বিধিনিষেধ মানেই কুসংস্কার নয়
প্রকৃতির নানান আদরের বস্তুকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় ঘরের
মানুষেরমত বেড়ে উঠত ভারতীয় সমাজের প্রত্যেকটি স্তর আর মানুষ। জল, জঙ্গল,
খণিজ দ্রব্যেরমত প্রকৃতির দেওয়া নানান অমূল্য অভাবনীয়কে নির্বিচারে প্রাকৃতিক
সম্পদ ছাপ্পা দিয়ে, নাগরিক সমাজে কৃত্রিমতম চাহিদা তৈরি করে, প্রকৃতিকে ধংস করার
শিল্পবিপ্লবজাত ইওরোপমুখী আধুনিক অপচয়ী সমাজ-দর্শণের বিরোধী ছিল ভারতের সমবায়ী
গ্রামীণ সভ্যতা।
হাজার হাজার
বছরের বিশ্বের নানান প্রান্তের লুঠেরাদের নানান ধরণের অত্যাচার সহ্যকরে, নিজেকে
ধংস করার প্রলোভন সামলে, দৈনন্দিনের জীবনকে সাদাসিধে রেখে, প্রকৃতিকে যথাসম্ভব কম
ব্যবহার করার কয়েকটি সহজ সাধারণ নীতি তৈরি করতে পেরেছিল এই সমাজ। ইওরোপিয়
লুঠবাদী লেজা ফেয়ার নীতির বদলে সমাজে ছিল সাধারণ কিছু বিধি নিষেধ, যার প্রায়োগিক
নীতিতে কিছু লৌকিক আর ধর্মীয় প্রথার বিকাশ ঘটেছে। এই প্রথায় জনগণকে কয়েকটি সামাজিক নীতি পালন করতে হয়, আর
নিয়মিত সময় ধরে বেশ অনেকটা পারিবারিক আচার আচরণ অবশ্য মান্যকরাও প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
প্রত্যেকটি
ভারতীয় গ্রামসমাজ নিজেদের তৈরি আলাদা আলাদা শাসন-প্রশাসন নীতি মেনে চললেও, আদতে
একটি সাধারণ বিকেন্দ্রিকতার দর্শণ বাস্তবে পালন করতে সমস্ত বিবাদ ভুলে গ্রামগোষ্ঠী
ছিল এক্কাট্টা। গ্রাম সমাজ স্পষ্ট মনে করত, সমাজের নানান ধরণের
কাজকর্মে, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক শক্তির হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছনীয় এবং বিষবত্ পরিত্যজ্য। প্রাথমিকভাবে
ভারতীয় সমাজ রাষ্ট্র বিরোধী না হলেও রাষ্ট্র উদাসীন। ভারত জোড়া
সমবায়ী সমাজে সমাজে নিত্য নিয়মিত আদান প্রদান বিদ্যমান ছিল সেদিনও।
খাজনা দেওয়া ছাড়া,
রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক নানান আইন, নীতি আর কাজকর্মের সঙ্গে, অর্থনীতির ওঠাপড়ার
সঙ্গে, রাষ্ট্রব্যবস্থার ভাঙাগড়ার সঙ্গে, নাগরিক সভ্যতার সৃষ্টি-ধংসের সঙ্গে, ভারতবর্ষের
উত্তরপ্রান্ত থেকে দক্ষিণপ্রান্ত, পূর্বতমজনপদ থেকে পশ্চিমতমজনপদের গ্রামগুলির রোজকার
জীবনের খুব বড় সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
ব্রিটিশদের
হাতে হঠাত প্রখ্যাত মনুস্মৃতি একমাত্র কয়েকটি সমাজেই কার্যকর ছিল।
তিনটি গ্রাম সমীক্ষা
বিশাল বিশাল মন্বন্তর ঘটিয়ে, জ্ঞাণ চুরি আর অপরিমিত
সম্পদ লুঠকরে ছিবড়ে করে দেওয়ার পরও ১৯০০ সনের আদমসুমারিতে ব্রিটিশ শাসন বস্থার
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমলা রোজ সাহেব(বাঙলার নবজাগৃতি, বিনয় ঘোষ) বিষ্মিতভাবে
বলছেন, পাঞ্জাব প্রদেশের গ্রামগুলির অসম্ভব আত্মনির্ভরতার কথা। প্রত্যেক
গ্রাম সমবায়ে জনগণের প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র তৈরি হত, নানান শ্রেণীর বৃত্তিজীবি
কারিগরদের কারিগরিতে। তিনি বিভিন্ন বর্ণের করিগরদের ব্যক্তিগত উদ্যমের
স্বাতন্ত্র্য দেখেননি। অথচ ভারতের গ্রামসমাজের স্বয়ংসম্পূর্ণতার ছবি স্পষ্ট
দেখছেন।
এই
আদমসুমারিটির প্রায় ৫৫টি বছর(১৮৪৫) আগে আর এক কোম্পানিকর্তা গুডউইনও বলছেন দক্ষিণ
ভারতের এক স্বতন্ত্র গ্রাম সমাজের কথা। বলছেন গ্রামের মধ্যে নানান ধরণের জীবিকার
পারস্পরিক নির্ভরতার কথা। দিচ্ছেন নানান শিল্পী, প্রশাসক আখবা প্রযুক্তিবিদের বর্ণনা। গুডউইন বলছেন,
গ্রামে পাতিল আর কুলাকার্ণিদের রাজস্ব আদায় আর নির্ধারণে দায়িত্ব ছিলেন। গ্রামের মধ্যে
তাদের প্রভাব সর্বাধিক (পশ্চিমি দৃষ্টিতেতো বটেই)। ছুতোরেরা
গ্রামের নানান কাজের কাঠের হাতিয়ার গড়তেন, গাড়ি তৈরি করতেন, মেরামত করতেন, তাই
সমাজে তাদের সম্মান ছিল অনেক ওপরে। এঁরা ছিলেন কারিগরদের প্রধান। এরপর লোহারদের
