদের
নামটা কানে কিছুটা খটমট লাগলেও উপাধি থেকে চোখ ফিরিয়ে নামের পূর্বাংশে নজর দিলে
গুঞ্জরিত হয় জয়দেব, যাঁর অনুষঙ্গে জুড়ে আছে কয়েকশ বছর ধরে চলা এক মেলা - কেঁদুলির
মেলা। বাংলার শ্রেষ্ঠতম কবিদের মধ্যে আজও অগ্রগণ্য তিনি। সেই মানুষটার স্মরণে আজও
বাংলায় প্রায় সাড়ে আটশ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে তাঁরই গ্রাম কেন্দুবিল্ব বা চলতি
লব্জে কেঁদুলিতে জয়দেবের মেলা। চাকোলতোড়, কানাইশোরএর মত প্রচুর সামাজিক মেলা কবে
শুরু হয়েছে তার কুড় খুঁজতে যাওয়া মুশকিল- কিন্তু বাংলার লিখিত সংস্কৃতিতে গাজন
মেলা(মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বেনের মেয়ে’ ইতিহাস-উপন্যাস দ্রষ্টব্য)
ছাড়া এত পুরনো মেলা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাংলার ধারাবাহিক
স্মারক মেলারও ইতিহাসে জয়দেব-কেঁদুলি বোধহয় প্রাচীনতম। বাংলা তো বটেই চোখ বুজে বলা
যায় সারা ভারতেও বিরলতমগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য। এই মেলা বিষয়ে জানেননা এমন (গ্রাম-শহরের)
বাঙ্গালী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মায়ের কাছে মাসির গল্প – জয়দেব মেলা প্রবন্ধে যতটুকু
না করলে নয় করা যাবে; তার আগে মন দিয়ে চেষ্টা করা যাক কবিবরের হৃদয়ে প্রবেশ করার,
গ্রামীনদের হৃদয়ে প্রবেশ করার – বোঝার চেষ্টা করা কেন এই মেলা আজও বাংলার কোটি
কোটি মানুষের অক্ষহৃদয়ে আসীন – বাঘ পালানো শীতে কেন মানুষ মেলার চুল্লি আর ধুনির
ওম নিতে নিতে অংশ হয়ে ওঠেন বাংলার অকথিত ইতিহাসের। এই বিষয়টি না বুঝলে, বোঝা দায়
হয়ে যাবে, কোন মানুষের সন্ধানে, কেন আজও এই বিশ্বায়নের যুগেও লক্ষ লক্ষ গ্রামীন
প্রতিবছর ছুটে আসেন এই প্রান্ত বীরভূমের নদীর তীরে।
বাংলায় এক সময় সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞানচর্চা
হত – তার পাশাপাশি নানান ভাষাতেও পড়াশোনা হত। কিন্তু বাংলা বা পূর্ব ভারতের
জ্ঞানীদের লেখ্য সেই সংস্কৃত বহু সময়েই পাণিনীর তৈরি সাংকেতিক সংস্কৃত ব্যাকরণের
সূত্র মানত না। পালকাপ্যের হস্তায়ুর্বেদ(হাতিপালন বিদ্যা), ভগভট্টের
রসরত্নসমুচ্চয়ঃ(বাংলার ধাতুবিদ্যা) বা পরাশরের কৃষিপরাশর(নামেই প্রকাশ কৃষিবিদ্যা)
বা এই ধরণের বহু রচনা ধ্রুপদী সংস্কৃত ব্যকরণের ধার ধারত না। গ্রন্থগুলি পড়তে পড়তে
মনে হয় যেন একটু কঠিন সাধু বাংলা ভাষার রচনা পড়ছি – যার বহিরাবণে সংস্কৃত ভাষার
মোড়ক রয়েছেমাত্র। বিগত পশ্চিমি সহস্রাব্দের আটের দশকে বাংলা মাধ্যমে যারা ঐচ্ছিক
সংস্কৃত বিষয় নিয়ে কিছুটা হলেও সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের মুখ দেখেছেন, তাঁদের কাছে
এই পাঠ্যগুলি কিন্তু অনুবাদে না পড়লেও চলে - সাহস ধারণ করে মূল পাঠটি পড়েন, পুরনো
বাংলা পড়া স্বাদ পাওয়া যায় – প্রায়শই টিকা পড়ার প্রয়োজন হয় না। পালকাপ্য অন্তত
কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন, ভগভট্ট বা পরাশরের লেখা অন্তত তেরশ বছরের পুরনো। ফলে
বলা যায় বাংলায় বাংলার মত করে সংস্কৃত ভাষাচর্চার ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরোনো।
১৮৩৬এর উইলিয়ম এডামের বাংলা-বিহারের শিক্ষা সমীক্ষায় যে একলক্ষ পাঠশালার সন্ধান
পাচ্ছি, সেখানে সেই অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষায় পাঠ্যও পড়ানো হত। ফলে
বহুকাল ধরে আপামর গ্রামীন তাঁদের নিজেদের ভাষা(যখনকার বাংলা ভাষা, একবিংশ শতকের
কলকাতার বালিগঞ্জীয় লব্জের মেন্সট্রিমিং হয়ে যায় নি) ছাড়াও সংস্কৃত ভাষায় রচিত
