অসামান্য বিপ্লবী দিগম্বরী
...শুনিয়াছি যে, তিনি বিলাত যাইবার কয়েক বত্সর পূর্ব পর্যন্ত্য মদ্যপান করা দূরে থাক, তাহা স্পর্শও করিতেন না। তিনি মাংসাদিও অধিক আহার করিতেন না। ক্রমে যখন তাঁহার ব্যবসায়ের বিস্তৃতির সঙ্গে বিস্তর সম্ভ্রান্ত ইংরাজ পুরুষ ও মহিলাদিগের সহিত আলাপ পরিচয় হইল, তখন বাধ্য হইয়া তাঁহাদের খাতির রাখিবার জন্য অল্প অল্প মদ্যপান আরম্ভ করিয়াছিলেন। ক্রমে সাহেবী খানাতেও যোগ দিতেন। ইহার যথার্থ্য সম্বন্ধে ইঁহার সহধর্ম্মীণীর কার্য্যকলাপ যথেষ্ট সাক্ষ্য দিবে। যথন হইতে দ্বারকানাথ সাহেবদিগের সহিত খানায় যোগ দিলেন এবং মদ্যপান করিলেন সেই দিন হইতে তাঁহার পত্নী নিজ সম্বন্ধে কার্য্যত বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়াছিলেন। ...আসল কথা এই যে, হয়তো কোন ইংরাজ মহিলা আসিয়া well Dwarakanath বলিয়া হাতে একটা বিস্কুট গুঁজিয়া দিলেন, তখন তো আর তিনি ফেলিয়া দিয়া তাহার অপমান করিতে পারেন না - ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী
তো, দ্বারকানাথের ছয় সন্তানের মধ্যে বাঁচলেন চারজন পুত্র সন্তান, দেবেন্দ্রনাথ(১৮২৬-১৯০৫), গিরীন্দ্রনাথ(১৮২০-৫৪), ভূপেন্দ্রনাথ(১৮২৬-৩৯), এবং নগেন্দ্রনাথ(১৮২৯-৫৮)। দ্বারকানাথের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির নানান আত্মীয় মহিলাদের সম্পর্ক খুব মধুর ছিল না। সে মা হেক অথবা স্ত্রী বা অন্য আত্মীয়। দ্বারকানাথের মা অলকানন্দা ছিলেন ধর্মশীলা। মৃতবৎসা অলকানন্দা দ্বারকানাথকে দত্তক নিয়েছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গ মা অলকাসুন্দরী পছন্দ করতেন না। কিন্তু ব্যবসায়ের কারণে এই মেলামেশাকে বাধাও দিতেন না। গোমাংসর ব্যাপারে একেবারে না। দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী শ্বাশুড়ি অলকাসুন্দরীর চেয়েও কঠোর। লক্ষ্মীনারায়ণের নিয়মিত সেবা করতেন। ঠাকুরবাড়িতে ইংরেজরা আসা যাওয়া করলেও তিনি তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন নি। দিগম্বরীর সম্বন্ধে ক্ষিতীন্দ্রনাথ বলছেন,
...দিগম্বরী দেবী যশেহরান্তর্গত নরেন্দ্রপুর গ্রামে পীরালি বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম রামতনু রায় এবং মাতার নাম আনন্দময়ী। আনুমানিক ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে দ্বারকানাথের সঙ্গে তাঁহার বিবাহ নিষ্পন্ন হয়। সুতরাং দ্বারকানাথের বয়স ১৫ বত্সর। শুনিয়াছি যে দিগম্বরী দেবীর ৬ বত্সর বয়সে বিবাহ হইয়াছিল। ...দিগম্বরীদেবীকে লোকে লক্ষ্মীর অবতার বলিত। তাঁহার হাতের আঙুল চাঁপার কলিরমত ছিল। তাহার কেশদাম কোঁকড়া ছিল। প্রতিমার পদযুগল শেরূপ সচরাচর গঠিত হয়, তাঁহারও পদযুগল সেইরূপ ছিল। তিনি নাতিহ্রস্ব নাতিদীর্ঘ এবং শরীরে দোহারা ছিলেন। আমাদের গোষ্ঠীতে প্রবাদ আছে যে আমাদের বাটীতে যে জগদ্ভাত্রী মূর্তি গঠিত হইত, তাহার মুখটি নাকি দিগম্বরী দেবীর মুখের আদর্শে গঠিত হইত। সেকানের বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা যাঁহাকেই তাঁহার রূপের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাঁহাদের সকলেই একবাক্যে বলিয়াছেন যে, তাঁহার রূপের কী বর্ণনা করিব, সাক্ষাত জগদ্ধাত্রী ছিলেন। নীলাম্বরী কাপড় খুবই প্রিয় ছিল। তাঁহার যথেষ্ট গাম্ভীর্য্য ছিল এবং তিনি খুব রাশভারী লোক ছিলেন।...