১৭৫৭র ঠিক পর পরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশিয় ঐতিহ্যকে ভারতের মাটি থেকে
ধুয়ে ফেলতে উদ্যেগী হয়ে উঠল। ইসলামি আমলে যে উদ্যম নিতে ভয় পেত সামন্ততন্ত্রর প্রতিভূ মোঘল সম্রাট,
রাজসভার বুদ্ধিজীবিরা, সেই কাজগুলি চোখের পলক না ফেলে সুচারু রূপে অবলীলায় সমাধা
করেছে গণতন্ত্রের ধুয়াধরা ইংরেজ প্রশাসক, ভারতীয় বুদ্ধিজীবি আর বিদেশি
ধর্মপ্রচারকেরা।
কোম্পানির আমলারা, পোষা বুদ্ধিজীবিরা এদেশের নানান ধরণের ধর্মাচারণকে হিন্দুত্ব ঘোষণা করে। দেশের নানান ধর্মাচরণকে একদেহী হিন্দুধর্মরূপে দেগে দিল তারা। বলল ভারতীয় হিন্দুধর্ম অনৈতিক এবং জরাজীর্ণ। আজও শিক্ষিত ভারতীয়দের বিশ্বাস, ইংরেজ বুদ্ধিজীবি, আমলা, প্রশাসকেরা ভারতীয় ধর্মের সতীদাহ অথবা বাল্য বিবাহেরমত নানান তথাকথিত জরাজীর্ণ কুআচারে মনেপ্রাণে ব্যথিত হয়ে ভারতীয় ধর্মের সংস্কারকর্ম গ্রহণ করে। সেই বিশ্বাসেই রামমোহন রায় ধর্মকে জঞ্জালমুক্ত করতে এগিয়ে এলেন। ইওরোপের অনুসরণে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের জন্ম হল ভারতে।
দ্বিতীয়তঃ ভারতীয়দের আচরণীয় সংস্কার, সংস্কৃতিকে ব্রিটিশরা মিথ্যা ধর্মরূপে দেগে দিয়ে ভারতীয় ধর্মগুলিকেকে জরাজীর্ণ, মিথ্যারূপে প্রমাণ করা। তাহলে ব্রিটিশদের গুরুঠাকুর ঠাওরানো শহুরে ব্যবসা-চাকুরিকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তরা নিজেরাই নিজেদের সমাজ ভাঙতে উদ্যোগী হয়ে উঠবে। এর জন্য বিদেশি ব্রিটিশদের সরাসরি ভারত সমাজভাঙার উদ্যমের প্রয়োজন হবে না। ক্ষুব্ধ ভারতীয়রাও ব্রিটিশদের সরাসরি দোষী ঠাওরাতে পারবে না। এই সমাজ ভাঙার পোষাকি নাম হল সংস্কার আন্দোলন অথবা নবজাগরণ।
বলাহল, কিছু মানুষের উন্মার্গগামীতায় এমন ঘটছে। আর হিন্দু ধর্মর মূলেই গলদ রয়েছে। ভারতীয়দের সত্য ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করাই শ্রেয়। কিন্তু অন্যান্য মহাদেশেরমত খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে ভারতীয়রা হামলে পড়ল না। তাই শহুরে ভারতীয়দের বিশ্বাস করালে হল হিন্দুধর্মটাই মিথ্যা ধর্ম। অসুবিধে হল, ভারতীদের মানসিকতায় মিথ্যা ধর্ম নামক কোনও শব্দবন্ধের ধারণা নেই। তাতে কী! ব্রিটিশ পিরেরা বলেছেন। বিশদ না জেনেই নবজাগরণের অগ্রদূতেরা দাসত্ব প্রকল্প সামিল হলেন।
দীর্ঘ দুই শতাব্দ পেরিয়ে এসে আজ এই বিষয়টিকে নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। যে তাত্বিকতায় ব্রিটিশেরা ধর্ম সংস্কারে উদ্যমী হয়েছিলেন, সেই ধারণাটির মূলে যাওয়া আজ অন্ততঃ প্রয়োজন। ভারতের রিফর্মিস্ট অথবা ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন আলোচনায় ব্রিটিশদের ধর্ম বিষয়ক চিন্তাভাবনা না বুঝে নিলে, ভারতীয় ধর্ম সংস্কারের তাত্বিক দিকটি পরিষ্কার হবে না। প্রথম থেকেই কিন্তু রিফর্মিস্ট আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ ছিল ইংরেজদের হাতে।
ধর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য ভগবান পুজন। সেমেটিক ধর্মের অনুসরণকারীরা মনেকরে ভাগবানের সত্যিকারের আরাধনার পথজুড়ে আড় হয়ে রয়েছে শয়তান যার বাইবেলিয় নাম সাটান অথবা ডেভিল। শয়তান মানুষকে প্ররোচিত করেচলেছে আরাধনা থেকে সরে আসাতে। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের হাতেপড়ে এই মানুষেরা শুধুই খ্রিষ্ট ধর্ম অথবা সেমেটিক ধর্মের অনুগামী থাকলেন না। ধরে নেওয়া হল, বিশ্বের সকল মানুষকেই নানান নামে শয়তান(শয়তানের অনুসরণকারীরা লেজিয়ঁ (legion) নামে পরিচিত) পথভ্রষ্ট করে অজ্ঞাণী, অবোধদের নানান ভগবান পুজন করাচ্ছে। আদতে একমেবদ্বিতীয়ম ভাগবান ছাড়া সব পুজ্য ভগবানই আদতে শয়তানের রূপ। কিন্তু গড ছাড়া সবই মিথ্যা ভগবান।
