ঐতিহ্যের বুনন
বাঙলার বয়ন ঐতিহ্যের
অন্যতম উত্তরবঙ্গের ধোকড়া শিল্প।
ধোকড়া আদতে পাটের বোনা মোটা কাপড়, শতরঞ্চিরমত। পাটের লাছি থেকে সরুসরু করে সুতো কেটে ধোকড়া বোনা হয়। বাঙলার রাজবংশী সমাজের পাট থেকে সুতো তৈরি করে
বয়ন পদ্ধতি সারা বিশ্বের তাঁত শিল্পের প্রাচীণতম বয়ণ পদ্ধতিগুলির মধ্যে অন্যতম। পাট থেকে যেহেতু তৈরি হয়, অন্যান্য সুতোর কাপড়ের
তুলনায় ধোকড়া কাপড়টি মোটা।
বেশ শক্ত। দুই
দিনাজপুরের রাজবংশী ঘরে ধোকড়া বোনা খুবই সাধারণ ঘটনা।
ভারত সভ্যতায় কাপড়বোনা শিল্পপ্রযুক্তি
বহু পুরোনো। ধোকড়া তার অন্যতম প্রাচীণ
অংশিদার। প্রাচীনত্বের
অন্যতম নির্দশণ সংস্কৃত প্রতিশব্দে।
শব্দটি ধোতকট। এছাড়া ধোকড়া ব্যবহার
হয়েছে সংস্কৃতে(সূত্র ধনঞ্জয় রায়, লোকশ্রুতি) সূত্র রচিতম ভান্ডম, ধোকড়া ইতি
খ্যাতঃ। প্রয়োগ
রয়েছে ধোকড়বে ধোকড়ি।
দৈনন্দিন ভাষায় ধোকড়া।
সংস্কৃত শব্দভান্ডারে উল্লেখের অর্থ, কৌলিন্য খোঁজা নয়।
পরম্পরার শেকড় খুঁজে বার করা।
শব্দটির হাত ধরে অন্ততঃ আমরা তিন হাজার বছর পেরিয়ে যেতে পারি। উত্সাহীদের, উষাহরণ, কুশমন্ডিরমত গাঁগঞ্জে ঘুরলে বিশ্বাস
জন্মাবেই, শব্দটি সংস্কৃত থেকে রাজবংশী ভাষায় আসে নি।
বরং প্রচলিত শব্দকে সংস্কার করে নিয়েছে শহুরে সমাজ।
মুকুন্দরাম কবিকঙ্কনের চন্ডীকাব্যেও
রয়েছে ধোকড়া শব্দের ব্যবহার– সদাগর আচ্ছাদন না
ছাড়ে ধোকড়ি। সাহেবরা
যে সময়কে বাঙলার মধ্যযুগ রূপে দেগে দিয়েছেন, সে যুগেও ধোকড়া প্রবলরূপে প্রচলিত
ছিল লৌকিক জীবনে। একটা
বিষয় পরিস্কার। গ্রাম সমাজে ধোকড়ার
পরম্পরার প্রবাহ ছিল। সেটি আজও রয়েছে।
ইংরেজ আমলে কলকাতার মেছুয়ার
ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা, মারাঠি শাড়ি পরার ঢং এদিক ওদিক করে নতুন ভাবে শাড়ি পরা শুরু
করলেন। শাড়ি পরার সেই ভঙ্গী শহর, পরে বাংলার সমাজজীবনে
ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। খুব
বেশি হলে দেড়শ বছরের ইতিহাস।
তার আগে পর্যন্ত বাংলার পুরুষ-নারী বিভেদ না করেই শরীরে দুফালি কাপড় পরত। এটি কিন্তু কয়েক হাজার বছরের ভারতীয় পরম্পরা। উত্তর-পূর্ব ভারতের বহু সমাজে এই আচার চালু রয়েছে
আজও। সেই
পারম্পরিক সামাজিক অনুশাসন মেনে দুফালি ধোকড়া গায়ের লোকাচারটি আজও পরম মমতায় ধরে
রেখেছেন রাজবংশী সমাজ।
রাজবংশী সমাজের পরিচয় ধোকড়ায়
উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে ধোকড়া শব্দটি বিকল্প বস্তু
হিসেবে পরিচিত। যেমন ধোকড় বাপ। অর্থ বিকল্প বাপ। আর দুই দিনাজপুরে খুবই প্রচলিত ছড়া চাল-চিঁড়ে-চট-গুড়
এই নিয়ে দিনাজপুরর। চট
অর্থে ধোকড়া। শুধু পরার কাপড়ই নয়,
রাজবংশী সমাজের নানান কাজে অকাজে গৃহস্থের বাড়িতে ধোকড়ার ব্যবহার ব্যাপক। গৃহস্থ ধোকড়া বিছিয়েই অতিথিদের সসম্মানে বসতে দেন। উঠোনে পাতা ধোকড়ার ওপর, তোলা ফসল রোদে শুকোতে
