লন্ডনের এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শোলার পাখি বিষয়ক কর্মশালায় মধুমঙ্গল মালাকার |
আজ বাঙলায় দুধরণের শোলার কাজ হয়। প্রথমতঃ ঐতিহ্যবাহী শোলার কাজ, যার একমাত্র
ধারকবাহক মালাকার সম্প্রদায়, অন্যতম প্রধান শিল্পী মধুমঙ্গল মালাকার। সারা বছর ধরেই
মধুমঙ্গলের সৃষ্টি ছড়িয়ে থাকছে দিনাজপুর আর দিনাজপুর সংলগ্ন মালদহ জেলার নানান
গ্রাম, নানান থান, নানান পরিবারের উপাচারে। দ্বিতীয়টি মডেলের শোলার কাজ। মডেলের কাজে প্রখ্যাত মুর্শিদাবাদের খাগড়া এবং
বর্ধমানের বনকাপাসি। কারোর উপাধি পারম্পরিক মালাকার কারোরবা ভাস্কর। ভাস্করেরা
একদা পাথর আর হাতির দাঁতের কাজ করতেন। এখন শোলা দিয়েই এঁরা নানান ধরণের
শিল্পীত মুখ(দুর্গা), পশু(হাতির আমবাড়ি), জলযান(বজরা, নৌকো) ইত্যাদি তৈরি করে
থাকেন অসাধারণ দক্ষতায়। মালাকার
সম্প্রদায়ের শিল্পীদের সাধারণতম দ্রব্যকে ছেনে অসম্ভবশিল্পরূপে গড়ে তোলার নানান
বাখান ছড়িয়ে রয়েছে বাঙলার চিরায়ত সাহিত্যগুলিতে।
দিনাজপুরে
গমীরা
দক্ষিণবঙ্গে গাজন, মালদায় গম্ভীরা দেবাদিদেব
শিব কেন্দ্র করে মালদা জেলার আদি অকৃত্রিম মুকাভিনয়, মুখোশ নৃত্যনাট্য আর
রঙ্গব্যঙ্গমূলক সংলাপ, কিন্তু উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে গমীরা অথবা মোখা খেইল। গমীরা, লৌকিক এই শব্দটি প্রাচীণত্বের দাবি পেশ করে। জ্ঞাণচর্চায়
পাশ্চাত্যপন্থী মধ্যবিত্তকেন্দ্রিকতার জ্ঞাণরসায়ণের অনুপান, জ্ঞাণের প্রবাহ সদা
নিম্নপানে বহমান। সমাজের কেন্দ্রে উচ্চ-মধ্যবিত্ত আর সব্বাই হয় প্রান্তিক
নয় নিম্নবর্ণ অথবা দলিত। তাই আত্মঅহঙ্কারমূলক শহুরে গবেষকের নিঃশব্দে উদ্যত
তর্জনী নির্দেশ করে সংস্কৃতায়ণের গরিমাময় বাখান। বাঙলার
প্রাচীণতম ভূখন্ড অন্য কথা বলে। বারেন্দ্রভূমে গম্ভীরা থেকে গমীরা
শব্দটির উদ্ভব হয় নি বরং গমীরা থেকেই উদ্ভব হয়েছে সংস্কৃতগন্ধী গম্ভীরা শব্দটি।
দিনাজপুরের গমীরা রাজবংশীসহ অন্যান্য সমাজের দেশি-পলিয়াদের দেবী চামুন্ডা ও
কালীর নানানরূপ কেন্দ্র করে মুখোশ নৃত্য। দিনাজপুরের অন্যতম আকর্ষণ গোকর্ণ
গ্রাম পঞ্চায়েত সংলগ্ন হরিরামপুরের চাকলা গ্রামে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন গমীরা
মুখোশ নৃত্যের পালা। কেউ সাজেন নরসিংহ, কেউ বুড়াবুড়ি (শিবদুর্গা), কেউ
কালীর মুখোশ পরেন, কেউ পরেন কালীকাচ (কালী মুখাসহ কাঁচুলি), কেউ আবার বিশাল পাথা
পিঠে নিয়ে অসুর নিধনে সাজেন দেবীশিকনিঢাল, যেন বিশাল এক শকুন নেমে এসেছেন মর্ত্যে,
দেবী চামুন্ডার লোকায়তরূপ। এই মোখা খেলা ঘিরে গমীরা মেলায় নানান
