কয়েকটি সোজা কথা
স্পষ্টভাবে চোখে আঙুল দিয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। এই
সমীক্ষাগুলো থেকে পরিস্কার যে, ভারত কৃষি প্রধাণ দেশ হলেও দেশের সমাজ কিন্তু শুধুই
কৃষি নির্ভর ছিল না। কৃষিজীবির সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশের
আশেপাশে। ব্রিটিশদের তৈরি করে দেওয়া ভারত সমাজ ধারণার এক্কেবারে
ঠিক উল্টো পিঠ।
সনাতন ভারতীয়
সমাজ প্রত্যেক স্রষ্টাকে, সে কৃষকই হোক অথবা কারিগর, দিত সামাজিক নিরাপত্তারভাব। বাঙলা তথা
ভারতজুড়ে এই মাতৃস্নেহেভরা, মায়া-মমতাময় নিরাপত্তাভরা সমাজ ছিল বলেই শুধু
কৃষিভিত্তি নয়, ৭০শতাংশ জনসমাজ অন্যান্য ধরণের কাজ করতেন, করতে পারতেন এবং
সৃষ্টিশীলতায় বাঁচতেন। তবেই না এই দেশের কারিগরেরা দিল্লির লোহার মিনার বা
মদনমোহন অথবা বাচ্চাওয়ালি কামানেরমত শয়ে শয়ে বছর খোলা আপাশের তলায় পড়ে থাকা মরচে
ছাড়া লোহার পণ্যদ্রব্য বানিয়েছিলেন অথবা সহস্রাব্দর পর সহস্রাব্দ ধরে
(পোড়া)মাটিরবাড়ি (মন্দির) আজও সারা বাঙলায় অজর অমর, অসমের রংঘর ৫০০ বছর ছাড়িয়েও
সগৌরবে মাথাতুলে দাঁড়িয়ে(আর বর্তমান প্রযুক্তির সিমেন্টের বাড়ি সর্বাধিক ৪০ বছর
পরেই ভেঙে পড়তে থাকে), ইওরোপে ড. জেনারের আবির্ভাবের আগেই বাঙলার ভিষগেরা বসন্তের
টিকা দিতেন অবহেলে, হাড়জোড়া ভিষগ অথবা কাটা অঙ্গ জোড়ার শল্য চিকিত্সক প্রায়
প্রত্যেক এলাকাতেই মিলত, নদিবিধৌত পলিসমৃদ্ধ বাঙলা নয় চেঙ্গলপট্টুতে আজ থেকে ২৫০
বছর আগে খণ্ডিত জমির বাত্সরিক উত্পাদকতাই ছিল একর প্রতি ৬-৭টন ধান, দামাস্কাস
তরোয়ালের লোহার মূল পিণ্ডটি রপ্তানি হত ভারত থেকে, অসম্ভব মমতায়, অপরিমিত যত্নে
আর পরিশ্রমে আর ভলবাসায় তৈরি হত ক্যালিকো আথবা মসলিনেরমত স্বর্গীয় কাপড় শুধু
ঢাকার জঙ্গলবাড়ি নয়, সারা বাঙলার কুড়িটারমত স্থানে, লেখা হয়েছে মাহুতদের শিক্ষার
জন্য হস্তিবিদ্যার্ণব পুঁথি(অসমের মাজুলির আউনিআটি সত্রে রয়েছে), অথবা কৃষিকর্ম
শেখাতে লেখা হয় কৃষিপরাশর, বাঙলা তথা ভারতের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করতে
গিয়ে অন্য দেশ অথবা নতুন কোনও মহাদেশ আবিষ্কারএর অস্বাভাবিক কৃতিত্ব দাবি করে
বসেন নি, নতুন দেশ আবিষ্কার করে সেই দেশের মানুষমেরে ধনসম্পদ আর জ্ঞাণ
চুরিতো দূরস্থান, ভারতীয়রা দেশের নানান স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে জ্ঞাণ আর
প্রযুক্তি বিলিয়েছে সারা বিশ্বে, নিজের দেশের ক্ষতি করে বিদেশে সে সময়ের শ্রেষ্ঠতম
জ্ঞাণতপস্বীকে পাঠিয়েছে জ্ঞাণবিতরণের জন্য, বাঙলা-বিহারের দেড় লাখ গ্রামে ১৮৩৮ সাল