এই ঘৃণ্যকাজে মানুষদেরই একাংশ শয়তানের সাহায্যকারীরূপে অবতীর্ণ– এই সাহায্যকারীরা যাজক সম্প্রদায়। যাজক অথবা পুরোহিতেরা নানান ধরণের আচার আচরণ, জাদুটোনা প্রয়োগ করে ধর্মানুগামীদের পথ ভোলায়। ভগবানের মৌলিক বাণীগুলিকে জনগণের সামনে আবৃত করে রাখে। ফলে অবোধ সাধারণ মানুষ, শয়তান এবং তার অনুগামীদেরই ভগবান ভেবে পুজো করে। এরাই মিথ্যা দেবতা। গড অথবা আল্লা অথবা জোহেবাই সত্য ভগবান। মিথ্যা ভাগবানের পুজন যে ধর্ম প্রচার করে তাই মিথ্যা ধর্ম।
মিথ্যা ধর্ম ভোলাভালা সাধারণ মানুষকে শয়তানের অনুগামী করে। মানুষকে নরকের পথে নিয়ে যায়। এই সমস্ত ধর্মকর্ম জাগতিকভাবে অনৈতিক। ভারতে ব্রিটিশরা বাল্যবিবাহ অথবা সতীদাহেরমত নানান প্রথা দেখেছিল। এতে হিন্দুধর্মের অনৈতিকতাও সরাসরি প্রমাণিত হল। ব্রিটিশরা বলল এই সব আচার আচরণের প্রচার প্রসার মৌলিক, আদি ধর্মের বিরুদ্ধে মতলবী পুরোহিতদের চক্রান্ত। পুরোহিতদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের এককরে দেওয়া হল।
সেমেটিক ধর্মের পালনকারীদের মনেই প্রশ্ন উঠল ভাগবানের নাম করে এই ভন্ড ভারতীয় পুরোহিতেরা কীভাবে ক্ষমতা অর্জন করেছে এবং সেই ক্ষমতা দখলে রেখেছে! ধাঁধার সহজ উত্তর পাওয়াগেল না। উত্তর তো পেতেই হবে। নইলে ভারতে ধর্ম-সংস্কার তত্ব টেঁকেনা। বলতেহল পুরোহিতদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ভারতীয়দের অন্ধভাবে জাতপাত মানার মধ্যে। তাই পশ্চিমিদের কাছে জাতপাত প্রধাণতম খলনায়ক হয়ে উঠল। অসাধু পুরোহিতেরা অজ্ঞাত উপায়ে ভারতের সমাজে জাতপাতের এক জটিল রূপরেখা তৈরি করে। তারা আরও অব্যক্ত পদ্ধতিতে এই জটিলতায় অধিকাংশ অবোধ, অজ্ঞাণ, মূঢ় জনগণেশকে সামিল করেছে। জোর করে অনৈতিক চক্রান্তমূলক জাতপাতভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে। কী করে এই চাপিয়ে দেওযার ঘটনা ব্রাহ্মণেরা ঘটাতে পারল, সে তথ্য সর্বশক্তিমান ব্রিটিশ প্রমাণ করে দেখাতে পারে নি। ছদ্মব্রিটিশ অনুগামী বহু বুদ্ধিজীবি তা প্রমাণ করে দেখাতে পারে নি। মনগড়া স্বতঃসিদ্ধ তত্ব বাজারে চলছে। এদের মধ্যে বামমনোভাবাপন্ন ঐতিহাসিকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
পরবর্তীকালে এই খলনায়ক ব্রাহ্মণ যাজকদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্মকে দাঁড় করানো হল। গৌতমবুদ্ধ নিজে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে লড়ে নিজের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ রসাল তথ্যও সুপরিবেশিত হল। শুধু ভারতে নয়, বিশ্বজুড়েও। বুদ্ধ নাকী অধঃপতিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে লড়েছেন, সেহেতু প্রটেস্টান্টদের চোখে বুদ্ধ হিন্দুধর্মের তুলনায় অনেক বেশি গ্রহনীয় হলেন। পশ্চিমি অনেক চিন্তবিদমানুষ বৌদ্ধধর্মে প্রভূত আস্থারাখেন। সব কটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধরার প্রকল্পে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির সব ধরণের বিচ্যুতির সন্ধান চলল হিন্দুধর্মের অন্দরে। বলাহল, সমস্ত বিচ্যুতি হিন্দুধর্মেরই অঙ্গ বিশেষ।
এই আধুনিক প্রচারে বিন্দুমাত্রও নাড়ানো গেলনা ভারতীয় গ্রামীণদের। তাঁরা নিজেদের সমাজ সংস্কৃতি যতটুকু বাঁচাতে পেরেছে ব্রিটিশ অথবা অনুগামীদের লুঠ, অত্যাচার আর দাসত্ব প্রকল্পের হাত থেকে, তাই নিয়েই সুখী থাকল। নানান প্ররোচনা সত্বেও।