ধরণের কঠোরতম লৌকিক আচার আচরণ পালন করেন স্থানীয় ঠিলবিল, যমুনা, চাকলা, মুস্কিপুর
গ্রামের বৈশ্যদাস, কৈবর্ত, রবিদাস এবং দেশি পলিয়া সম্প্রদায়ের লোকায়ত মানুষেরা।
গমীরা মেলার তিনটি বৈশিষ্ট্য – কৃষি, খেলা আর মেলা। সংক্রান্তির
দু দিন আগে কৃষির রাতে মেলার সংগঠকেরা স্থানীয় মানুষদের বাড়ি থেকে চুরি করে আনেন
নানান কৃষিকাজ সংক্রান্ত সম্ভার – ঢেঁকি, কলার কাঁদি, হাল-জোয়াল অথবা অন্যকিছু। পুজোর পর সব
ফেরত দেওয়া হয় মালিকদের। খেলা হল গমীরা নাচ। মেলা বহন করছে
আবহমানকালের পারম্পরিক অর্থ। বর্ষশেষ আর বর্ষবরণ উতসবে প্রয়োজন হয় শোলার নানান দ্রব্য। বর্ষশেষে যেমন
শোলার মুখা ব্যবহার হয় দিনাজপুরে, তেমনি সারা বাঙলায় বর্ষবরণের হালখাতায় ব্যবহার
হয় শোলার কদম। এছাড়াও এই দুই জেলার নানান লৌকিক আচার আচরণে ব্যবহৃত
হয় শোলার মান্দাস (মঁজুষ), মনসার ফুল ইত্যাদি। শোলার তৈরি
সবই রাজবংশী সম্প্রদায়ের শুভর প্রতীক। দেবশিল্পী মালাকারদের হাতেরগুণে আজও
এই সাধারণতম শোলা হয়ে ওঠে অপার্থিব দেবভোগ্য।
মালাকার
মধুমঙ্গল
বারেন্দ্রভূমের দিনাজপুর ভৌগোলিক
ভূখন্ডটির সার্বজনীন নানান উতসবে পুরুষানুক্রমে শোলার মুখোশ তৈরি করে আসছেন চাকলার
মেলা সংলগ্ন মুস্কিপুরের মালাকার পরিবারের আন্তর্জাতিক শোলা শিল্পী মধুমঙ্গল
মালাকার। শুধু
মোখা খেইলেরই মুখোশ নয়, কিছুটা মালদহ আর সম্পূর্ণ দিনাজপুরের প্রায় সব ধরণের লৌকিক
আচার আচরণে ব্যবহৃত শোলাকর্মের সঙ্গে তিনি আর তার পরিবার জড়িয়ে রয়েছেন
বংশানুক্রমিকভাবে। অনপনেয়
বংশপারম্পরিক দক্ষতায় কখোনো তৈরি করেন তাজিয়া, কখোনো পীরের ঘোড়া, যা নিয়ে মুসলমান
সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধালুরা পালন করেন মহরম অনুষ্ঠান। তৈরি করেন সাঁওতাল
সম্প্রদায়ের বিয়ের ঘোড়াও। প্রায় প্রত্যেক সম্প্রদায়েরই বিয়ের মুকুট
এই মুস্কিপুরের মালাকার পরিবারের পারম্পরিক হাতেই তৈরি হয়। গ্রাম দেবতার
উদ্দেশ্যে নিবেদিত অথায় পাথায়, অসাধারণ শিল্পকর্ম মেল্লি, অথবা শোলার রথ, কদম ফুল,
চন্ডী, মনসা আথবা কালীর ফুলও তৈরি করেন মধুমঙ্গল। তাঁর হাতে
তৈরি কদম অথবা নানান শোলার ফুল আর পাখির চাহিদা অসীম। সেই ফুলের
সুবাস আর পাখির রংএর মাধুর্যের বাখান ছাড়িয়েছে দেশের গন্ডী। ফিলাডেলফিয়ার
আন্তর্জাতিক ফুল সম্মেলন আর এডিনবরার পাখি সম্মেলনেও বাঙলার মালাকারদের শোলার ফুল
আর পাখির সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি।
বাঙলার সাংস্কৃতিক জগতে মধুমঙ্গল খুব একটা প্রখ্যাত না হলেও তাঁর মুখোশসহ