দেওয়াও রাজবংশী সমাজের প্রচলিত পদ্ধতি।
বাঘ পালানো ঠকঠকে শীতে গায়ে ধোকড়া জড়ানোর আরাম স্বর্গীয়।
যে মানুষ শীতে ধোকড়া গায়ে দেননি, তাকে সেই স্বাদ বোঝানো, লঙ্কার অথবা ইলিশের
স্বাদ লিখে বা বলে বোঝানোরমতই জীবনের কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে একটি। রাজবংশী সমাদের বর্ণিল জীবনের নানানস্তর সাজিয়ে
তুলেছে অসাধারণ শিল্পসুষমাময় হাতে বোনা ধোকড়া শিল্প।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়
অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় আজও রাজবংশী জনগোষ্ঠী। প্রায় দুশতক আগেওও জেলার ইতিহাসে দিনাজপুরের সুজানগর আর
মাহীনগর পরগণায় পারম্পরিক তাঁত শিল্পীদের বসবাসের উল্লেখ রয়েছে। মথুরাপুর, দেলওয়ারপুর, বাজিতপুর, রাধাবল্লভপুর,
কান্তনগর, রাজানগর পরগণার অধীনে বালুরঘাট, কুমারগঞ্জ, তপন, গঙ্গারামপুর, রায়গঞ্জ,
কালিয়াগঞ্জ, বংশীহারি, হেমতাবাদ, ইটাহার, কুশমন্ডি এলাকায়ও ধোকড়া তাঁতিরা শিল্পকর্ম
বহন করে চলেছেন আজও। ব্রিটিশ আমলে বাংলার অন্য
এলাকার তাঁতিদের সঙ্গে এই অঞ্চলের তাঁতিদের স্বাধীণতা সংগ্রাম ইতিহাসের অমর কাব্য তৈরি
করেছে।
এ অঞ্চলে প্রচুর
কার্পাসগাছ জন্মায়। নাম বাঙ্গার। যুগে যুগে বাঙ্গারের চাষ করতেন রাজবংশী সম্প্রদায়। পাটের সঙ্গে সুতো আর আজ পশম মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন, আরও
একটু নরম হালকা ধোকড়া। সেই
কাপড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিধেয়ও।
মেয়েদের হাতেই ধোকড়া প্রযুক্তি
কোচবিহার, উত্তর এবং পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ির
মালদহের গাজোল থানায় ধোকড়া শিল্পে যুক্ত রয়েছেন, রাজবংশী সমাজের বর্মণ, রায়,
দেবশর্মা উপাধিধারী মহিলারা।
আজও একটি লক্ষ্যনীয় প্রথা পালন করে চলেন রাজবংশী সমাজ।
এই সমাজে পুরুষের তাঁত বোনা নিষিদ্ধ।
ধোকড়া বোনেন রাজবংশী মহিলারা। প্রবাদ, পুরুষেরা তাঁত বুনলে পুরুষত্বে হানি হয়। আজও সমাজের পুরুষেরা এই নিষেধ মেনে চলেন। ঠিক যেমন গ্রামীণ নাটকগুলিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ সেদিন
পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল।
ধোকড়া প্রযুক্তি সমাজে
ধরে রেখেছেন রাজবংশী মেয়েরাই।
সেখানে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ।
পারম্পরিক ভারতীয় সমাজের এই চলনটি বেশ আকর্ষণীয়।
ভারতের নানান সমাজ তার সামাজিক আচার-আচরণ নিজেরমতকরে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বিগত দুশ বছরে ইওরোপ থেকে আমদানি হয়েছে এককেন্দ্রিক
রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের জাতিরাষ্ট্র দর্শণ।
খুব চালু স্লোগান এক জাতি, এক ধর্ম, এক সমাজ, এক ভারত। নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে পুরুষ-নারীর ছদ্মসমানাধিকারের
