তখন দুপুর। খাওয়া হয়ে ওদের দাওয়ায় বসে আছি। জয়াদি মাটির ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। জয়াদি সক্কালেই জানিয়েছেন দেবব্রত(ডাক নাম পার্থ) তার কলেজে মাস্টার হওয়ার ইচ্ছে নেই। সে পরম্পরা ধরে রেখে গ্রামকে জোরদার করতে চায়। আমরাও কলাবতী মুদ্রায়, সঙ্ঘে সেই কাজই করছি। তবে আমাদের মত করে, গ্রামের মত করে, গ্রামের দর্শন সম্বল করে, পরম্পরা আরও জোরদার করে। গ্রামের সম্পদ, অর্থ সব ঝাঁকবেঁধে শহরে চলে আসছে। শহরের টাকা গ্রামে যাচ্ছে না। সেই কাজটি যথেষ্ট উদ্যমে সম্পাদন করা দরকার। ব্রিটিশ আমল থেকেই শহরের টাকা গ্রামে আসার প্রবণতা শেষ করে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীন ভারত সেই পরিকল্পনা বুকে ধরে এগোচ্ছে। গ্রাম শহরের উপনিবেশমাত্র। সেই প্রবণতাকে ক্রমে ক্রমে বদলাতে হবে। কারু শিল্পীদের হাটে যাওয়া, শহরে বাজার বাড়ানো আর কারু ভ্রমণ তেমনি কয়েকটি সঙ্ঘের পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনায় কেন্দ্রীকরনের কোনো স্থান নেই। গ্রাম সমাজই সেই পরিকল্পনা তৈরি আর রুপায়ন করবে। আমরা শুধু সাথী থাকব। পার্থকে এই কাজে সামিল করা, পার্থর সমাজ, পরিবারকে এই কাজে পেলে কাজ ভাল হবে, কাজ শুভ উদ্যেশ্যে এগোবে এটি আমাদের বিশ্বাস।
সক্কলে বসে আছি। পার্থর কাকা বলছেন তারা গরীব। আলোচনা করে ঠিক হল তাদের এত জমি, এত সম্পদ তারা কেন নিজেদের গরীব ভাবছেন? আমরা আমাদের দর্শনের কথা বললাম। সঙ্গে কথা উঠল এই গ্রামে যদি একটি ভ্রমণ পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়। যদিও রসিক বিলে বন দপ্তরের বিস্তৃত থাকার স্থান রয়েছে, তবুও কারু শিল্প গ্রামগুলো নিয়ে যে অন্য ধরনের ভ্রমণ পরিকল্পনা করছি, সেটি আরও পরিকল্পিতভাবে করা যেত। তারা আমাদের কথা শুনছেন। সঙ্গে যোগ করলাম সংগঠনের কথা। কেন সংগঠন জরুরি। আমরা কি করি, কিভাবে সংগঠন গড়ে তুলেছি, কিভাবে কাজ করি ইত্যাদি। গ্রামে ভ্রমণ পরিকাঠামো গড়ে উঠলে কি কি সুবিধে হবে ইত্যাদি।
জয়াদি হঠাত ঘর থেকে উঠে এলেন। আলোচনা শুরু হল গ্রাম ভ্রমনে কি কি অসুবিধে। গ্রাম না শহরের চাপে দুষিত হয়ে যায়। যারা গ্রামে ঘুরতে আসবেন তারা গ্রামের মত না থেকে গ্রাম তাদের মত হওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে। সেটি করা যাবে না। আমরা সক্কলেই একই কথা ভাবছিলাম। আলোচনা হল। কত কম অর্থে, কত কম সম্পদে, গ্রামেরই সম্পদ কাজে লাগিয়ে কিভাবে একটি পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়। তারা বলছিলেন গ্রামের নানান কারু আর বস্ত্র শিল্পের কথা। আমরা জানালাম সংগঠন তাদের সদস্যদের দিয়ে নতুন করে সেই ভেঙ্গে পড়া শিল্প ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পারে। তার আগে সেখানে সংগঠনের বীজ পুঁততে হবে। তারা রাজি। আমরা কয়েকটি কর্মশালার পরিকল্পনার কথাও বললাম। ছোটো তাঁত, বাঁশ বা কাঠের কাজের পরিকল্পনা করা যায়।
মধুদা দূরের এক গাছে দেখলেন। তার একটি ফল কৃষ্ণডিঙ্গা। ফলটির আবরণের ভেতরে প্রচুর পাখাওয়ালা ফল থাকে - অনেকটা ফুলের মত দেখতে - পেকেগেলে সেগুলি উড়ে যায়। সেগুলি বাঁশের ছিলকার গায়ে লাগিয়ে ফুলের ঝাড়ির আকার দেওয়া যায়। মধুদা সেটিকে পেড়ে আনতে বলে একটি বাঁশ যোগাড় করলেন। জলপাইগুড়ির সব গ্রামের বাসিন্দাই বাঁশের কাজ জানেন। তাদের বাঁশ শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলা খুব সহজ। মধুদা সেই কর্মশালা সেইক্ষনেই শুরু করলেন। পার্থর কাকা জগন্নাথবাবুকে নিয়ে। শুরু হল জীবন্ত হঠাৎ কর্মশালা। বাঁশদানিতে বাঁশের ফুল তৈরি আর স্থানীয় বাজারে বিক্রি। কলকাতার মাঠে বিক্রি হয় ১০০ টাকায়।
নিচে সেটি তুলে দিলাম। ছবিতে কাজ করছেন মধুদা আর পার্থর কাকা জগন্নাথবাবু।
|
বাঁশ এল। জগন্নাথবাবুর হাটে কাটারি আর বাঁশ। |
|
কাজ চলছে। আমরা দর্শক |
|
কৃষ্ণডিঙ্গা ফলের মধ্যে কয়েক হাজার ফুল |
|
মধুদা আর জগন্নাথবাবু |
|
জোর কদমে কর্মশালার বাঁশের ছিলকা বার করা হচ্ছে |
|
ছবি তুলছে পার্থ |
|
কর্মশালার প্রাথমিক কাজ প্রায় শেষ |
No comments:
Post a Comment