চক্রান্তকারী ব্রাহ্মণদের সঙ্গে, হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে শশব্যস্তে কলম ধরলেন প্রগতিশীল রামমোহন রায়। তাকে সামনে রেখে অনেকেই পথে নামল এমনকী মূর্তিপূজকেরাও। ১৮১৫র রামমোহনের মিথ্যধর্মবিষয়ক কলমবাজি ২০ বছর পর ব্যাবিংটন মেকলের মিনিট। ১৮৩৫এর উদ্ধত, অশ্লীলতম মিনিটের বিরুদ্ধে আজও রা কাড়তে শেনা যায়না আধুনিক ভারতবাসীর। সনাতন পরিবারের বিদ্যাসাগরও মাথা নোয়ালেন চাকরি-ব্যবসার সুরক্ষায়। আঠারেশ শতকের প্রথমদিকে এহেন ব্রিটিশ প্রচারে কলকাতার শহুরেমহল সাড়া দিল। শহরের প্রখ্যাতদের অনেকেই তথাকথিত হিঁদুয়ানি ছেড়ে খ্রিস্টধর্মে আস্থাপ্রকাশ করলেন। খ্রিস্ট ধর্মেও দীক্ষা নিলেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে আসতে শুরু করল কয়েক বছরের মধ্যে। রামমোহনেরমত একদল ভারতীয় ধর্ম ত্যাগ করল না। ব্রিটিশের ধর্ম সমালোচনার উত্তরে অনৈতিক হিন্দুধর্মকে শুদ্ধ করতে ধর্ম-সংস্কারে বুক পেতে দিলেন। পুরোনো পরিশুদ্ধতম বেদ উপনিষদের ধর্মে ফিরে যেতে চাইলেন। বেদ উপনিষদে ধর্মের অবিসংবাদী প্রাচীণরূপ আবিষ্কৃার করলেন। নতুন ধর্মের উদ্ভব ঘটল।
আফ্রিকা অথবা আমেরিকারমত, গ্রামীণ ভারত ভারত খ্রিস্টধর্ম বরণ করে নি। তাই প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টধর্মেরমতকরে হিন্দুধর্মের সংস্কার শুরু হল। ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়রা সংস্কার নিবেদন পেশ করল। উদ্দেশ্য অধঃপতিত হিন্দুধর্ম রিফর্ম করে খ্রিস্টধর্মেরমত সম্মানিত ধর্মে পরিণত করা! প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্ট ধর্মের আদলে ব্রাহ্ম সমাজ, প্রার্থনা সমাজ, আর্য সমাজেরমত ধর্মপ্রচেষ্টা গড়ে উঠল। ভারতীয় ধর্মের তথাকথিত কুসংস্কারীয় আচার আচরণ দেখে মাননীয়রা মুর্চ্ছা না যান সে ব্যবস্থা করলেন অগ্রণী ভারতীয়রা। আদত উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সমাজে কল্কে অর্জন।
প্রত্যেকটি সম্মানিত ধর্মরমতই হিন্দুধর্মের নতুনতম ধর্মগুলির নানান স্মৃতিশাস্ত্র গড়ে উঠল। পশ্চিমি শাস্ত্র অনুসারে কিছু পালনীয় আচার, আচরণ, সেবাধর্ম লিখে ফেলা হল। প্রটেস্টান্ট ধর্মের অনুসরণে প্রতিবেশীর প্রতি কতটা গড় শ্রদ্ধাপ্রকাশ করা যায় তারও কিছুকিছু নির্দেশাবলী তৈরি হল। প্রটেস্টান্ট ধর্মের আদলে হিন্দুধর্মকে সংস্কার করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে বর্বর জাতিপ্রথারমত নানান কর্মকান্ডও নাশ করার ব্যবস্থা হল। রামমোহন বললেন ভারতের আপামর সাধারণ মূঢ়, অজ্ঞ। আমজনগণ উচ্চমার্গের উপনিষদীয় ধর্মভাবনায় নিজেদের মেলাতে পারে না। কেননা যুগ যুগ ধরে তারা নানান কুসংস্কারের অতলে তলিয়ে রয়েছে।
ইংরেজি শিক্ষিতদের এই ধর্ম-সংস্কার, গ্রামীণ ভারতীয়দের তুচ্ছতাচ্ছিল্যের অর্থ আদতে ভারতীয় চিরাচরিত সংস্কৃতিকে মেনে না নেওয়ার। তাকে অধঃপাতিত, জরাজীর্ণ প্রমাণ করে তার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাওয়া। শহরকেন্দ্রিক ধর্মপালনের যুগের শুরু। এতথ্য যেন আমরা আজ মনে রাখি। এই সংক্রান্ত বিশদ আলোচনা তখন হয় নি। আজও হয় না।
আশ্চর্যের বিষয় হল, বিদেশিদের ছত্রছায়ায় থেকে, ভারতীয় গ্রামীণ, সংস্কৃতির প্রতি সরাসরি অশ্রদ্ধার প্রকাশের এই শহুরে প্রচেষ্টাকে পারম্পরিক ভারতবর্ষ সহজভাবে মনে নিয়েছে। এটাই সনাতন ভারতের মহত্ব। সেটাই নমনীয় ভারতের চিরাচরিত পালনীয় সংস্কৃতি। আর্য সমাজীদেরমত নতুন ধর্মাবলম্বীরা ততটাই ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠল, যতটাই ভারতের শৈব অথবা শাক্ত অথবা বৈষ্ণবমতাবলম্বীরা চিরাচরিতভাবে ছিলেন। সহস্র সহস্র বছর ধরে ভারতীয় সংস্কৃতিকে যে সব ধারা পুষ্ট করেছে, নবতম ধর্মমতাবলম্বী আর্য সমাজীরা সেই পথেরই অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠল। কোনও প্রশ্ন উঠলনা।
সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশদের দেখানো পথে মহানতম ভারতীয়রা হাঁটতে স্বস্তিবোধ করেছে। ব্রিটিশেরা বলল সাধারণ গ্রামীণ ভারতীয় শাস্ত্র সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ। তার উত্তরে সংস্কারপন্থীরা নানান শাস্ত্র পঠনে ফিরে গেলেন। ব্রিটিশেরা কুসংস্কারমূলক আচার আচরণের সমালোচনা শুরু করে। ভারতীয় সংস্কারপন্থীরা সে সবগুলি হয় সংস্কার অথবা প্রতিস্থাপিত করার উদ্যোগ নেয়। ব্রিটিশেরা মনে করল ভারতীয় ধর্ম অনৈতিক। সংস্কারপন্থীরা শাস্ত্র থেকে নিজেদের জন্য কয়েকটি অবশ্য মাননীয় নির্দেশাবলী খুঁটে তুলে ধরল ব্রিটিশষদের সামনে। দেখাল খ্রিস্টধর্মেরমতই হিন্দুধর্মও নৈতিকতা বিশিষ্ট হতে পারে। আদতে ব্রিটিশ নিজেরমত করে মন গড়া cতৈরি করেছে। প্রখ্যাত ভারতীয়রা সেই এজেন্দাকে ভগবান প্রেরিত ভেবে বাঁদর নেচেছেন। সেই কাণ্ড আজও ঘটে চলেছে। তারা আজও তাদের এজেন্দাতেই নেচে চলেছেন।
ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ধর্ম-সংস্কারবাদীরা ধর্ম সমালোচনার উত্তরে নিজেদের মানিয়ে নিতে চাইলেন। প্রটেস্টান্ট ব্রিটিশদেরমত করে একটি হিন্দুধর্ম তৈরি করার চেষ্টা করলেন। তারা ব্রিটিশ সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করা করেনি, ভারতকেও বোঝেননি। প্রয়োজনছিল ব্রিটিশদের সমালোচনার উত্তর দেওয়ার জন্য নিজেদের তৈরি করা, দেশ, সমাজকে বোঝা। তারা কোনটাই করলেন না। মহাজনেরা ভাবলেন ব্রিটিশরা যে ভারত ধর্ম-সমালোচনা করছে সেটি যথপোযুক্ত। সেদিনের ইওরোপ, আজকের আমেরিকা ভারতের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি সম্বন্ধে যতটুকু বলে এসেছে, তাকেই ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়রা বেদবাক্যরূপে গণ্য করেছে, সেই অনুযায়ী সমাজ আর দেশ বদলানোর চেষ্টা করেছেন। আজও ইংরেজি পড়া ভারতবাসী বিশ্বাস করে ভারতে জাতিপ্রথা অনৈতিক। সহস্রবছর ধরে ব্রাহ্মণেরা তথাকথিত দলিতদের দলিত করে রেখেছে। বৌদ্ধধর্ম আদতে আচার আচরণসর্বস্ব ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। আজও ভারতের বিদ্বতজনেরা পশ্চিমি এধরণেরতত্বে বিশ্বাস করেন।
ভারতের সরকারি সংরক্ষণ নীতি, দলিতদের বৌদ্ধধর্মে অথবা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তর আদতে সেই তত্বেরপ্রতি মধ্যবিত্তের আস্থা প্রমাণ করে।
কোম্পানির আমলারা, পোষা বুদ্ধিজীবিরা এদেশের নানান ধরণের ধর্মাচারণকে হিন্দুত্ব ঘোষণা করে। দেশের নানান ধর্মাচরণকে একদেহী হিন্দুধর্মরূপে দেগে দিল তারা। বলল ভারতীয় হিন্দুধর্ম অনৈতিক এবং জরাজীর্ণ। আজও শিক্ষিত ভারতীয়দের বিশ্বাস, ইংরেজ বুদ্ধিজীবি, আমলা, প্রশাসকেরা ভারতীয় ধর্মের সতীদাহ অথবা বাল্য বিবাহেরমত নানান তথাকথিত জরাজীর্ণ কুআচারে মনেপ্রাণে ব্যথিত হয়ে ভারতীয় ধর্মের সংস্কারকর্ম গ্রহণ করে। সেই বিশ্বাসেই রামমোহন রায় ধর্মকে জঞ্জালমুক্ত করতে এগিয়ে এলেন। ইওরোপের অনুসরণে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের জন্ম হল ভারতে।
ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের যুক্তি খুবই সরল। প্রথমতঃ ধর্মসংস্কারের নামে ভারতের সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্মের ওপর আঘাত নামিয়ে এনে
নানান ধর্ম নির্মূলণের তাত্বিকভূমি তৈরি করা। সেমেটিক
এককেন্দ্রিক ধর্মাচরণের সামাজিক পরিবেশে ইওরোপ বেড়ে উঠেছে। সেই সূত্রে ব্রিটিশরা বলল ভারতীয়রা যে ধর্মাচরণ করে তা আদতে মিথ্যা ধর্ম। এটি একটি প্রাচীণ সুললিত ধর্মের জরাজীর্ণ ইল্লুতে রূপ। উঠে এলেন
রামমোহন রায়। ব্রিটিশ ধর্মসংস্কারের পরিপূর্ণভাব বিকাশ ঘটল রামমোহন রায়েদেরমত ভারতীয়দের
নানান আচরণে।