তাঁহার নীরব শাসনের প্রতাপে গৃহ সুশাসিত ছিল। নীলমণি ঠাকুরের গোষ্ঠীই তখন জোড়াসাঁকোস্থিত ৬ নম্বর ভবনে একত্র বাস করিতেন। দিগম্বরী দেবীর বর্ত্তমান বাটীর উত্তরপূর্ব্বাঞ্চলের গৃহে থাকিতেন। ...তিনি প্রত্যুষে চারটার সময় উঠিয়া প্রাতঃকৃত্য এবং স্নান সমাধা করিয়া হরিনাম করিতে বসিতেন। তাঁহার একটি লক্ষ হরিনামের মালা ছিল। তাহার অর্ধেক অংশ প্রাতে সমাপন করিয়া সামান্য আহার করিতেন – আহারের প্রধান দুগ্ধ ও ফল। পরাণ ঠাকুর তাঁহার পূজার ও রাঁধিবার উপকরণ সংগ্রহ করিয়া দিতেন। তাঁহার পূজা এবং রাঁধাবাড়া হইয়া গেলে দুপুর বেলায় রাসপঞ্চাধ্যায়, শ্রামদ্ভাগবত প্রভৃতি বাঙালা গ্রন্থপাঠে সময় অতিবাহিত করিতেন। আবার বৈকালে মুখ হাত ধুইয়া হরিনামের অবশিষ্ট অংশ সম্পাদিত করিয়া ফেলিতেন। দয়া বৈষ্ণবী আসিয়া প্রায়ই গ্রন্থপাঠ করিত। রাত্রে তিনি হরিনাম করিয়া অন্ন আহার করিতেন। একাদশীতে ফলমূল আহার করা তাঁর নিয়মিত অভ্যাস ছিল।
এবং ইংরেজদের সঙ্গে দ্বারকানাথের মাখামাখি স্ত্রী দিগম্বরীর পছন্দ ছিল না।
...যতদিন দ্বারকানাথ প্রাচাণ ধরণের চালচলনে অভ্যস্ত ছিলেন ততদিন তাঁহার ওজস্বিতার পরিচয় দিবার অবসর হয় নাই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরগোষ্ঠী বৈষ্ণব ছিলেন এবং খড়দহের গোস্বামীদিগের শিষ্য ছিলেন। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরগোষ্ঠী শাক্ত ছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরগোষ্ঠী পূর্ব্বে মাংস বা পেঁয়াজ প্রভৃতি কোন প্রকার বৈষ্ণব বিরোধী দ্রব্য স্পর্শ করিতেন না। এই কারণে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরেরা জোড়াসাঁকোর ঠাকুদিগেকে মেছুয়াবাজারের গোঁড়া বলিয়া উপহাস করিতেন। ...শুনিয়াছি যে প্রথম প্রথম যথন দ্বারকানাথ ও রমানাথ রামমোহন রায়ের কথা মত মাংসাহারে প্রবৃত্ত হইলেন, তখন উভয়ের শরীর অসুস্থ হইয়া পড়িল এবং উভয়েই বমি করিয়া পরিত্রাণ পাইতেন। ক্রমে যখন অভ্যাস হইয়া পড়িল, তখন বাটীর এক বহিঃপ্রান্তে মাংস রাঁধিবার বন্দোবস্ত হইল। রামমোহন রায় বড়ই মুসলমানপ্রিয় ছিলেন। তাণহারই অনুকরণে দ্বারকানাথও মুসলমান বাবুর্চী রাখিয়াছিলেন। ক্রমে দ্বারকানাথের সঙ্গে ইংরাজদিগেরও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি হওয়াতে প্রকাশ্যেই তাঁহাদের সঙ্গে বসিয়া আহারাদি করিতেন। রামমোহন রায়ের অনুকরণে তিনিও অতি অল্প পরিমানে সেরি মদ্য পান করিতেন। দ্বারকানাথপত্নী স্বীয় ভ্রাতৃজায়া পুত্রবধু সমবিব্যবহারে বৈঠকখানাবাটীর একটি ঘরে যাইয়া যখন দেখিতে লাগিলেন যে, বিস্তৃত মধ্যকক্ষে তাঁহার স্বামী সাহেবদিগের সঙ্গে একত্র পানাহার করিতেছেন তখন অবধি তাহার হৃদয় ভাঙিয়া গেল, কিন্তু এই সূত্রে তাহার ওজস্বিতা প্রকাশ পাইল(ঐ)।
দ্বারকানাথের সঙ্গে দিগম্বরীর বেশ মনোমালিন্যও চলছিল ইংরেজ সংসর্গ নিয়ে। এ নিয়ে হয়ত দুজনের মধ্যে নানান কথা চালাচালি হয়েছে। দিগম্বরী তাঁর মনেরভাব স্বামীকে জানিয়েছেন। দ্বারকানাথ শোনেন নি। ঠিক করলেন দ্বারকানাথকে বর্জন করবেন। আশ্চর্যের কথা তিনি একা নন। তাঁর বিদ্রোহের পাশে এসে পাশে দাঁড়ালেন জোড়াসাঁকোর অন্য বধু আর মহিলারা। সে সময় ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের এই অভূতপূর্ব একটি পদক্ষেপ, যা