পারম্পরিক শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান এই বাঙলায় একটি
শিল্পের জন্য নিবেদিত দম্পতির দেখা পাওয়া সাধারণ ঘটনা। কিন্তু একই দম্পতি দুটি আলাদা পারম্পরিক শিল্পে নিজেদের
দক্ষতাকে চরমতম সীমায় তুলে নিয়ে গিয়েছেন, এবং সংগঠণও করছেন, এমন ঘটনা খুবই
ব্যতিক্রমী। এরকমই এক আলাদা
শিল্পী দম্পতি কোচবিহারের শহরের গৌরাঙ্গ বর্মণ, গীতা বর্মণ।
গৌরাঙ্গ
বর্মণের জন্ম অসমের গোয়ালপাড়ার বরপেটা রোডে। ছোটবেলা থেকেই তিনি দোকানে দোকানে রেডিমেড কাপড় সরবরাহ
করতেন। যিনি জন্মশিল্পী, তিনি জানেন না, এক
শিল্পীত ভবিষ্যত অপেক্ষা করে রয়েছে তাঁর জন্য। তখন তিনি নওগাঁও গ্রামে দুই মুসলমান ভাইএর একজনের
দোকানে ব্যবসা করেন। আরএক ভাই বাঁশের নানান ধরণের শিল্পীত দ্রব্য তৈরি করতেন। আমি বহুদিনই টাকা আনতে গিয়ে সেই শিল্প দোকানে বসে তাঁদের দেখাদেখি বাঁশ
কাটা ছোলার কাজ শিখে গিয়েছি, বললেন গৌরাঙ্গ। যে দোকান থেকে অর্থ রোজগার করছি, সেই দোকানের থেকে বেশি আকর্ষণ করত পাশের
শিল্পেভরা দোকানটি।
ইতোমধ্যে এক
পারিবারিক গোলোযোগে সবই হারালেন। বিয়ে করেছেন কোচবিহারের মেয়ে গীতাকে। হাতে একটাও টাকা নেই। এক বাঁশ শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে বসতি স্থাপন করলেন
কোচবিহারে, শ্বশুরবাড়ি শহরে, লঙ্কাবর, তোর্সার চরে। আটের দশকে আমি নিজে তাঁর কাজের কথা
শুনে গৌরাঙ্গদার বাড়ি এসেছি। দেখেছি। কী
অবস্থায় তিনি থাকতেন স্ত্রীকে নিয়ে। বাড়িতে
হামাদিয়ে ঢুকতে হত। চেষ্টা করেছি তাঁর শিল্প যাতে বাজার পায়, জানালেন বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘের যুগ্মসম্পাদক
মধুমঙ্গল মালাকার। আজ কোচবিহারের রাজেন তেপথির গৌরাঙ্গ-গীতার আধপাকা বাড়িতে ভিড় লেগে থাকে পরম্পরিক
শিল্পী সংঘের কর্মীদের।
তখনও খুব কষ্টে
দিন কাটে। তাঁর পাশে দাঁড়ালেন গীতা। পাটের নানান দ্রব্য তৈরি করতেন গীতার দিদা। গীতাও শিশুকাল থেকেই শিখে নিয়েছেন পাট শিল্পের অক্ষহৃদয়। গৌরাঙ্গ দক্ষিণাপণে দ্রব্য সরবরাহ করেন। সেখান থেকেই পাটজাত শিল্পের নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে এসে
স্ত্রীর হাতে দেন। বাঁশের পাশাপাশি তৈরি হতে শুরু হল পাট দ্রব্যও।
তখনও আর্থিক
সাফল্যের মুখ দেখতে পাননি। ৮৭তে কপাল ঠুকে কোচবিহারের রাসমেলায়
অংশ নিলাম। বিক্রি
হল সাত হাজার। নয়ের দশকের প্রথম দিকে আলাপ রাজ্য শিল্প দপ্তরের বড়
কর্তার সঙ্গে। তিনিই তাঁকে
প্রথম রেজিস্ট্রেশন করান। আর আমাদের পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। শুধুই শিল্পীত ইতিহাস। জেলা পুস্কারের পর রাজ্য পুরস্কার,
এক শিল্পীর জীবনে যা পাওয়ার কথা সবই তাঁরা পেয়েছেন।
যখন তাঁর
অবসরের বয়স, নতুন যাত্রা শুরু হল বর্মণ দম্পতির। স্থানীয়দের বাঁশ আর পাটের কাজ শেখানো
শুরু করলেন। আজ কোচবিহারের
তোর্সাপারের লঙ্কাবর আর কালজানির আমবাড়ি গ্রামে অন্ততঃ পাঁচশো পরিবার বাঁশ আর
পাটের কাজ করে পরিবারের ভরণপোষণ করেন। নয়ের দশকে গীতা পঞ্চায়েতে উপপ্রধানও
হন।
লঙ্কাবরের
মেয়েদের নিয়ে আজ বর্মণ দম্পতি, শিল্পীদের নিজস্ব সংগঠণ বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও
বস্ত্র শিল্পী সংঘের শেকড় কোচবিহারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আজ সংঘের সব থেকে বড় সংগঠণ তৈরি হয়েছে কোচবিহারে। আগামী সেপ্টেম্বরে(বাংলায় ভাদ্র
মাসে) সংঘের উত্তরবঙ্গ সম্মেলন আয়োজন করবেন ঘুঘুমারি, কালজানি আর লঙ্কাবরের পাটি, বাঁশ
আর পাট শিল্পীরা।
তিনবার খুবই
বড় স্ট্রোক হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা গৌরঙ্গ বর্মণকে আগলে রাখেন গীতা। উদ্বিগ্ন স্ত্রীকে নিয়ে গৌরাঙ্গ চরম সক্রিয়তায় মিটিং করে চলেন- কখনও সম্মেলন
সফল করতে, কখনওবা সংগঠণকে মজবুত করতে। নিজেদের শিল্প দক্ষতা সম্বল করে,
শিল্পী খুঁজে, নীরবে তাঁদের সংগঠিত করতে বর্মণ দম্পতি আজও ব্যতিক্রমী শিল্পীত উদাহরণ।
No comments:
Post a Comment