দ্বিতীয়তঃ ভারতীয়দের আচরণীয় সংস্কার, সংস্কৃতিকে ব্রিটিশরা মিথ্যা ধর্মরূপে দেগে দিয়ে ভারতীয় ধর্মগুলিকেকে জরাজীর্ণ, মিথ্যারূপে প্রমাণ করা। তাহলে ব্রিটিশদের গুরুঠাকুর ঠাওরানো শহুরে ব্যবসা-চাকুরিকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তরা নিজেরাই নিজেদের সমাজ ভাঙতে উদ্যোগী হয়ে উঠবে। এর জন্য বিদেশি ব্রিটিশদের সরাসরি ভারত সমাজভাঙার উদ্যমের প্রয়োজন হবে না। ক্ষুব্ধ ভারতীয়রাও ব্রিটিশদের সরাসরি দোষী ঠাওরাতে পারবে না। এই সমাজ ভাঙার পোষাকি নাম হল সংস্কার আন্দোলন অথবা নবজাগরণ।
বলাহল, কিছু মানুষের উন্মার্গগামীতায় এমন ঘটছে। আর হিন্দু ধর্মর মূলেই গলদ রয়েছে। ভারতীয়দের সত্য ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করাই শ্রেয়। কিন্তু অন্যান্য মহাদেশেরমত খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে ভারতীয়রা হামলে পড়ল না। তাই শহুরে ভারতীয়দের বিশ্বাস করালে হল হিন্দুধর্মটাই মিথ্যা ধর্ম। অসুবিধে হল, ভারতীদের মানসিকতায় মিথ্যা ধর্ম নামক কোনও শব্দবন্ধের ধারণা নেই। তাতে কী! ব্রিটিশ পিরেরা বলেছেন। বিশদ না জেনেই নবজাগরণের অগ্রদূতেরা দাসত্ব প্রকল্প সামিল হলেন।
দীর্ঘ দুই শতাব্দ পেরিয়ে এসে আজ এই বিষয়টিকে নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। যে তাত্বিকতায় ব্রিটিশেরা ধর্ম সংস্কারে উদ্যমী হয়েছিলেন, সেই ধারণাটির মূলে যাওয়া আজ অন্ততঃ প্রয়োজন। ভারতের রিফর্মিস্ট অথবা ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন আলোচনায় ব্রিটিশদের ধর্ম বিষয়ক চিন্তাভাবনা না বুঝে নিলে, ভারতীয় ধর্ম সংস্কারের তাত্বিক দিকটি পরিষ্কার হবে না। প্রথম থেকেই কিন্তু রিফর্মিস্ট আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ ছিল ইংরেজদের হাতে।
মিথ্যা ধর্ম – খায় না খুন
করে
সেমেটিক ধর্মে(জুডাবাদ, খ্রীষ্টধর্ম এবং ইসলাম)র অনুসারীরা মনে করেন বিশ্বে
শুধুই একক ভগবানই পুজ্য।
ধর্মগুলির শাস্ত্রবাক্য অনুসারে ভগবানই বিশ্বসৃষ্টিকর্তা(বাইবেল কথিত ওল্ড
টেস্টামেন্টের জেনেসিস পর্বটি)।
ধর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য ভগবান পুজন। সেমেটিক ধর্মের অনুসরণকারীরা মনেকরে ভাগবানের সত্যিকারের আরাধনার পথজুড়ে আড় হয়ে রয়েছে শয়তান যার বাইবেলিয় নাম সাটান অথবা ডেভিল। শয়তান মানুষকে প্ররোচিত করেচলেছে আরাধনা থেকে সরে আসাতে। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের হাতেপড়ে এই মানুষেরা শুধুই খ্রিষ্ট ধর্ম অথবা সেমেটিক ধর্মের অনুগামী থাকলেন না। ধরে নেওয়া হল, বিশ্বের সকল মানুষকেই নানান নামে শয়তান(শয়তানের অনুসরণকারীরা লেজিয়ঁ (legion) নামে পরিচিত) পথভ্রষ্ট করে অজ্ঞাণী, অবোধদের নানান ভগবান পুজন করাচ্ছে। আদতে একমেবদ্বিতীয়ম ভাগবান ছাড়া সব পুজ্য ভগবানই আদতে শয়তানের রূপ। কিন্তু গড ছাড়া সবই মিথ্যা ভগবান।
এই ঘৃণ্যকাজে মানুষদেরই একাংশ শয়তানের সাহায্যকারীরূপে অবতীর্ণ– এই সাহায্যকারীরা যাজক সম্প্রদায়। যাজক অথবা পুরোহিতেরা নানান ধরণের আচার আচরণ, জাদুটোনা প্রয়োগ করে ধর্মানুগামীদের পথ ভোলায়। ভগবানের মৌলিক বাণীগুলিকে জনগণের সামনে আবৃত করে রাখে। ফলে অবোধ সাধারণ মানুষ, শয়তান এবং তার অনুগামীদেরই ভগবান ভেবে পুজো করে। এরাই মিথ্যা দেবতা। গড অথবা আল্লা অথবা জোহেবাই সত্য ভগবান। মিথ্যা ভাগবানের পুজন যে ধর্ম প্রচার করে তাই মিথ্যা ধর্ম।
মিথ্যাধর্মের পালক জাতপাত
তো ব্রিটিশ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা ভারতে শাসন করতে এল। ব্রিটিশ ধর্ম
প্রচারকদের কাছে খ্রিস্ট ধর্ম ছাড়া যেকোনও ধর্মই মিথ্যাধর্ম। ভারতের
তেত্রিশ কোটি দেবী-দেবতা মিথ্যা দেবদেবী। এরা সকলেই শয়তান অথবা শয়তানের প্রতিভূ। প্রোটেস্টান্ট
ধর্মাবলম্বীরা বলল শয়তানের ঘোমটা উন্মোচনের মাধ্যমেই শয়তানের প্রতিভূ ব্রাহ্মণ
অথবা পুরোহিতদের আদত রূপ প্রকাশ পায়।