স্থান। লোহার যন্ত্রপাতি তৈরি আর তা মেরামতও করতেন। অন্যান্য
কারিগরেরা নানান ধরণের কাজ করতেন। মজুরি ছাড়াও তারা সমাজে অন্যান্য
সুযোগ সুবিধে পেতেন। তারা জমি পেতেন চাষ করার জন্য। নিজেরা না
করতে পারলে(সাধারণতঃ করতেন না), চাষ করতেন চাযীরা। চাষের পর
নিজেদের অংশ তুলে রেখে জমির উত্পাদনের পাওনা তারা বেঁটে দিতেন কারিগরদের মধ্যে। আর একমাত্র
জমিরস্বত্ব রাখতে পারতেন না সেচের কাজে সাহায্য করা প্রযুক্তিবিদেরা। সারাবছর তাদের
দেখভাল করত সমাজ কেননা তারা না হলে যে চাষকর্মটাই আটকে যেতে পারে(এই দুটি উদাহরণের
সূত্র বিনয ঘোষ- বাঙলার নবজাগরণ)।
ছএর দশকে
তাঞ্জাভুর তামিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজএর তৈরি করেন ধরমপালজী। তিনি
বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু আশ্চর্যজনক তথ্যসম্বলিত পুঁথি খুঁজে পান। ভারত গবেষণায়
যে পুঁথিগুলিক দান অভূতপূর্ব। এগুলি আজ চেঙ্গলপেট্টু পুঁথি নামে
খ্যাত। স্টাডিজএর পরের দিকের অধিকর্তা ড. জে কে বাজাজের মুখেই
চেঙ্গলপেট্টু পুঁথির কথা শুনি, “Startling features of Tamil society in the 18th century emerge from
these palmleaf accounts. Between 1762 and 1766 there were villages which
produced up to 12 tons of paddy a hectare. This level of productivity can be
obtained only in the best of the Green Revolution areas of the country, with
the most advanced, expensive and often environmentally ruinous technologies.
The annual availability of all food averaged five tons per household; the
national average in India
today is three-quarters ton. Whatever the ways of pre-British Indian society,
they were definitely neither ineffective nor inefficient.”
ধরমপালজী
চেঙ্গলপট্টু(আজকের চেন্নাই) এলাকা সমীক্ষার কথা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছেন। এটি মন্দিরভিত্তিক সমবায়ী সংস্কৃতির এক ভারতীয় রূপ। এলাকার
মন্দিরগুলি যে জমি ভোগ করত, তার নাম মান্যম। সেই জমির উদ্বৃত্ত দিয়ে নিজের ব্যয়
ছাড়াও নানান ধরণের প্রযুক্তিবিদ-বিদ্যাজীবির জীবিকা এমনকী অন্য ধর্মের পরিকাঠামোর
ব্যয় নির্বাহ করতে হত মন্দিরের রোজগার থেকে। অথচ এই প্রযুক্তিবিদেরা কেউ কিন্তু
মন্দিরের কর্মচারী ছিলেন না, অথচ নির্দিষ্ট সামাজিক কাজে সারা জীবনের জন্য দায়বদ্ধ
থাকতেন। মন্দিরের এই কাজের কোনও আইনি বাঁধাবাঁধি ছিলনা। কিন্তু
প্রত্যেকেই নিজের নিজের দক্ষতা অনুযায়ী ঠিক করে নিয়েছিলেন নিজেদের কাজ সমাজ, মানুষ
আর প্রকৃতির প্রতি অসম্ভব মমত্ববোধে। আজ কেন দুর্দশা, কেন আমরা সেই সমাজের ধারে পাশে পৌঁছতে
পারছিনা, সেই সহজ প্রশ্নের উত্তরে ধরমপালজী বলছেন, “Since we have lost practically all contact
with our tradition, and all comprehension of our chitta and kala, there are no
standards and norms on the basis of which to answer questions that arise in
ordinary social living. Ordinary Indians perhaps still retain an innate
understanding of right action and right thought, but our elite society seems to
have lost all touch with any stable norms of behavior and thinking. The present
attempt at imitating the world and following every passing fad can hardly lead
us anywhere. We shall have no options until we evolve a conceptual framework of
our own, based on chitta and kala, to discriminate between right and wrong,
what is useful for us and what is futile.” (http://www.cpsindia.org/annam_hindu.html)
ধরমপালজীর
কথা আজ প্রায় দৈববাণীরমত মনে হয়।
No comments:
Post a Comment