গ্রাম সমাজের সঙ্গে ভাঙল সমাজের নিজস্ব শিক্ষা পরিকাঠামো
পাঠশালাগুলো ছিল গ্রামের নানান শ্রেণীর মানুষের চাষী,
কর্মকার, শিল্পী আর ব্যবসায়ীদের সন্তানদের শিক্ষা কেন্দ্র। কৃষির সঙ্গে
কর্মশালার সরাসরি মেলবন্ধনে গড়ে উঠছিল গ্রামীণদের মধ্যে আত্মীয়তার, নিজে কাজ করার
গর্ব। কাজে আত্মিকতা, গ্রামকৌমের ভালবাসা এবং স্বনির্ভর গ্রামগোষ্ঠীর নিত্যনতুন
গবেষণায় তৈরি হত নতুন প্রযুক্তি। কৃষি আর শিল্পের বিকাশে
গ্রাম পঞ্চয়েতের বড় ভূমিকা ছিল। পঞ্চায়েত নিজের
রোজগারে সেচ ব্যবস্থা, সাধারণ পতিত জমি উদ্ধারেরমত নানান কাজে অংশ নিত।
গ্রামের
আত্মিকতাবোধ এতই জোরালো ছিল, প্রত্যেক উত্পাদক গোষ্ঠীই গ্রামকৌমের সম্মান লাভ করত। তাই পলাশির কয়েক দশক পরেও উদ্বৃত্ত
অর্থনীতি দেশ ছিল বাঙলা সুবা। বিদেশে প্রযুক্তিও রপ্তানি করত। এই প্রক্রিয়া চালাতে
জাতব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জাতব্যবস্থা ভিলেনে পরিণত হয়েছে বাঙলার পরিকাঠামো ভাঙা
ব্রিটিশ প্রশাসন আর বাঙালি(পরে ভারতীয়) মধ্যবিত্ত মণীষার যৌথ প্রযোজনায়। জাতব্যবস্থা ধংস করতে না পারলে ভারত
ভেঙে, ভারত সমাজে বিশ্বধংসকারী ইওরোপিয় জীবনযাত্রা নকলের শেকড় গাড়ার স্বপ্ন
সাকার হয় না।
ভারতের প্রায় প্রত্যেক প্রান্তে দেশিয় পাঠশালার
অস্তিত্ব ছিল। প্রত্যেক অঞ্চলের বিদ্যালয়ের শিক্ষা কাঠামো,
পাঠদান বা অন্যান্য পরিকাঠামো আলাদা আলাদা। সেই অঞ্চলের প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে। তখোনো বাংলার শিক্ষাব্যবস্থায়
কেন্দ্রিকতা গড়ে ওঠেনি। মগধে পড়ানো হত
তুলসিদাস রামায়ণের নানান ঘটনাবলী নির্ভর দান লীলা, সুদামা চরিত, রাম জনম। বাংলায়ও পড়ানো হত। তবে ভাষা বাংলা। ত্রিহুতের শিক্ষার
মাধ্যম ছিল মৈথিলি বা ত্রিহুতিয়া। এই উচ্চ পাঠশালাগুলোতে
সংস্কৃত বা পারসিক মাধ্যমে পড়ানো হত না। বাংলা প্রদেশের
অভিজ্ঞতা থেকে পরিস্কার, বাংলার গ্রামে গ্রামে দেশজ ভাষায় পড়ানোর একটি সুসংগঠিত
ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসন আমলের অনেক আগে থেকেই। কারা, কী পড়তেন!
এডাম বলছেন, “Commercial accounts... are chiefly acquired by the class of money-lenders and retail traders,
agricultural accounts... by
the children of those families whose subsistence is exclusively drawn from the
land, and both accounts by those... who expect to gain their livelihood as writers, accountants, etc.
