দ্বারকানাথ নিজের জমিদারিকেও সফল ব্যবসার রূপ দিতে পেরেছিলেন। তাতে কোটি কোটি বাংলার রায়তের কোনো সুবিধে না হলেও দ্বারকানাথের হাতদিয়ে ঠাকুরবাড়ির এক শাখার সম্পদ ক্রমশঃ বেড়েছিল চক্রবৃদ্ধিহারে, গুণোত্তর প্রগতিতে। বিশেষ করে জমিদারদের কাছে তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী, যাঁর বাজার সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্ট। তিনি জমিদারদের সেই অধরা বাজারের প্রধান মুতসুদ্দি, যার মাধ্যমে জমিদারেরা বাজারকে ছুঁতে পারেন। আর ইওরোপিয় ব্যবসায়ীদের কাছে তিনি একমাত্র সফল জমিদার কেননা জমিদারির আইনটা দ্বারকানাথ বেশ ভালই বোঝেন। আর তাঁর ব্যবসায়ীমহলে সরাসরি যোগাযোগ এবং বাংলার জমিদারির পকড় আবলম্বন করে, ব্যবসায়ীরা জমিদারদের সঙ্গে কীভাবে দরকষাকষি করবেন সেই পথ তিনি ব্যবসায়ীদের বাতলে দেওয়ার মুরোদ রাখতেন।
পিতা রামলোচনের কাছ থেকে তিনি বিরাহিমপুর, যশোর, কুমারকুলি আর পাবনার বিশাল জমিদারি অর্জন করেছিলেন। তাঁর জমিদারিতে নীল আর রেশমের চাষ হত। এছাড়াও কটক, পান্ডুয়া আর বালিয়ায়ও তালুক ছিল। ১৮৩০এ তিনি রাজসাহির কালিগ্রাম আর ১৮৩৪এ পাবনার সাহাজাদপুর জমিদারি কেনেন। উত্তরপুরুষ ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী পুস্তকে বলছেন ...কালীগ্রাম ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে এবং সাহাজাদপুর ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে এবং অন্যান্য জমিদারীও এই সময়ের কাছাকাছি কেনা হইয়াছিল। এইরূপে চাকরী করিবার মধ্যেই অনেক জমিদারী কিনিয়া এক বিস্তৃত ভূম্যধিকারী হইয়া বসিলেন। ১৮৪০সালে বহরমপুর, পান্ডুয়া, কালিগ্রাম আর সাহাজাদপুরের জমিদারির সমস্ত আয়ব্যয় একটি অছিতে সমর্পণ করে তার পুত্রদের দিয়ে যান। অন্যান্যগুলি জমিদার-অংশিদারদের সঙ্গে তাঁকে ভাগ করে নিতে হয়েছিল। তাঁর জীবনীকারের ভাষায় দক্ষিণ বঙ্গের মোট জমির আয়ের এক পঞ্চমাংশ আয় আসত তাঁর জমিদারি থেকে।
কিভাবে তিনি সেই জমিদারি কিনছেন, তা নিয়েও বাজারে বেশ কানাকানি ছিল, আজও রয়েছে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নিরাবয়ব তর্জনী দেখিয়েও সেই ফিসফিসানি আজও থামানো যায় নি। এ প্রসঙ্গে ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী পুস্তকে সাফাই গেয়ে বলছেন ...নিমকি বিভাগে কর্ম্ম করিবার প্রসঙ্গে অনেক লোকে তাঁহারও নামে জুয়াচুরী ও ঘুষের অপবাদ দিয়া থাকে। আমরা যতদূর অনুসন্ধানে জানিয়াছি, তাহাতে সাহস পূর্ব্বক বলিতে পারি যে তিনি একটি পয়সাও ঘুষ লয়েন নাই। অনেকগুলি ঘটনা তাঁর উপার্জ্জনের সহায়ক হইয়াছিল, প্রথমত তিনি নিজে পৈতৃক জমিদারীর অধিকারী ছিলেন, তাহা হইতে বাত্সরিক আয় ন্যুন্যাধিক ষাট হাজার ছিল। সে সময়ে তাঁহার খরচ পরিবার হিসাবে ধরিলে বাত্সরিক দুই তিন হাজারের অধিক হইবে না। আমরা তত্স্থানে