মিথ্যা ধর্ম ভোলাভালা সাধারণ মানুষকে শয়তানের অনুগামী করে। মানুষকে নরকের পথে নিয়ে যায়। এই সমস্ত ধর্মকর্ম জাগতিকভাবে অনৈতিক। ভারতে ব্রিটিশরা বাল্যবিবাহ অথবা সতীদাহেরমত নানান প্রথা দেখেছিল। এতে হিন্দুধর্মের অনৈতিকতাও সরাসরি প্রমাণিত হল। ব্রিটিশরা বলল এই সব আচার আচরণের প্রচার প্রসার মৌলিক, আদি ধর্মের বিরুদ্ধে মতলবী পুরোহিতদের চক্রান্ত। পুরোহিতদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের এককরে দেওয়া হল।
সেমেটিক ধর্মের পালনকারীদের মনেই প্রশ্ন উঠল ভাগবানের নাম করে এই ভন্ড ভারতীয় পুরোহিতেরা কীভাবে ক্ষমতা অর্জন করেছে এবং সেই ক্ষমতা দখলে রেখেছে! ধাঁধার সহজ উত্তর পাওয়াগেল না। উত্তর তো পেতেই হবে। নইলে ভারতে ধর্ম-সংস্কার তত্ব টেঁকেনা। বলতেহল পুরোহিতদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ভারতীয়দের অন্ধভাবে জাতপাত মানার মধ্যে। তাই পশ্চিমিদের কাছে জাতপাত প্রধাণতম খলনায়ক হয়ে উঠল। অসাধু পুরোহিতেরা অজ্ঞাত উপায়ে ভারতের সমাজে জাতপাতের এক জটিল রূপরেখা তৈরি করে। তারা আরও অব্যক্ত পদ্ধতিতে এই জটিলতায় অধিকাংশ অবোধ, অজ্ঞাণ, মূঢ় জনগণেশকে সামিল করেছে। জোর করে অনৈতিক চক্রান্তমূলক জাতপাতভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে। কী করে এই চাপিয়ে দেওযার ঘটনা ব্রাহ্মণেরা ঘটাতে পারল, সে তথ্য সর্বশক্তিমান ব্রিটিশ প্রমাণ করে দেখাতে পারে নি। ছদ্মব্রিটিশ অনুগামী বহু বুদ্ধিজীবি তা প্রমাণ করে দেখাতে পারে নি। মনগড়া স্বতঃসিদ্ধ তত্ব বাজারে চলছে। এদের মধ্যে বামমনোভাবাপন্ন ঐতিহাসিকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
নির্দিষ্ট কোনও জ্ঞাণচর্চা অথবা গবেষণার ভিত্তিতে
ব্রিটিশেরা অথবা তাঁদের অনুগামীরা এই উপসংহারে উপনীত হয়েছিল একথা বলা যায়না। তারা
ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতেই এই তত্বে আজও আস্থারেখেছে। পরবর্তীকালে
ভারতীয় সমাজে তাঁরা অনেক কিছু অনাচাররূপে পশ্চিম আবিষ্কার করেছে। শহুরে
ভারতীয়রা সেগুলিকে সামাজিক অথবা ধর্মীয় অনাচাররূপেও মান্যতা দিয়েছে। এ সবই তথাকথিত
ধর্মচক্রচক্রান্ততত্বে খাপেখাপ খেয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশদ্বারা উপনিষদ, বুদ্ধ এবং জৈনধর্ম আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই
অনাচারমূলক ধর্মচক্রের উপসংহারটি আরও গতিময়তা অর্জন করে। ব্রিটিশরাজ
পোষিত বুদ্ধিজীবিরা ভারতীয় ধর্মের অধঃপাতে যাওয়ার তিনটি ক্রমপর্যায় আবিষ্কার করেন। প্রথমে বৈদিকধর্ম পরে
ব্রাহ্মণ্যধর্ম এবং সর্বশেষে হিন্দুধর্ম। বৈদিকধর্মই একক ভগবান কথিত আসল ধর্ম। এই ধর্মেই
রয়েছে ভাগবানের মূল বাণীসমূহ। ব্রাহ্মণ্যধর্ম আদতে বৈদিকধর্মের অধঃপাতিতরূপ। বৈদিকধর্ম
শয়তানের প্রতিভূ ব্রাহ্মণদের চক্রান্তে ব্রাহ্মণ্যধর্মে পরিণত হয়েছে। ব্রাহ্মণ্য
ধর্ম আরও অধঃপতিত হয়ে হিন্দুধর্মে কালপরিণত হয়েছে।
পরবর্তীকালে এই খলনায়ক ব্রাহ্মণ যাজকদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্মকে দাঁড় করানো হল। গৌতমবুদ্ধ নিজে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে লড়ে নিজের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ রসাল তথ্যও সুপরিবেশিত হল। শুধু ভারতে নয়, বিশ্বজুড়েও। বুদ্ধ নাকী অধঃপতিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে লড়েছেন, সেহেতু প্রটেস্টান্টদের চোখে বুদ্ধ হিন্দুধর্মের তুলনায় অনেক বেশি গ্রহনীয় হলেন। পশ্চিমি অনেক চিন্তবিদমানুষ বৌদ্ধধর্মে প্রভূত আস্থারাখেন। সব কটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধরার প্রকল্পে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির সব ধরণের বিচ্যুতির সন্ধান চলল হিন্দুধর্মের অন্দরে। বলাহল, সমস্ত বিচ্যুতি হিন্দুধর্মেরই অঙ্গ বিশেষ।