সরকারই জনগণের একমাত্র এজেন্ট, এমন ইওরোপিয় নিদান
গ্রামবাঙলার মানুষের অজানা ছিল। বাঙলার জনগণ তখনও সামাজিক সব কাজ আমলা-রাজনীতিক-বড়ব্যবসায়ীদের আউটসোর্স
করে দেয় নি। পাঠশালা সহ নানান পরিকাঠামো চালাবার, দেখাশোনার সম্পূর্ণ
দায় ছিল গ্রামকৌমের। একলাখ পাঠশালায় গুরুমশাইদের
কখোনো অর্থে, কখোনো পণ্যে বিদায় দেওয়া হত। "indigenous elementary schools... are those ... in
which instruction in the element of knowledge is communicated, and which have
been originated and are supported by the natives themselves, in contradistinction
from those that are supported by religious or philanthropic societies"।
আরও একটা বড় প্রচার ছিল বাংলার হিন্দু-মুসলসমানের
মুখ দেখাদেখি ছিলনা। উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণের ছায়াও মাড়াত না।
অথছ
এডামের সমীক্ষায় পাচ্ছি, এই পাঠশালাগুলোর পড়ুয়েদের মধ্যে নানান ধর্ম, বর্ণ আর
জাতির শিশু পাঠ নিত এক সঙ্গে বসে। আট বছর পর্যন্ত। দক্ষিণ বিহারের এক
পাঠশালার জাতের হিসেব দিচ্ছেন এডাম। গুরুমশাইদের মধ্যে
মুসলমান ছাড়াও ছিলেন কায়স্থ, মগধ, গন্ধবণিক, তিলি, কোইরি, সোনার কৌমের। হিন্দুদের পড়ুয়েদের
মধ্যে ছিল দেসাধ, পাসি, সুশাহর, ধোবি, তাঁতি, কালাবর, বেলদার, গোয়ালা, নাপিত,
কাহার, কুর্মি, কোইরি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ইত্যাদি। বীরভূমে তিনি
হিন্দু, মুসলমানএর সঙ্গে খ্রিষ্টিয় গুরুমশাইএর নাম পাচ্ছেন। ৪০০ জন গুরুমশাই
ছিলেন হিন্দু, ২৪টি জাতি – চন্ডাল(হায়! আমি
চন্ডালের কন্যাও লিখলেন রবীন্দ্রনাথ!), ধোবি, তাঁতি, কৈবর্ত, গোয়ালাও।
পড়ুয়েদের
মধ্যে মুসলমান, খ্রিস্টান, সাঁওতাল, ধাঙড়, ডোম, চন্ডাল, তেলি, ব্যাধ, যুগি,
তাঁতি, হাড়ি, কুর্মি, মালি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থরাও। "Parents of good caste do not hesitate to send their children to
schools conducted by teachers of an inferior caste and even of different
religion(সুযোগ পেয়েই উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণের ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়ার
চেষ্টা করছেন ব্যতিক্রমী এডাম). For instance, the
Musalman teacher... has Hinuds of good caste
among his scholars and this is equally true of the Chandal and other low caste
teachers enumerated...
"the Musalman teachers have Hindu as well as Musalman scholars and the
different castes of the former assemble in the same school-house, receive the
same instructions from the same teacher, and join in the same plays and
pastimes।
বাংলার মধ্যবিত্ত আর বুদ্ধিজীবিদের ইওরোপিয় হয়ে ওঠার
চেষ্টায় উঠেগেল সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা।
মেকলের নিদানের তিন বছর আগেও জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশনের সদস্য হোল্ট
ম্যাকেঞ্জি ১৮৩২এ কর্তৃত্বের কণ্ঠে বলছেন To provide for the education of the great body of the
people seems to be impossible। অথচ এই অসম্ভবকে সম্ভব করছিল
বাঙলার গ্রাম সমাজ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাত
ধরে তৈরি হল নতুন এক শ্রেণীর জমিদার গোষ্ঠী। এরা জমির মালিক হলেন। অথচ গ্রমে থাকতেন না। গ্রা উন্নয়ণে উত্সাহ ছিল না। এজমালি, নিষ্কর জমি দখল
নিয়ে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা হল। গ্রামে জমির বাজার তৈরি হল। গ্রামকৌমের
সলিল সমাধি ঘটল।
ভেঙেগেল সমাজের নিজস্ব শাসনব্যবস্থার পরিকাঠামো।
No comments:
Post a Comment