দশহাজার টাকা ধরিলেও বত্সর বত্সর প্রায় পঞ্চাশ হাজার করিয়া সঞ্চিত করিবার অবসর ছিল। আনুমানিক চতুর্দ্দশ বত্সরে তাঁহার পালক পিতার স্বার্গপ্রাপ্তি হয়। ১৮০৮ খ্রীষ্টাব্দ হইতে দেখি যে প্রতি দশ বত্সরে তাঁহার পাঁচলক্ষ করিয়া টাকা জমিত। দ্বিতীয়ত, পূর্ব্বোল্লিখিতরূপে সুবিধামত ক্রয় করিয়া ও অর্থ সঞ্চয়ের অন্যতম ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। আরও দুই একটি ধনাগমের বিশিষ্ট পন্থা সেকালে ছিল। তন্মধ্যে একটি এই যে, সেকালে কালেক্টরের দেওয়ানের কর্ম্মে অনেক আইনসঙ্গত উপরিলাভ ছিল। উহাতে গবর্ণমেন্টের নিষেধ দূরে থাকুক সম্পূর্ণ সম্মতি ছিল। তত্করে দশ বত্সর দেওয়ানী কর্ম্ম করিয়া লক্ষ লক্ষ মুদ্রা সঞ্চয় করা কিছুই অসম্ভব ব্যাপার ছিল না। অন্যান্য লোকে তাহার অর্দ্ধেক অথবা চতুর্থাংশকাল কর্ম্ম করিয়া দশগুণ সম্পত্তি করা যাইত। ভক্তিভাজন রাজনারায়ণ বসু মহোদয় শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে এক পত্রে লিখিয়াছেন – সেকালে দেওয়ানদিগের যে যে বিষয়ে উপরি পাওনা ছিল, সেই সেই বিষয়ে নাজীরের মীরণের ন্যায় পাওনার হার নির্ধারিত ছিল, এবং সেই হার গবর্ণমেন্ট জানিত ছিল, কিন্তুগবর্ণমেন্ট এইরূপ উপার্জ্জনে আপত্তি করিত না।(নজরটান লেখকদের)
জমিদার হিসেবে দ্বারকানাথের আদর্শ ছিল ব্যবসাকেন্দ্রিকতা। তিনি সহৃদয় জমিদারের তকমা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চাইতেন। তার জমিদারি চালানোর উদ্দেশ্যই ছিল অর্থ রোজগার, আরও বেশি বেশি লাভ। এমনকী তিনি সরাসরি রায়তদের সঙ্গেও সংঘাতে যেতে পিছপা হতেন না। ১৮২৪ সালে বিরাহিমপুর জমিদারির ১১৬জন রায়ত আদালতে অভিযোগ করেন, দ্বারকানাথের জন্য বর্ষায় তাদের বাড়ি-ঘরদোর জলে ডুবে গিয়েছে। জমিদারের বাঁধ না দেওয়ার জন্য তাদের এই হালত। আদালতে জমিদার দ্বারকানাথ জানান বাঁধ দিলে অনেক ধানীজমি আর ৬০ থেকে ৭০টি বাড়ি ডুবে যাবে, তাই তিনি ভেবেচিন্তে বাঁধ দেননি। কিন্তু কোম্পানি সরকার আর বাঁধ কমিটি তদন্ত করে রায়তদের পক্ষে রায় দেয়। এরপর আবারও অভিযোগ। ১৮৩৩এ ২৪ পরগণার পরগণা খাসপুরের কয়েকজন রায়ত মাথামোটা জমিদারের (স্টোন হেডেড) বিরুদ্ধে সরাসরি গভর্নর বেন্টিঙ্কের দরবারে নালিশ করে বলে, জমিদার দ্বারকানাথ বে-আইনিভাবে তাদের খাজনা বাড়িয়ে দেন এবং আদালতে হেরে গিয়ে গায়ের জোর ফলাচ্ছেন। বেন্টিঙ্কের দপ্তর এবিষয়ে তাঁকে উদ্যোগী হতে বললে, তিনি কয়েকজনের বাড়তি খাজনা শুধরে দিলেও কয়েকজন অভিযোগকারীকে কয়েদ করেন এবং কোম্পানি সরকারে তাঁর নলচালানো শুরু করে দেন। এবারে রায়তরা অভিয়োগ আনেন যে, জমিদার বড়লোক, তাই ইংরেজ প্রশাসনের কালেক্টর, কমিশনার অথবা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁদের আবেদন কানে শুনছেন না। সরকার রায়তদের আবার আদালতে যাওয়ার কথা বলে, দ্বারকানাথের কাজকর্মের আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। অনেকটা সাপও মরল লাঠিও ভাঙলনা গোছের তিরস্কার। সরকার এবং দ্বারকানাথ উভয়েই জানতেন ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত আদালতে গেলে রায়তদের অভিযোগের কত দীর্ঘসূত্রিতা ঘটতে পারে। কোম্পানি সরকার, দ্বারকানাথের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা না নিয়ে রায়তদের আদালতে যেতে বাতলে দিল। এ বিষয়ে তাঁর অন্যতম উত্তরাধিকারী ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী পুস্তকে তাঁর জমিদারি সম্বন্ধে কি বলছেন মেপেজুপে নেওয়া যাক-
..পৈতৃক বিষয় দুইটি মাত্র- এক কুষ্ঠিয়ার অন্তর্গত বিরাহিমপুর পরগণা এবং দ্বিতীয়টি কটকের অন্তর্গত পাণ্ডুয়া ও বালিয়া দুইটি মহাল। যে সময় তিনি এই দুইটি পৈতৃক বিষয়গুলি স্বহস্তে দখল করেনসে সময় তাহাদের আয় অতি সামান্য ছিল- সর্বশুদ্ধ প্রায় ত্রিশ সহস্র টাকা হইবে। ইহার উপর আবার বিরাহিমপুরের প্রজাগণ বরাবর দুর্বৃত্ত বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল- সহজে খাজনা আদায় করিতে চায় না। ইহার অধিবাসী অধিকাংশ নিম্নশ্রেণীর মুসলমান। কথায় কথায় জোট বাঁধে এবং জমিদারকে খথাজনা হইতে বঞ্চিত করিবার চেষ্টা করে।
একবার বিরাহিমপুরের প্রজারা একজোট হইয়া জমিদারের খাজনা আদায় করিতে অস্বীকার করিয়া তদানিন্তন ম্যাজিস্ট্রেটের সরেজমিনে তদন্ত করিবার প্রার্থনার সহিত এক দরখাস্ত করিল। ম্যজিস্ট্রেট সাহেব সশরীরে আসিয়া একেবারে গ্রামের মধ্যস্তলে তাঁবু খাটাইয়া প্রজাদিগকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। তাহারা তো একে পায় তো আরে চায়। তাহারা তো একোবারে কাঁদিয়া পড়িয়া জমিদারের নায়েব গোমস্তাদিগের অত্যাচারের কাহিনী সকল বর্ণনা করিয়া তাহার প্রতিকার প্রার্থনা করিল। সাহেব মহোদয় উভয় পক্ষ না শুনিয়াই প্রজাদের দুঃখে বিগলিত হৃদয় হইয়া পড়িলেন। এইখানে বলিয়া রাখা কর্তব্য যে জমিদার ও প্রজার মধ্যে কোনও বিবাদ উপস্থিত হইলেই তদানীন্তন বিচারকগণের কথায় কথায় প্রজার পক্ষ, ন্যায় হউক বা অন্যায় হউক, সমর্থন করিতেন- ইহা একটা ইংরাজ কর্মচারীদিগের মধ্যে প্রথা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এখনও যে এই ফ্যাশান একেবারে উঠিয়া গিয়াছে তাহা বলিতে পারি না। ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুর প্রজাগণকে অভয়দান করিয়া তাহাদিগের অন্যায় কার্যে উত্সাহ দিতে লাগিলেন।