হিন্দুধর্ম যে আদতে মিথ্যা জরাজীর্ণ পতিত ধর্ম এই
ব্রিটিশীয় প্রচার মোটামুটি ভারতের বুদ্ধিজীবি মহলে সসম্মানে গৃহীত হল। ব্রিটিশ
অনুগামীদের প্রচারের ঘনঘটার দশচক্রে ভারতীয় ভগবানসমূহ শয়তানে পরিণত হলেন।
এই আধুনিক প্রচারে বিন্দুমাত্রও নাড়ানো গেলনা ভারতীয় গ্রামীণদের। তাঁরা নিজেদের সমাজ সংস্কৃতি যতটুকু বাঁচাতে পেরেছে ব্রিটিশ অথবা অনুগামীদের লুঠ, অত্যাচার আর দাসত্ব প্রকল্পের হাত থেকে, তাই নিয়েই সুখী থাকল। নানান প্ররোচনা সত্বেও।
চক্রান্তকারী ব্রাহ্মণদের সঙ্গে, হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে শশব্যস্তে কলম ধরলেন প্রগতিশীল রামমোহন রায়। তাকে সামনে রেখে অনেকেই পথে নামল এমনকী মূর্তিপূজকেরাও। ১৮১৫র রামমোহনের মিথ্যধর্মবিষয়ক কলমবাজি ২০ বছর পর ব্যাবিংটন মেকলের মিনিট। ১৮৩৫এর উদ্ধত, অশ্লীলতম মিনিটের বিরুদ্ধে আজও রা কাড়তে শেনা যায়না আধুনিক ভারতবাসীর। সনাতন পরিবারের বিদ্যাসাগরও মাথা নোয়ালেন চাকরি-ব্যবসার সুরক্ষায়। আঠারেশ শতকের প্রথমদিকে এহেন ব্রিটিশ প্রচারে কলকাতার শহুরেমহল সাড়া দিল। শহরের প্রখ্যাতদের অনেকেই তথাকথিত হিঁদুয়ানি ছেড়ে খ্রিস্টধর্মে আস্থাপ্রকাশ করলেন। খ্রিস্ট ধর্মেও দীক্ষা নিলেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে আসতে শুরু করল কয়েক বছরের মধ্যে। রামমোহনেরমত একদল ভারতীয় ধর্ম ত্যাগ করল না। ব্রিটিশের ধর্ম সমালোচনার উত্তরে অনৈতিক হিন্দুধর্মকে শুদ্ধ করতে ধর্ম-সংস্কারে বুক পেতে দিলেন। পুরোনো পরিশুদ্ধতম বেদ উপনিষদের ধর্মে ফিরে যেতে চাইলেন। বেদ উপনিষদে ধর্মের অবিসংবাদী প্রাচীণরূপ আবিষ্কৃার করলেন। নতুন ধর্মের উদ্ভব ঘটল।
নতুন ধর্মের উদ্ভব
দাসত্ব প্রকল্পের পথে চলতে চলতে নির্গুণ, নিরাকার ব্রহ্ম হঠাতই শহুরে সমাজে
কল্কে পেয়েগেল।
ব্রিটিশ প্রণোদিত ভারতীয় ধর্ম সংস্কারের ষোলকলাপূর্ণ হল। ইওরোপিয়দের
ধুয়াধরে বলাহল বর্তমানে ভারতীয় জনগণ যে ধরণের পুজা অর্চনা আচার আচরণ মান্য করে,
উপনিষদ অথবা বেদে তার বর্ণনা নেই। চক্রান্তকারী ব্রাহ্মণদের হাতে তৈরি মন্দির এবং গৃহে স্থাপিত দেবতার পুজো
আদতে অনৈতিকতম মূর্তি পুজের নামান্তর। প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টধর্মের আদলে তথাকথিত হিন্দুধর্মকে ঢেলে সাজার পরিকল্পনা,
শহুরে ইংরেজি শিক্ষিত সমাজের এক অংশে অনেকবেশিকরে গৃহীত হল।
আফ্রিকা অথবা আমেরিকারমত, গ্রামীণ ভারত ভারত খ্রিস্টধর্ম বরণ করে নি। তাই প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টধর্মেরমতকরে হিন্দুধর্মের সংস্কার শুরু হল। ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়রা সংস্কার নিবেদন পেশ করল। উদ্দেশ্য অধঃপতিত হিন্দুধর্ম রিফর্ম করে খ্রিস্টধর্মেরমত সম্মানিত ধর্মে পরিণত করা! প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্ট ধর্মের আদলে ব্রাহ্ম সমাজ, প্রার্থনা সমাজ, আর্য সমাজেরমত ধর্মপ্রচেষ্টা গড়ে উঠল। ভারতীয় ধর্মের তথাকথিত কুসংস্কারীয় আচার আচরণ দেখে মাননীয়রা মুর্চ্ছা না যান সে ব্যবস্থা করলেন অগ্রণী ভারতীয়রা। আদত উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সমাজে কল্কে অর্জন।
প্রত্যেকটি সম্মানিত ধর্মরমতই হিন্দুধর্মের নতুনতম ধর্মগুলির নানান স্মৃতিশাস্ত্র গড়ে উঠল। পশ্চিমি শাস্ত্র অনুসারে কিছু পালনীয় আচার, আচরণ, সেবাধর্ম লিখে ফেলা হল। প্রটেস্টান্ট ধর্মের অনুসরণে প্রতিবেশীর প্রতি কতটা গড় শ্রদ্ধাপ্রকাশ করা যায় তারও কিছুকিছু নির্দেশাবলী তৈরি হল। প্রটেস্টান্ট ধর্মের আদলে হিন্দুধর্মকে সংস্কার করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে বর্বর জাতিপ্রথারমত নানান কর্মকান্ডও নাশ করার ব্যবস্থা হল। রামমোহন বললেন ভারতের আপামর সাধারণ মূঢ়, অজ্ঞ। আমজনগণ উচ্চমার্গের উপনিষদীয় ধর্মভাবনায় নিজেদের মেলাতে পারে না। কেননা যুগ যুগ ধরে তারা নানান কুসংস্কারের অতলে তলিয়ে রয়েছে।