পর্যন্ত কর্মক্ষম ছিল এক লাখেরও বেশি বুনিয়াদি আর উচ্চ পাঠশালা, সমাজের রীতি নীতি
মেনেই সেগুলো চলত জনগণের অর্থে, একই পাঠশালায় একইসঙ্গে পড়ত আর পাড়াতেন আজকের
ইওরোপিয় সমাজতত্বের ভাষায়, নিম্নবর্ণতম থেকে উচ্চবর্ণের মানুষজন, ডোম আর ব্রাহ্মণ
বটু ও শিক্ষক পড়ত আর পড়াতেন, জাতপাতের ব্যাপক ভেদাভেদের কল্পকাহিনী অনেক পরের
শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রচনা, এলাকাভিত্তিক পাঠসূচি ছিল সেসব পাঠশালাগুলোতে, পাঠদীন
কী হবে তার জন্য ছিলনা কোনও কেন্দ্রিয় নির্দেশক, ইওরোপের অনেক আগেই সরস্বতী-হরপ্পা
সভ্যতায় গড়ে উঠেছে ড্রাই ডক, শূণ্যের ব্যবহার ছিল ব্যপ্ততম, দশমিক বা বাইনারি
পদ্ধতির প্রচলন অথবা পাইএরমান বা পৃথিবীর গোলার্ধের মান নির্ণয় হয়েছে ভারতেই,
দক্ষিণ ভারতে কলণ বিদ্যার সূচনা হয় লিবনিত্জ বা নিউটনের বহু আগেই জয়স্থদেবেরমত
মানুষের মণীষায়, এলাহাবাদেরমত গরমতম এলাকায় তৈরি হত বরফ, পটুয়াদের বা মস্করীদের
চিত্রকর্ম সারা দক্ষিণ এশিয়ার নানান বৌদ্ধমঠের চিত্রকলায় ছড়িয়ে রয়েছে আজও,
গুজরাটের যে বন্দরথেকে এত পরিমান বাঙলার সুপুরি রপ্তানি হত সেই বন্দরের নামই হয়ে
যায় সোপারা, যে তাঁতে ইওরোপিয় তাঁতিরা মোটাচটও বুনতে পারতেন না, সেই তাঁতেই তৈরিহত
ভালবাসাময় ক্যালিকো অথবা অদৃশ্যসম মসলিন, ভারতে সেদিনও প্লাসটিক সার্জারি চালু ছিল। এক নিশ্বাসে
যে সব বলাগেল তার বাইরেও হাজারো নিত্যনতুন গবেষণা করতেন সাধারণ গ্রামীণেরা,
নিজেদেরই জোরে।
পশ্চিমের
ব্যবসায়ীরা সেদেশের তৈরি কোনও দ্রব্য এ দেশে সহজে বিক্রি করতে পারত না। এদেশের
ইওরোপিয় দ্রব্য ব্যবহারেরমত স্থূলতাই তৈরিই হয়নি তখনও, শহর অথবা গ্রামীণ সমাজে, ফোরেন গুডস্ ছিল সর্বতোভাবে পরিত্যজ্য। আঠেরশ শতাব্দ
পর্যন্ত ভারত থেকে শিল্প-স্বাস্থ্য-অন্যান্য প্রযুক্তি ভারত তথা বাঙলা থেকে রপ্তানি
হত, আর অসম্ভব সামাজিক নিরাপত্তার পরিবেশে বানানো এই পণ্যদ্রব্যগুলি কিনতে বিদেশ
থেকে সোনা-রূপা বয়ে আনত ইওরোপিয়রা, যার অপভ্রংশ রূপি বা রূপিয়া(রূপো) আমরা আমাদের
মুদ্রা ব্যবস্থায় আজও বহন করে চলেছি। মন্দিরভিত্তিক মান্যম সংস্কৃতির
বৃহত্তর সামাজিক ব্যবহার থেকেই প্রমাণিত হয়, লৌকিক অথবা সামাজিক ধর্মপালনব্যবস্থা
আর রাষ্ট্রিয় ধর্মীয় বিষয়আশয়, দুটো কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা বিষম বস্তু। ইওরোপ থেকে আধুনিকতা
অথবা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধার করে এনে ভারত রাষ্ট্র নিজেদের পায়ে কুড়ুল মেরেছে কীনা
আজ নতুন করে ভাবা দরকার।