দর্শণ। ভারতীয়
গ্রাম সমাজ এই দর্শণ চেনেনা।
অথচ শহুরে মধ্যবিত্ত এগুলির ব্যাপক প্রয়োগও করে চলেছে ভারত জুড়়ে। তবু আজও এগুলোকে যতটা পারাযায় নিজের সমাজ থেকে
দূরে রাখেন গ্রামীণেরা।
ভারতীয় সমবায়ী প্রত্যেক সমাজ
তার নিজস্ব আচার আচরণ বয়ে নিয়ে চলেছে যুগের পর যুগ।
পাশের সমাজের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্রও সংঘাত হয় নি।
যদি কিছু হয়েওবা থাকে, তাকে আপসে মিটিয়ে নেওয়ার নানান উপকরণ মজুত রাখা ছিল সব কটি
সমাজেই। নির্দিষ্ট
কোনও আচার মানবতা বিরোধী অথবা প্রাচীণ অথবা অগণতান্ত্রিক নিদেনপক্ষে কুসংস্কার
হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার নব্য গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টা ছিল না। পরিবর্তন প্রয়োজন হত না কী! আসত সমাজের ভেতর থেকেই। নিজস্বতা বজায় রেখে হাজার হাজার বছর পাশাপাশি সমবায়ী
ভারতীয় সমাজ বেঁচে এসেছে, সভ্যতাকে বাঁচিয়ে এসেছে।
একে বহুত্ববাদ বলে কীনা তা নিয়ে গ্রামভারত বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায় নি।
ইওরোপ কথিত ভারতজোড়া
হিন্দুসমাজ চাপিয়ে দেওয়া দর্শণ।
প্রত্যেক সমাজের নিজস্ব আচার প্রথা আজও অনেকটা টিকে রয়েছে নিজস্বতার টানেই। মহিলা শাসিত রাজবংশী সমাজের সুপ্রাচীণ বিধিনিষেধ, সামাজ
পরিবর্তনের সঙ্গে কিন্তু এক্কেবারে মিলিয়ে যায়নি।
আজও অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক হাটে ধোকড়া বিক্রি করেন মেয়েরাই।
সুন্দর মননশীল ধোকড়া বুননের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে এই সমাজ-পরিবারে মেয়েদের
বিয়ের পাকা কথা। যেমন এক সময়ে
দক্ষিণবঙ্গের নানান জেলায় কাপড় বুনতে আর চাষ করতে না জানা মেয়েদের বিয়ে হওয়া
অত্যন্ত কঠিন ছিল।
বাঙলার ঐতিহ্য
উত্তরবঙ্গে দুই দিনাজপুর জেলায় ধোকড়া তৈরির প্রবণতা এবং
উতপাদন ক্ষমতা অন্যান্য জেলাগুলো থেকে অনেক বেশি।
আজ এই অঞ্চলে ৩৩ হাজার শিল্পী সরকারি তালিকাভূক্ত।
স্থানীয়রা বলেন এই ভৌগোলিক এলাকায় এক লক্ষ মানুষ ধোকড়া বয়নশিল্পকে কেন্দ্র করে
জীবিকার ব্যবস্থা করেন।
ভারতীয়
পরম্পরার শিল্পের সরলতম প্রযুক্তি এক আশ্চর্য উদ্যম বয়ান করে।
মসলিনেও ছিল অসাধারণে সাধারণ বোনার পদ্ধতি। লক্ষাধিক শিল্পীর ধোকড়া বয়ন পদ্ধতিও বেশ সরল। যন্ত্রও সরল। খুব বেশি যায়গা দখল করে না। বিদ্যুতও লাগে না। নানান প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে, সাধারণ কিন্তু বংশপরম্পরায়
চূড়ান্ত দক্ষতায়, স্বর্গীয় সব দ্রব্য প্রস্তুত করতে পারা ভারতের গ্রামপ্রযুক্তির
অন্যতম জোরের যায়গা।
চাপিয়ে
দেওয়া, জটিল, মুনাফাখোর, এককেন্দ্রিক, বিশ্বধংসকারী, সামাজিক সম্পদ অপচয়ের চূড়ান্ত