ভারতবর্ষ সিপাহি বিদ্রোহের পর প্রত্যক্ষ্যভাবে মহারাণীর অধীণে আসিবার পূর্বে অনেক ম্যাজিস্ট্রেটেরই খুঁজিলে নানান দোষ পাওয়া যাইত। দ্বারকানাথ ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্ব্ব জীবন অনুসন্ধানপূর্ব্বক বাহির করিয়া দেখিলেন যে উনি অনেকগুলি অন্যায় কর্ম্ম করিয়াছেন। এখন প্রস্তুত হইয়া দ্বারকানাথ বিরাহিমপুরে গিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে সাক্ষাত করিয়া উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিলেন যে কেবল খাজনা আদায় না করিবার জন্য এই একজোট হইয়াছে- ইহাতে যে কেবলস তাঁহার নিজের ক্ষতি হইতেছে তাহা নহে, ঐ অঞ্চলের শান্তিভঙ্গেরও সম্ভাবনা আছে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট এই একজোট ভাঙিয়া দিবার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করিলেন।
ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যুত্তরে দ্বারকানাথকে আমলাদিগেরহস্ত হইতে প্রজারক্ষণের কর্তব্য সম্বন্ধে দীর্ঘ বক্তৃতা করিলেন। দ্বারকানাথ পুণরায় বুঝাইলেন যে প্রজাদিগের নালিসের কোন ভিত্তি নাই এবং তাঁহাকে খাজনা আদায়ের অধিকার প্রত্যর্পণ করিলে ন্যায়ের মর্য্যাদা রক্ষিত হইবে। ইহাতেও যখন সাহেব বাহাদুরের দুর্মতি অটুট থাকিল, তখন দ্বারকানাথ তাঁহাকে ধীরে ধীরে তাংহার পূর্ব্ব জীবনের কথাগুলি স্মরণ করাইয়া দিয়া পুলিশের জিস্ট্রিক্ট সুপরারিন্টেন্ডেন্টের হস্তে সমর্পণ করিবার ভীতি প্রদর্শণ করাতেই সাহেব একেবারে নরম হইয়া গেলেন, জমিদারের সহায়তা করিলেন, শান্তি পুণঃস্থাপিত হইল- বিরাহিমপুর পদাবনত হইল।
এই বিরাহিমপুর অনেকদিন যাবত তাঁহাকে কষ্ট দিয়াছে ও বিরক্তির কারণ হইয়াছে দেখিতে পাই। ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে দেখি রাইস সাহেব নামক এক ইংরাদ সওদাগরকে সাধারণভাবে এই বিরাহিমপুরের ম্যানেজার স্বরূপ রাখিতে বাধ্য হইয়াছেন, বেধহয়, এই আশায় যে, সাহেব দেখিয়া প্রজাগণ ভয়ে সায়েস্তা থাকিবে এই বত্সর এপ্রিল মাসে দেখি প্রজারা পুণরায় এক জোট হইয়া যশোহরের ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট ইস্তফা দিয়া আসিতে লাগিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট সেিগুলি আবার তাহাদের নালিসের কারণ অনুসনাধানের জন্য দ্বারকানাথ ঠাকুরকে পাঠাইয়া দিলেন। তিনি প্রজাদিগের বদমায়েসী সম্পূর্ণ বুঝিতে পারিয়াও রাইস্ সাহেবকে তন্ন তন্ন করিয়া এই বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য পত্র লিখিলেন।
কেবল প্রজাদিগের দমনের জন্য তাহা নহে, বোধ হয় পার্শ্বস্থ নীলকরদিগের সাহেবদিগের কবল হইতে জমিদারি ও নিজ প্রজাগণকে রক্ষা করবার জন্যও সাহেব কর্মচারী রাখা আবশ্যক হইয়া উঠিয়াছিল। তাঁহার স্বেপার্জিত সাহাজাদপুর পরগণার প্রজাগণ যতদূর শুনা যায়, আবহমানকাল অতীব নিরীহ, কিন্তু এই ১ক৮৩৬ সালে সেখানেও দেখি মিলার নামক এক সাহেবকে ম্যানেজীর নিযুক্ত করিতেছেন। তাঁহাকে যে উপদেশপূর্ণ একটি পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতে নীলকুঠী নির্ম্মাণ করািবারও উপদেশ আছে।
এই মিলার সাহেবের বেতন নির্দ্দিষ্ট হইয়াছল মাসিক দেড়শত টাকী এবং নালকুঠীতে যত টাকার কাজ হইবে, তাহার দশকরা কমিশন।
No comments:
Post a Comment