গ্রাম বাঙ্গালির রান্নাঘর
মধুদার বাড়ি
গ্রাম বাঙ্গালির রান্নাঘর এক অত্যাশ্চর্য কুঠি। এতোটুকুন এক ঘরে এত্ত বড় পুষ্টি-স্বাদ-সমাজ রক্ষার এই প্রবাহিত অবিছিন্ন পরম্পরা, বহু বিজ্ঞাপিত, বহুচর্চিত, কর্পোরেট নন্দিত শহরের রান্নাঘরে মিলবে কিনা সন্দেহ। খুব সম্প্রতি কলকাতার সব থেকে বড় সকালের সংবাদপত্রে মহিলাদের ব্যাঙ্ক স্থাপন এবং তার প্রথম প্রকল্প হিসেবে শহরের খুপরি বাড়িতে 'আধুনিক' রান্নাঘর স্থাপনের জন্য ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সগর্বে ঘোষিত হয়েছে। তাতে আধুনিক শহুরে বুদ্ধিজীবীকুল আকুল উদ্বাহু। সরকারি এই উদ্যমে মধ্যবিত্তের রান্নাঘরের করপোরেটাইজেসন যতটুকু বাকিছিল তার ষোলকলা পুর্ণ হবে সন্দেহ নেই। সরকারি প্রকল্পের মধ্যবিত্ত কেন্দ্রিকতার এ এক চূড়ান্ত নিদর্শণ। কতদিন আর মধ্যবিত্তকে পুষতে খয়রাতি করবে ভারত সরকার? জয়াদি বলছিলেন, উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের রান্নাঘরের জন্যও কি এই সরকারি ব্যাঙ্ক এরকম হাত বাড়িয়ে দেবে! এ বিষয়ে ভবিষ্যতে বিশদ আলোচনার ইচ্ছে রইল। অতীতে এ নিয়ে এরিক ক্লোজারের ফাস্ট ফুড নেসন আলোচনায় কিছুটা উল্লেখ করেছি। এই খবর সেই প্রসঙ্গকে আরও একটু উস্কে দিল।
অথচ গ্রাম বাঙ্গালির রান্নাঘর অনাদি অতীত থেকে অদম্য বাংলার গ্রামীণ প্রযুক্তির অনন্য দৃষ্টান্ত যা শুধুই মহিলাদের বিচরণক্ষেত্র। এতদিন রান্নাঘরকে খুব দুর্নাম করেছে পশ্চিম। গ্রামীণ হেঁসেলঠেলাকে পিছিয়ে পড়া এই সমীকরণ টানা হয়ে যায় সরকারি-কর্পোরেট মিলিত উদ্যমে।
এই রান্নাঘরে মধুদার আত্মীয় যমুনা রান্না করছেন বাঁধাকপি। তিনটি ঝিকওয়ালা একমুখো কাঠের চুল্লিতে। রান্না ঘরটির চার পাশ খোলা মেলা। বাঁশের মোটা বাতায় বোনা চাটাইয়ে ঢাকা। মোটা করে বোনা হয়েছে যাতে এটি বহুদিন টিকতে পারে। যমুনার সামনের উনুনের দুদিক ঘিরে রয়েছে এই চাটাই। এর মধ্যে দিয়ে উনুনের ধোঁয়া সহজেই বেরিয়ে যায়। আদতে সরকারি বহু প্রকল্পে নতুন ধরনের চুলা পরিকল্পিত হয়েছে, কল্পিত হয়েছে রান্না ঘরের মধ্যে কি ভাবে মেয়েরা ধোঁয়ায় নির্যাতিত হন, পুরুষতন্ত্র কিভাবে মেয়েদের রান্না ঘরে আটকে রেখে তাদের রোগ জীর্ণ করছে। আমরা এই যে রান্না ঘর দেখছি মধুমঙ্গল মালাকারের বাড়িতে সেটিতে যথেষ্ট আলো আসছে, ধোঁয়া বাইরে যেতে অসুবিধা নেই আর রান্নাঘর বেশ সাফ সুতরো।
কাঠের জ্বালন দেওয়া হয়েছে কড়াইতে। এই জ্বালন নিয়ন্ত্রন করে রান্না সারা হয়। নানান ধরনের রান্নার নানান ধরনের জ্বালন। আবার জ্বালন প্রয়োগের বিধি রয়েছে। কখন পাটকাঠি, কখন নারকেল পাতা, কখন মোটা ডাল, কখনও শেষ আঁচে জ্বালন প্রয়োগ না করে জ্বলতে থাকা কাঠ কয়লার গরমেই রান্না হবে তা জানেন কুশলী গৃহিণী, রাঁধুনি। আমার মনে আছে তিনটি ঝিকের পাশে বসিয়ে নানান জিনিস সেঁকে নিতেন আমার দিদিমা। এই গ্যাসের রান্না ঘরেও মা বার্নারের পাশে নানান জিনিশ বসিয়ে সেঁকে নেন। সেই অভ্যেস তার রয়ে গিয়েছে। আদতে এতো সাশ্রয়ের অভ্যেস। কম উপকরণ দিয়ে যত বেশি কাজ করে নেওয়া যায় তার দর্শন। এই দর্শনেই বিশ্ব বেঁচেছে।
পেছনে বিভিন্ন জিনিস রাখার তাক |
আরও স্পষ্ট করে দুপাশের চাটাই আর ঝুলতে থাকা শিকে। স্থানের ত্রিমাত্রিক ব্যবহার |
রান্নাঘরের বাইরের দিকের চাটাই, জানালাসহ, ধোঁয়া বেরচ্ছে। চাটাইকে দেখে মনে হচ্ছেনা খুব ময়লা। অথচ মধুদার মাটির বাড়ি। দালানটা মাটির। সামগ্রিক বাড়িতে গৃহিণীর গিন্নিপনা যেন ফুতে বেরুচ্ছে |
রান্না ঘরের বাইরে এর একটি উনুন। যদি বেশি অতিথি এসে যায় বা নিরামিষ রান্না করতে হয়, আমিষ বাঁচিয়ে |
রান্নাঘরের সম্পুর্ণ দৃশ্য। পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন এবং টেঁকসই এবং শুধুই গৃহিণীদের দ্বারা চালিত ও পরিকল্পিত |
No comments:
Post a Comment