নানান লৌকিক কর্মের সম্ভার সগৌরবে বাঙলার শিল্পকর্মের নিদর্শণরূপে বিরাজমান লন্ডন,
স্কটল্যান্ড, সানফ্রান্সিসকো আর ফিলাডেলফিয়ার সংগ্রহালয়গুলোতে। বার্সিলোনায়
রয়েছে কালীমূর্তি। নিউজিল্যান্ডের দশেরা উতসবে পুড়েছে মধুমঙ্গলের তৈরি
শোলার রাবণ। শোলার পীরের ঘোড়া রয়েছে মাদ্রিদে। নানান লৌকিক
সম্ভার নিয়ে তিনি বহুবার গিয়েছেন আমেরিকার নানান বঙ্গ সম্মেলনে। রাজ্যপালের
হাত থেকে পেয়েছেন কমলা সম্মানও। তিনি ভুলতে পারেনন না বাঙলার অন্যতম প্রধাণ লৌকিক শিল্প
সংগঠণ ক্রাফ্টস কাউন্সিল অব বেঙ্গলএর প্রধান রুবি পালচৌধুরী এবং ব্যক্তিগত
সংগ্রাহক নন্দিতা পালচৌধুরীর অবদান। এই দুই মানুষের সংস্পর্শে এসে বাঙলার
শোলা শিল্পের প্রতিনিধি হয়ে তিনি যেমন ভারত ঘুরেছেন তেমনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব
করেছেন বিশ্বসমাজেও।
শিল্পী যখন
সংগঠক
পৃথিবী বিখ্যাত মধুমঙ্গলের শোলার কাজে
পেট চলে না। মধুমঙ্গলের পরিবারের ভরণপোষণের বাহন মুস্কিপুরের
তেমাথার মোড়ের চায়ের দোকান। চায়ের দোকান চালিয়েও তিনি আজও দুই জেলা
জুড়ে সরবরাহ করে চলেন তাঁর অননুকরণীয় শোলাশিল্প। চা দোকানে মধুমঙ্গলের মন ভরে না। তিনি আর কয়েকজন সমমনস্ক গ্রামীণ শিল্পী আর বন্ধু মিলে
তৈরি করেছেন শিল্পীদের সংগঠণ বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ। উদ্দেশ্য
বাঙলার গ্রামীণ শিল্পীদের দাবিদাওয়া, চাওয়া না পাওয়াকে কেন্দ্র করে একটি যৌথ
নেতৃত্বভাবনার সংগঠণ তৈরি। তাঁর আশা আগামী দিনে প্রত্যেক শিল্পীই বেঁচে থাকুন নিজের
শিল্পকে নিয়ে – সংগঠণ
সেই পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করবে। সরকার কী করেছে কী করে নি তা নিয়ে
আমরা এই সংগঠণের কর্মীরা খুব একটা চিন্তিত নই, বললেন মধুমঙ্গল। অননুকরণীয়
ভঙ্গীতে বলেন, এলেও আচ্ছা, না এলেও আচ্ছা। তিনি মনে করেন, সংগঠিত হওয়াতেই আসতে পারে শিল্পীদের
জীবনে কাঙ্খিত পরিবর্তন। একসঙ্গে
ভাবছি আমরা, এগোবোও আমরা, প্রত্যয়ী মধুমঙ্গলের জবানী। প্রত্যেক জেলায় রয়েছে সংঘের শাখা। প্রত্যেক শাখা
পরিচালিত হচ্ছে পারম্পরিক শিল্পীদের নেতৃত্বে। অসম উদ্যমে জেলায়
জেলায় ঘুরছেন তিনি তার তাঁর সাথীরা। শিল্পীদের জন্য নয়, এই প্রথম বাঙলায় গ্রামীণ শিল্পীদের
উদ্যমে, শিল্পীদের নেতৃত্বে একটি সংগঠণ তৈরি হল, বললেন সাথী ও সংঘের অন্যতম
সম্পাদক ছো মুখোশ শিল্পী নেপাল সূত্রধর। মধুমঙ্গল তাঁর ৩৫ বছরে সংগৃহীত সমস্ত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
ঢেলে দিচ্ছেন সংঘের সংগঠণ তৈরির কাজে।
তিনি আর তাঁর সংগঠণের সাথীরা পরিকল্পনা করেছেন সারা বাঙলা জুড়ে বাঙলার