নব এক সভ্যতার স্রষ্টা
গ্রামীণেরা এমন সভ্যতা তৈরি করেছে, যে সভ্যতা বৈরাগ্য
প্রধাণ। মহিলারা শ্মশানে-মশানে ঘোরা, গায়ে ছাই মাখা, গাঁজা
খাওয়া, মহিষের পিঠে চড়া, নটরাজ শিবেরমত বর চায়। সন্তান শুধুই
দুধেভাতে থাকলেই সে সুখী(মনেরাখিনা সেই প্রবাদপ্রতীম স্তবকে কবি কিন্তু সন্তান
কথাটি উল্লেখ করছেন, ছেলে বলছেন না – তবুও ভারতীয় সমাজ পশ্চাদমুখীনতার ছাপ্পা পেয়ে যায়)। মহিলারা সমাজ তৈরি করেন। তাদেরই
চাহিদাই এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাদের হাতে তৈরি প্রজন্মও অমানবিক
চাহিদার বাইরে বেরিয়ে এসে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের গড়ে পিটে নিতে চান।
চাহিদাহীনতাই
ভারতীয় সভ্যতার হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকার হয়ত মূলমন্ত্র।
শ্রীশঙ্করাচার্য, শ্রীমন্ত শঙ্করদেব, শ্রীচৈতন্যের বৈরাগ্যের পথ ধরেই তৈরি হয়
ভারতীয় সভ্যতার ভিত্তিভূমি। আজকের সাম্রাজ্যপ্রতীম রামকৃষ্ণ মঠ
তৈরির উদ্যমে বিবেকানন্দজীর বিরাগ ছিল স্পষ্ট। এই বিষয় নিয়ে
খুব বেশি আলোচনার সুযোগ নেই তবুও বলাযাক সংঘের সংগঠণের পরিকাঠামো বাড়ানো নিয়ে
তাঁর সঙ্গে অনুগামীদের সঙ্গে স্পষ্ট মতবিরোধ হয়েছে।
ইওরোপের বিশ্বধংসী
দর্শন সনাতন ভারত সচেতনভাবেই বর্জন করেছে। হয়ত এই সোজা কথাটা ভারতের অসাধারণে সাধারণ মানুষ, আর
সমাজ স্পষ্টভাবে জানতেন। যে সমাজ তারা গড়েছিলেন হাজার হাজার বছরের পরিশ্রমে,
জ্ঞাণে, সেই ভারত সমাজ ধংস করতে ইওরোপিয় নীতি প্রয়োগ করতে দেখে, ব্রিটিশদের পথের
বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল পলাশি চক্রান্তের পর থেকে ১৭৬৩ থেকে
ফকির-শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব সন্ন্যাসী স্বাধীণতা সংগ্রামীদের আহ্বানে। ব্রিটিশ-পূর্ব
বাঙলা নিজের সমাজ, নিজের ব্যবসা, নিজের উত্পাজন, নিজের প্রযুক্তি –নিজের চলার পথ নিজেরমত করেই খুঁজে নিয়েছিল কয়েক হাজার
বছরের সভ্যতার বিকাশের পথ বেয়ে নানান পরীক্ষা-নীরিক্ষায়। আদ্যোপান্ত ইওরোপকেন্দ্রিক বাম শহুরেরা সামাজিক
নিয়ন্ত্রণকে বলেছেন কুসংস্কার। ব্যবসায়ী, শিল্পী আর শ্রমিকদের, এই সামাজিক বাধাবন্ধের,
সামাজিক নিরাপত্তারমধ্যে কাজকরাকে বলেছেন সামন্ততান্ত্রিক মূঢ়তা, অজ্ঞতা।
ভারতের অন্ততঃ খেদের
প্রয়োজন নেই। বাণিজ্যিকভাবে
উত্পাদন করে, প্রকৃতির ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করে অপরিমেয় লাভের মুক্তমনা ধংসলীলার
যজ্ঞভূমির বিকাশ ঘটিয়েছে ব্রিটিশ বণিকেরা। এর প্রভাব আজ টের পাচ্ছে স্বপ্নের মহাদেশ ইওরোপ আমেরিকা। আজ সামাজিক