ইংরেজি শিক্ষিতদের এই ধর্ম-সংস্কার, গ্রামীণ ভারতীয়দের তুচ্ছতাচ্ছিল্যের অর্থ আদতে ভারতীয় চিরাচরিত সংস্কৃতিকে মেনে না নেওয়ার। তাকে অধঃপাতিত, জরাজীর্ণ প্রমাণ করে তার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাওয়া। শহরকেন্দ্রিক ধর্মপালনের যুগের শুরু। এতথ্য যেন আমরা আজ মনে রাখি। এই সংক্রান্ত বিশদ আলোচনা তখন হয় নি। আজও হয় না।
আশ্চর্যের বিষয় হল, বিদেশিদের ছত্রছায়ায় থেকে, ভারতীয় গ্রামীণ, সংস্কৃতির প্রতি সরাসরি অশ্রদ্ধার প্রকাশের এই শহুরে প্রচেষ্টাকে পারম্পরিক ভারতবর্ষ সহজভাবে মনে নিয়েছে। এটাই সনাতন ভারতের মহত্ব। সেটাই নমনীয় ভারতের চিরাচরিত পালনীয় সংস্কৃতি। আর্য সমাজীদেরমত নতুন ধর্মাবলম্বীরা ততটাই ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠল, যতটাই ভারতের শৈব অথবা শাক্ত অথবা বৈষ্ণবমতাবলম্বীরা চিরাচরিতভাবে ছিলেন। সহস্র সহস্র বছর ধরে ভারতীয় সংস্কৃতিকে যে সব ধারা পুষ্ট করেছে, নবতম ধর্মমতাবলম্বী আর্য সমাজীরা সেই পথেরই অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠল। কোনও প্রশ্ন উঠলনা।
সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশদের দেখানো পথে মহানতম ভারতীয়রা হাঁটতে স্বস্তিবোধ করেছে। ব্রিটিশেরা বলল সাধারণ গ্রামীণ ভারতীয় শাস্ত্র সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ। তার উত্তরে সংস্কারপন্থীরা নানান শাস্ত্র পঠনে ফিরে গেলেন। ব্রিটিশেরা কুসংস্কারমূলক আচার আচরণের সমালোচনা শুরু করে। ভারতীয় সংস্কারপন্থীরা সে সবগুলি হয় সংস্কার অথবা প্রতিস্থাপিত করার উদ্যোগ নেয়। ব্রিটিশেরা মনে করল ভারতীয় ধর্ম অনৈতিক। সংস্কারপন্থীরা শাস্ত্র থেকে নিজেদের জন্য কয়েকটি অবশ্য মাননীয় নির্দেশাবলী খুঁটে তুলে ধরল ব্রিটিশষদের সামনে। দেখাল খ্রিস্টধর্মেরমতই হিন্দুধর্মও নৈতিকতা বিশিষ্ট হতে পারে। আদতে ব্রিটিশ নিজেরমত করে মন গড়া cতৈরি করেছে। প্রখ্যাত ভারতীয়রা সেই এজেন্দাকে ভগবান প্রেরিত ভেবে বাঁদর নেচেছেন। সেই কাণ্ড আজও ঘটে চলেছে। তারা আজও তাদের এজেন্দাতেই নেচে চলেছেন।
ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ধর্ম-সংস্কারবাদীরা ধর্ম সমালোচনার উত্তরে নিজেদের মানিয়ে নিতে চাইলেন। প্রটেস্টান্ট ব্রিটিশদেরমত করে একটি হিন্দুধর্ম তৈরি করার চেষ্টা করলেন। তারা ব্রিটিশ সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করা করেনি, ভারতকেও বোঝেননি। প্রয়োজনছিল ব্রিটিশদের সমালোচনার উত্তর দেওয়ার জন্য নিজেদের তৈরি করা, দেশ, সমাজকে বোঝা। তারা কোনটাই করলেন না। মহাজনেরা ভাবলেন ব্রিটিশরা যে ভারত ধর্ম-সমালোচনা করছে সেটি যথপোযুক্ত। সেদিনের ইওরোপ, আজকের আমেরিকা ভারতের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি সম্বন্ধে যতটুকু বলে এসেছে, তাকেই ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়রা বেদবাক্যরূপে গণ্য করেছে, সেই অনুযায়ী সমাজ আর দেশ বদলানোর চেষ্টা করেছেন। আজও ইংরেজি পড়া ভারতবাসী বিশ্বাস করে ভারতে জাতিপ্রথা অনৈতিক। সহস্রবছর ধরে ব্রাহ্মণেরা তথাকথিত দলিতদের দলিত করে রেখেছে। বৌদ্ধধর্ম আদতে আচার আচরণসর্বস্ব ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। আজও ভারতের বিদ্বতজনেরা পশ্চিমি এধরণেরতত্বে বিশ্বাস করেন।
ভারতের সরকারি সংরক্ষণ নীতি, দলিতদের বৌদ্ধধর্মে অথবা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তর আদতে সেই তত্বেরপ্রতি মধ্যবিত্তের আস্থা প্রমাণ করে।
No comments:
Post a Comment