লৌকিক পারম্পরিক শিল্পের আপন খোলা। হাট মরে যাচ্ছে, হাটে প্লাসটিক দখল
করে নিচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের স্থান, গ্রামবাঙলার মানুষদের জীবনে আসছে অনাকাঙ্খিত
পরিবর্তন, সেই সব জরুরি লড়াইএর পাশাপাশি প্রয়োজন গ্রামের সঙ্গে সঙ্গে শহরেরও নতুন
বাজার ধরা, বাঙলা আর বাঙালির ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে। বাঙলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পের জন্য বাঙলাজুড়ে প্রয়োজন
নির্দিষ্ট কিছু আপণের। প্রথমটি
খুলেছে কলকাতার বাঘাযতীন এলাকায়, পয়লা বৈশাখে। পরেরটি খুলছে
রায়গঞ্জে। তিনি বললেন এই বছরেই আরও চারটি আপণের পরিকল্পনা রয়েছে
সংগঠণের।
দ্বিতীয় উদ্যমটি আরও ব্যাপক। সামগ্রিক উদ্দেশ্য পূরণে, সংঘের নেতৃত্বে ১০ থেকে ২০ মে,
২০১২, গুরুসদয় সংগ্রহশালায় আয়োজিত হল একটি মেলা, গল্পবলা, সম্মাননা প্রদান,
উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রদর্শণের অনুষ্ঠান। সংঘের সঙ্গে
হাত মিলিয়েছিল কলাবতী মুদ্রা, গুরুসদয় সংগ্রহশালা এবং বাংলার ব্রতচারী সমিতি। এই প্রথম
বাঙলা তথা ভারতে প্রদর্শিত হল মধুমঙ্গলের ৫০টিরও বেশি ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্ম। এই শিল্পকর্ম
তিনি দান করেছেন গুরুসদয় সংগ্রহশালায়। মধুমঙ্গলের উদ্যমস্পর্শে আর সংঘ ভাবনার টানে এই মেলাতেই নিজ যোগ্যতাতেই
নেতৃত্বস্থানে উঠে এসেছেন ২৪ পরগণার পাট শিল্পী নারায়ণ পৈত, বেলপাহাড়ির পাথর
শিল্পী শ্যামল মিস্ত্রী, রঘুনাথপুরের শাঁখ শিল্পী নিতাই নন্দী, কোচবিহারের বাঁশ
শিল্পী গৌরাঙ্গ বর্মণ, বীরভূমের প্রসাধণ শিল্পী শেখ বাদলএরমত নানান পরম্পরাগত শিল্পী,
যারা আগামী দিনে বাংলার ঐতিহ্যকে এগিয়ে আরও নিয়ে যাবেন।
সংগঠণের মাদকতা অথবা চায়ের দোকানে দিনগুজরানের থোড়-বড়ি-খাড়া অথবা
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কোনও কিছুই মধুমঙ্গলেকে তাঁর শেকড়় থেকে উপড়ে ফেলতে পারে
নি। প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্টের নামে বাঙলার ঐতিহ্যের ওপর সরকারি প্রহারেরমত
প্রকল্পের হাতছানি মধুমঙ্গল এড়িয়ে গিয়েছেন অনপনীয় পারম্পরিকতায়। মধুমঙ্গল আজও
তাই বাঙলার অন্যান্য লৌকিক পারম্পরিক শিল্পীদের আস্থা আর্জন করে চলেন তাঁর
অননুকরণীয় প্রত্যহিকতায়, সরল সাধারণ জীবনযাত্রায়, বন্ধু শিল্পীদের অসাধারণ সম্মান
প্রদর্শণের যোগ্যতায়, আর নিজেকে লুকিয়ে রেখে অন্য শিল্পীদের সামনে আনতে পারারমত বিরল
নেতৃত্বদানের যোগ্যতায়।
No comments:
Post a Comment