অপদার্থতা উন্নততর আধুনিক সর্বরোগহর প্রযুক্তি আখ্যা পেয়েছে। প্রচুর অর্থ খরচে সরকারি উদ্যমে, পশ্চিমি প্রযুক্তি ভারতে
তৃণমূলস্তরে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে আড় হয়েছে গ্রামসমাজ। পারম্পরিক প্রযুক্তির আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকার অন্যতম
শর্তই হল, যত সম্ভব কম সম্পদ ব্যবহার করে, নিজে বেঁচে থেকে বিশ্বকে বাঁচিয়ে রাখার
পদ্ধতির বিকাশ। ধোকড়া শিল্প প্রযুক্তি বাঙলার
নিজস্ব প্রযুক্তির চলতাফেরতা জীবন্ত নিদর্শণ। একে যাদুঘরে সাজিয়ে রাখার প্রয়োজন হয় নি। হাজার হাজার বছর ধরে সহজ সাধারণ কলে, সমাজে বসে, রোজকার
আচার আচরণ পালন করে সুন্দরতম ডেকরা আজও টিকে রয়েছে নিজের জোরে।
রাজবংশী প্রযুক্তি
ধোকড়া বুনতে প্রাথমিক প্রয়োজন দুটিমাত্র খুঁটি।
এই দুইকেই মূল দণ্ড হিসেবে
ব্যবহৃত করে ধোকড়া বোনার কাজ হয়।
রাজবংশী ভাষায় এই দণ্ডের নাম
তাঁতপোই। জলে ভেজানো
পাট থেকে ছাল ছাড়িয়ে আঁশ বা খোয়াগুলোকে চিরে লাছি তৈরি হয়।
লাছি নাচো(টাকু)র সাহায্যে পাকিয়ে সুতো তৈরি হয়।
পাটের গোড়ার অংশের নাম ফোতা আর মাথার অংশটি পাইন।
ফোতা মোটা আর পাইন সরু। একটি তাঁতপোইতে দেড় হাত চওড়া
আর পাঁচহাত লম্বা কাপড় তৈরি হয়।
নাম ফাটি। তিনটি ফাটি
জোড়া দিয়ে তৈরি হয় একটি পুরো ধোকড়া।
তাঁতপোইএর প্রত্যেক অংশ টুকরো টুকরো। তাঁতপোইএর জন্য দুটি বাঁশেক খুঁটি দুহাত দুরত্বে
মাটিতে পোঁতা থাকে। দুটি খুঁটির সঙ্গে
সমাম্তরাল বাঁধাথাকে দুটি বাঁশ - তাছলা। তাছলার ওপরে একটি কাঠি এবং নিচে একটি বাঁশের কাঠি বাঁধা। এটি নাম দণ্ডর। নিচের দিকে আরও যে কয়েকটি কাঠি পরপর সাজানো
থাকে তাকে বলে জালো কাঠি, পিঁপড়ি
কাঠি,
কোপনি কাঠি। বোনার
সময় প্রথম টান পড়বে কোপনি কাঠির। কোপনি
কাঠিটি টানা থাকে দুটি ছোট খোঁটার সাহায্যে। টাকুর
সঙ্গে সুতো যখন মাকুতে যায় তখন তাকে বলে কান্তা। এবারে তৈরি হয় এক একটি ফাটি।
চওড়া ফাটিকে বলে পেটোয়ান। তখনই ধোকড়ার ওপর নকশার কাজ শুরু হয়। মোটা সুতো গাঁথার জন্য অর্ধচন্দ্রকার মোটা ও চওড়া
লাঠি বেওন দরকার। সরু সুতোর কাঠিকে বলে
আলনি। রাজবংশী বয়নী মজবুত ও ঘন জালের একটি অংশ কোমরে
পেছনে বেঁধে বোনার কাজ শুরু করেন। এর
নাম নেত্তুরং। ফাটিগুলো জোড়া দিতে শিল্পীরা এমন ধরণের সুতো
তৈরি আর ব্যবহার
করেন যেন মনে হয় যন্ত্রে বোনা। জোড়া নয়। খালিচোখে ধরা মুশকিল।
ধনঞ্জয় রায় বলেছেন রাজবংশী
সমাজ অশিক্ষিত
বলেই ধোকড়ার নকশা আদ্যিকালের রীতিতে থেকে গিয়েছে। শহরের শেকড় ছেঁড়া মানুষ কী চায়, সে নিজেও জানে না। তাকে যা বোঝানো হয় সে তাই বোঝে। অথচ রাজবংশী সমাজ শেকড়ে নিজের জোরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার নিজের প্রযুক্তি, নিজের হাতে বিকাশকরা প্রযুক্তি আর
শিল্পের আনুগত্য, নিজের সংস্কৃতিকে ভালবাসাই চলমান সভ্যতা।