চাপে ইওরোপে বড় উতপাদনের কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুখে। ঠিক আড়াইশ
বছর আগে কড়া সামাজিক রীতিনীতির বাধাবন্ধ মেনে ভারতীয় তথা বাঙলার সমাজ বড় বাণিজ্যিক
উতপাদনের বিরুদ্ধে আড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ বণিকেরা ইওরোপের সমাজ-রাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে
এই প্রকৃতি বিরোধী উত্পাদন প্রক্রিয়া আর অবাধ বাণিজ্য চালু করেছিল। এই দুএর যোগফল
শিল্পবিপ্লব।
আরও একটা ছোট
কথা বলা যাক। ইওরোপিয় ব্যবসায়ীদের বহু আগে থেকেই বাঙলার ব্যবসায়ীরা
বিশ্বের নানান প্রান্তে ব্যবসা করতেন। সাধের গন্তব্য আবিষ্কার করতে গিয়ে
তাঁরা অন্যকোনও মহাদেশ আবিষ্কার করে তার নাম ভারত রাখার কথা স্বপ্নেও ভাবতে
পারেননি। সেই সমুদ্র বিদ্যার জ্ঞাণ তাদের ছিল। ভারতীয় বণিকেরা মহাদেশ আবিষ্কার করে লুঠপাট করে,
খুন করে, রিক্ত করে আসে নি। অথবা সেই দেশের মানুষকে দাস
বানানোরমত কাজ করেনি। তাই হয়ত তাদের কখোনোই মনে হয়নি, বিশ্বজয়ী পণ্যগুলির
বাজার আরও আরও বাড়ানো, মনে হয়নি বিশ্বে নতুন নতুন চাহিদা তৈরি করা প্রয়োজন। অথচ (অ)প্রয়োজনে ইওরোপ একাই এশিয়া, আমেরিকা আর আফ্রিকাকে
উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছিল শতাব্দর পর শতাব্দ।
ভারতীয় সমাজ
বণিকদের বিশ্ব বাণিজ্যে সেই অসম্ভব লাভ করার ছাড়পত্রও কোনও দিন দেয় নি। বণিকদের কাজ
বণিকবৃত্তি করা, এই দায়টি সমাজ তাদের নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। সেই কর্মের
বাইরে পা রেখে, তুলাযন্ত্র সরিয়ে রেখে, তরোয়াল নিয়ে দেশ-মহাদেশ শাসন করার, লুঠ
করার অথবা খুনের অধিকার তাদের সমাজ দেয় নি। এ কথা স্পষ্টভাবে আজ বলে দেওয়া যাক। উত্পাদকের কাজ ছিল কর্মশালায় নির্দিষ্ট কাজ করা। তারা সেই কাজকে বিকাশ করার দিকে বেশি নজর দিয়েছে। সমাজ তাকে
প্রার্থিত সামাজিক নিরাপত্তা দিয়েছে, রক্ষা করেছে সমস্ত দুর্বিপাকের হাত থেকে।
পারম্পরিক বাঙলা
ভারতের উত্তর আর দক্ষিণ এই দুই প্রান্তের সামাজিক গড়নের
বৈশিষ্ট্যের কথা কয়েক স্তবক আগেও আলোচনা করা গেছে। বাঙলাতেও
কিন্তু দেখা যাবে একই দর্শণের প্রতিধ্বনি। সারা ভারতের সমাজ গঠণের মধ্যে একই
দার্শণিক সাজুজ্য বজায় ছিল। প্রত্যেক সামাজের রীতিনীতিতে বেশ
কিছু পার্থক্য থাকলেও, ভারতের সনাতন, সমবায়ী সমাজগুলোর গঠণ-প্রশাসন-অর্থনীতির
দর্শনের মধ্যে কিন্তু মূলগত পার্থক্য ছিল না প্রায়।
কৃষক কারিগরদের
নিয়ে পত্তন হত একটি গ্রাম সমষ্টি, সেখানেই চাষের জমি, চারণভূমি, নানান শিল্পের