সাহিত্যের স্বাদ নিয়েছেন।
সেই অনপনেয় জ্ঞানচর্চা ঐতিহ্যের অন্যতম
অংশীদার ছিলেন লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেব মিশ্রমশাই (তাঁর সঙ্গে রাজসভায় ছিলেন
গোবর্ধনশ্চ শরণ্যে জয়দেব উমাপতিঃ।/কবিরাজশ্চ রত্নানি স্মিতৌ লক্ষ্মণস্য চ।। - টিকা
কি প্রয়োজন? আচ্ছা দেওয়া যাক – গোবর্ধন আচার্য, শরণ, জয়দেব, উমাপতি আর কবিরাজ
আর্থাত ধোয়ী, এরা কয়েকজন ছিলেন সভারত্ন)। তিনি বাংলায় প্রচলিত সংস্কৃত পদ্ধতিতে
কবিতা লিখতেন। সেই সংস্কৃত গ্রাম বাংলার মানুষ জানত বুঝত এবং তার তাঁর অনুগামী
হয়েছিল সেই লক্ষণ সেনএর আমল থেকে, সেই অনুগামিতার ছেদ পড়েনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
সময়েও। মেলার কলেবর আর অনুরাগীদের সমাগমের বহর দেখে হয়ত বলা যায়, সেই ভালবাসার বিস্তৃতি
বেড়েছে বর্তমান সময়ে অনেক বেশি।
কেমন ছিল বাংলা জনপদে প্রচলিত সংস্কৃত
ভাষায় রচিত জয়দেবের পদ? পড়া যাক –
ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলনকোমলমলয়সমীরে
মধুকরনিকরকরম্বিতকোকিলকূজিতকুঞ্জকুটীরে।
বসন্তরাগ যতিতাল বিশিষ্ট এই পদের কি
কোনো টিকা ভাষ্য প্রয়োজন? কাব্য-বক্তব্য স্পষ্ট - বসন্তের আগমনে মলয় সমীরণ সুকোমল
লবঙ্গ-লতাকে বার বার সাদরে আলিঙ্গন করছে, কুঞ্জকুটীরে ভ্রমরের গুণগুণ রব ও কোকিলের
সুমধুর কুহুধ্বনী শোনা যাচ্ছে। তখন হরি কি করছেন?
বিহরহি হরিরিহ সরসবসন্তে
নৃত্যতি যুবতিজনেন সমংসখি
বিরহিজনস্য দূরন্তে।।
এই মধুর সময়ে হরি কোন ভাগ্যবতী যুবতীর
সঙ্গে বিহার করছেন, এবং প্রেমতসবে নৃত্য করছেন। বিরহীজনের কাছে বসন্ত সত্যই অতি
দুরন্ত। কয়েক শত বছর ধরে বাংলার কোটি কোটি গ্রামীন(সাম্প্রতিককালে ‘লোকসংস্কৃতি’
ফ্যাশানধারী হুজুগে শহুরেরাও) কবি জয়দেবের এই কাব্যসুধায় স্নাত হয়ে তাঁর স্মৃতি
তর্পণ করতে ছুটে আসেন কেঁদুলিতে। আসেন আউলবাউলেরা, যারা তাঁর উত্তরাধিকার আজও বহন
করে চলেছেন তাঁদের মন্ত্রে, শহুরেরা যাকে বাউল গান বলতেন ভাল বাসেন।
কেন এই গ্রাম বাংলার মানুষেরা জয়দেবকে আজও অন্তরের
অক্ষহৃদয়ে স্থান দিয়েছেন? তিনি হয়ত হাতে গোণা শহুরে মনুষ্যদের মধ্যে অন্যতম, যিনি
গ্রামীনদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা ভালবাসার কলধ্বনী গীতিময় উচ্ছ্বাসটি
ধরতে পেরেছিলেন। আজও গ্রাম বাংলায় গানের রসে চোবানো গ্রাম নাটকগুলিকে গানরূপে
আখ্যা দেওয়া হয় – সামগ্রিক অর্থে পালাগান বা শুধুই গান - যেমন ভাত খাও বললে শুধু
ভাত দেওয়া বোঝায় না, তেমনি গ্রামে গান হবে এই শব্দবন্ধ বললে মানুষ শুধু গানের কথা
বোঝেন না, বোঝেন নাটকের কথা। জয়দেব এবং তাঁর স্ত্রীরত্ন পদ্মাবতী অসম্ভব পরিশীলিত
নাচগান করতেন - উল্লেখ পাচ্ছি হলায়ুধ মিশ্রের চম্পুকাব্য সেকশুভোদয়ায়(সূত্রঃ
হৃষিকেশ গ্রন্থমালা, ৬৯-৭১) - ততঃ পদ্মাবতী জয়দেবস্য ব্রাহ্মণী গান্ধারনামা
ধ্বনিরুদ্গারিতা চ। তদুদগীরিতে সতি সমস্ত নৌকাঃ, গঙ্গায়াং-যদ বিদ্যন্তে, শ্রুত্বা
ততসন্নিধানাং সমায়তা চ। তৎ স্তাং সর্বে সভাসদাঃ পূজয়ামাস তৎক্ষণাৎ। ‘ধন্যেয়ং
ব্রাহ্মনী। ঈদৃশং ন দৃষ্টং ন শ্রুতমিতি দ্বয়োরপি। ধন্যোহসৌ।’ অর্থ পরিস্কার –
জয়দেব-পদ্মাবতীর গান শুনে গঙ্গার বুকে যত নৌকা ছিল, তীরে সব চলে এসেছিল। সভাসদেরা
(তা) শুনে ধন্য ধন্য করে বলেছিলেন, এরকম নৃত্যগীত তাঁরা কখোনো দেখেননি শোনেননি।
তাঁদের এই গুণের কথাও কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণের ভ্রাতা শুক্লধ্বজ বা চিলারায়ের
সভাকবি রামসরস্বতীর ‘জয়দেব’ কাব্যে উল্লেখ করেছেন।
No comments:
Post a Comment