টিকে থাকা পরম্পরা, নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক রীতির জন্ম দেয়। বাঙলা বাঙালি ভারত সভ্যতা
ভাগ্যবান। আজও ভারতের গ্রামসমাজের নিয়ম মেনে রাজবংশী প্রাচীণেরা
তাঁদের পুরোনো সভ্যতাকে আঁকড়ে রাখছেন। সাগরপারের বয়ে আনা আধুনিকতার
মড়কের এই পাড়ভাঙা সময়েও।
প্রকৃতির রং
পশ্চিমি যন্ত্র ছাড়াই আজও রাজবংশী সমাজ হাতে তৈরি ধোকড়া শিল্পের রংও পুরোপুরি ঐতিহ্যশালী পারম্পরিক পদ্ধতিতে করেন। এই কাজে ঝিমুল, জিগা, ভেরেণ্ডা, আমের কুষি, বসনবৈরএরমত নানান ধরণের গাছের পাতা, ফল, ছালের রস ব্যবহার হয়। এর সঙ্গে সোড়া আর নুন জলে মেশানো হয়।
সেটি সিদ্ধ করে কালো, খয়েরি, লাল রং বের করেন শিল্পীরা।
ধোকড়ার হাট
ধোকড়ার হাট বসে পশ্চিম দিনাজপুরের
বংশীহারি থানার সরাই, ইটাহারের
পাতিরাজ, কালিয়াগঞ্জ
থানার ধনকৈল আর কুনোর, করণদিঘির
রসখোয়া, দার্জিলিংএর নকশালবাড়ি, মাটিগড়া। কয়েক দশক আগেও প্রতি বছর ধোকড়ার বাজার ন্যুনতম ২
কোটি ৮৫ লক্ষ ১২ হাজার টাকা ছিল।
আপনাকে সে চায়
ধোকড়া শিল্প
অন্ততঃ অন্যন্য বয়ন আথবা পারম্পরিক কারু শিল্পের মত চরম সংকটে নেই। শেকড়ে থাকা রাজবংশী সমাজ আজও মহা উত্সাহে টিকিয়ে
রেখেছে এই শিল্পকর্ম। তবুও আপনার বাড়ানো হাত সে
ধরতে চায়। দেশগ্রাম দেখতে বেরোনো বহু ভ্রমণবন্ধু বালুরঘাট অথবা রায়গঞ্জ অথবা তার
আশেপাশে ঘুরতে যান। উত্তরবঙ্গের
আরও ওপরে যেতে গিয়ে এক রাত্তির হয়ত ঐতিহাসিক রাইগঞ্জ, আজকের রায়গঞ্জে থমকে রাত
কাটান। কুলিকেও যান। দয়া করে অবশ্যই একটি হলেও ধোকড়া সংগ্রহ করুন। পরিবারের নিজস্বতা এবং সমাজের প্রতি অনুরাগ প্রকাশের এর
থেকে ভাল উপায় আর হয় না।
ধোকড়া শিল্পীরা আজ ধোকড়ার চাদর ব্যবহার করছেন দৈনন্দিনের নানান ব্যবহার্য
তৈরিতে। পাপোষ থেকে
কাঁধের থলে পরম্পরার কল্পনার রঙে রাঙানো।
ধোকড়া থেকে তৈরি জিনিষপত্র খুবই আকর্ষণীয়। প্রিয় দৈনন্দিন কাঁধের শান্তিনিকেতনি থলেকে নামিয়ে
না রেখেও, সপ্তাহে দুএকদিন ধোকড়ার ঝোলা ব্যবহার করাযায়।
নজর কাড়ুক রায়গঞ্জের ধানসিড়ি, কলকাতার বাঘাযতীনএর সিজন ফোর, অথবা
মানিকতলার পরমএরমত দোকান।
মিলবে ধোকড়াসহ বাঙলার পারম্পরিক কারুশিল্পের নিদর্শণ। এঁরা হাত মিলিয়েছেন বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র
শিল্পী সংঘের সঙ্গে।
রাজবংশী
সমাজে বেঁচে থাকারই নাম আসামান্য ধোকড়া শিল্প। সমাজের প্রাণ স্পন্দনের অনুভূতি সামান্যে অসামান্য এই শিল্পকর্মের
ছোঁয়ায় আরও আবিল হোক। থোড়-বড়ি-খাড়া
জীবনে যোগ করুক ব্যতিক্রমী রং।
শিল্পবন্ধুর বাড়ানো হাতের ছোঁয়ায় বেঁচে থাকুক শেকড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাঙলার
এক সমাজের শিল্পীত স্বাধীণ নিজস্বতা।
গ্রামসমাজ এর বেশি আর কিছু চায় না।
No comments:
Post a Comment