কারখানা। ইওরোপের অনুকরণে এগুলোকে হস্তশিল্প বলার প্রচলণ হয়েছে-
ভালই। ব্রিটিশ শিল্পবিপ্লব প্রণোদিত, নানান
অপচয়মুখী মস্তবড় দৈত্যসম এককেন্দ্রিক উত্পাদন ব্যবস্থা অখবা প্রশাসনিক দর্শনের
দিক থেকে ভারতের গ্রামীণেরা বরাবরই মুখ ঘুরিয়ে থেকেছিলেন। তাঁরা আজ আর
পারছেন না। শিল্প বিপ্লবের ধ্বজা অনুসরণকরে ইওরোপিয় অর্থনীতির
বিকাশের ধারা ভারতে ইংরেজ শাসনের পথ ধরে প্রোথিত করা হয়েছে। সেই অর্থনীতির
উপজাত গ্রামীণদের গফুর মিঞার পথ ধরতে হয়। আকালের চরমতম গ্রাসে পড়ে গফুর মিঞা কিন্তু মহেশকে কেটে
খেয়ে উদরপূর্তি করেন না। গরু
তাঁর পরিবারের একজন, শুধুমাত্র রোজগারের জন্য পোষা প্রাকৃতিক সম্পদটুকু নয়, যাকে
ব্যবহার করা যায় যেকোনও সময়েই। অসময়ে সে তার পরিবারপের একজনকে ব্যবহার করে নিজেকে
বাঁচাতে চাননি। যে লেখক বাঙালি আর মুসলমানদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ
আয়োজনের কথা বলেন, তিনিও কিন্তু গফুরকে দিয়ে মহেশকে নির্বিচারে হত্যা করে খাওয়ার
দৃশ্য লিখে উঠতে পারেন নি। ইওরোপিয় মানদন্ডে গফুর তুচ্ছ, এক
দরিদ্র প্রান্তিক ধর্মীয় সংখ্যালঘু জন। অথচ ভারতীয় সনাতন সভ্যতার ন্যুনতম এক সদস্য, গফুর মিঞা মানবিকতার
প্রশ্নে এক সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলাযাবে না, এটিই এই সভ্যতার সাধারণতম ঘটনা, ভারতীয়
গ্রামীণ সভ্যতার এটিই দর্শণ।
সাধারণ এ
দর্শণে আপাদমস্তক জারিত ছিল বলেই, ভারত সভ্যতা নিজের পায়ে হাজার হাজার বছর ধরে
বেঁচে এসেছে, অন্য সভ্যতাকে বাঁচিয়ে এসেছে। পুরুষানুক্রমে গফুরেরমত কৃষকেরা জমির
ফসল ফলান, শিল্পী কর্মশালা চালান, ব্যবসা করেন, ব্যবসায়ীরা উভয়েই রাজস্ব দেন- এতেই
শেষ হয়ে যায় রাজশক্তির সঙ্গে গ্রামীণের সম্পর্ক। তাঁরা
পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে নিজেদেরমতই সমাজের সমৃদ্ধি বজায় রাখেন।
কারিগরেরা-প্রযুক্তিবিদেরা গ্রামের প্রয়োজন মেটান, গ্রামের হাটেই তাদের বিক্রিবাটা
হয়। তবু আজও তাঁরা সারা ভারতের প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মেশাতে ছুটে যান মেলায়
মেলায়, তীর্থে তীর্থে, জনপদে জনপদে। স্বাধীণতার পরেও ইওরোপিয় লুঠেরারাজের
তৈরি করা অর্থনীতিতে যথাসম্ভব আলাদা থেকে গ্রামীণেরা আজও ভারত সভ্যতাকে বয়ে নিয়ে
চলেন অতি মমতায় আর সারল্যে।
এই ভাঙা সময়ে একটাই
আশাই জেগে থাকে, আজও গ্রামীণেরা নিজের শেকড়ে, ঐতিহ্যে, পরম্পরায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
No comments:
Post a Comment