সে সময়ের শহুরে মহিলাদের, ঠাকুরবাড়ির ব্যাতিক্রমী মহিলাদের নতুন করে চেনাতে সাহায্য করবে। এমন এক সময়ে তাঁরা এই কাজটি করবেন ঠিক করলেন, যখন বাঙলা তথা কলকাতার প্রগতিশীল সমাজেও পতি পরম গুরুই ছিল মহিলাদের একমাত্র ধ্যান জ্ঞাণ। যে যুগে, ইংরেজদের সঙ্গে একপাতে বসাটাই ছিল সামাজিক মর্যাদাবোধের প্রতীক, ইংরেজদের সঙ্গে, ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে দাঁড়ানোটাই সামাজিক অগ্রগতির প্রধাণ স্তম্ভরূপে বিবেচিত হত – সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে কাপড় পরিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে অন্তঃপুর থেকে বার করে ইংরেজ মহলে পরিচয় করাচ্ছেন, ইংরেজি সংস্কৃতি বরণ করে নিচ্ছেন, সেই ঠাকুরীয় উদ্যমে মধ্যবিত্ত বাঙালি আজও গদগদ। তার কিছু পূর্বেই ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মহিলাদের নিয়ে দিগম্বরী দেবীর প্রতিবাদীরূপ আজও বাংলার নারী আন্দোলনের অন্যতম ভিত রূপে পরিগণিত হয়না, ভুলেও কোনও লেখক ঠাকুরবাড়ির এই কান্ডটি নিয়ে আলোচনাও করেন না।
পরিগণিত হয়না কেননা, ভারতের নারী আন্দোলনের পুরোধারা সকলেই বিশ্বাস করতেন, আজও করেন, ভারতে নারীরা সকলেই ছিলেন অবগুণ্ঠিত, নিপীড়িত, শোষিত। ব্রিটিশরা ভারতে শাসন করতে না এলে নারী মুক্তি দুরস্ত ছিল। দিগম্বরী প্রগতিশীল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধাচরণ করছেন, তা তাঁরা মেনে নেবেন কী করে! এঁরা কেউ ব্রজমণি দেব্যা, রাণী ভবানী, দেবী চৌধুরাণী, রানী রাসমণি, হটু বা হটি বিদ্যালঙ্কার, কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি, নীলকর দমনকারী প্যারীসুন্দরী এমনকী আমাদের আলেচ্য দিগম্বরী, আরও শহরের বাইরে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা হাজারো লৌকিক ধর্মের মহিলা নেতৃদের লড়াইএর কথা শোনেন নি, শুনলেও পাতে দেবার বলে মনে করেন নি – কেননা স্বাধীণতাকামী ঠাকুরবাড়ির প্রত্যেকটি নারীই পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতীক ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন সাহস করে। তাঁদের কথা তাঁরা জানেনওনা, জানলেও জানতে চাননা। এই মহিলারা প্রায়সকলেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, শাস্তিও পেয়েছেন, অথচ দেশজ সংস্কারের পথ ধরে দেশের কুকুর ফেলে বিদেশি ঠাকুরের জন্য নিজেরদের প্রাণ নিবেদন করেন নি। দেশের সংস্কৃতিতে দৃঢ়ভাবে পা রেখে, দেশের প্রচলিত ব্যবস্থাকে মান্য করেই ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
স্বাধীণতা সংগ্রামী দিগম্বরী ঠাকুর আর ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য মহিলারা সিদ্ধান্ত নিলেন, দ্বারকানাথকে ইংরেজ সংসর্গের জন্য সরাসরি বর্জন করবেন জোড়াসাঁকো থেকে। বিদ্রোহী এই নারী বাংলার নানান এলাকা থেকে বাঘা বাঘা পণ্ডিতদের ডেকে সভা বসালেন কলকাতায়। সভার কাছে দিগম্বরী দেবী বিবাহবিচ্ছেদের বিধান চাইলেন। তাঁর তেজের সামনে মাথা নামিয়ে পণ্ডিতেরা এই মহাতেজাকে জানালেন ভারতীয় শাস্ত্রে স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ করে আলাদা হয়ে বসবাস করার বিধান নেই। একমাত্র স্বামীর থেকে আলাদা থাকা যায়। তিনি দেশজ সংস্কারকে শিরোধার্য করে ইংরেজদের সঙ্গ করছেন এই অভিযোগে, দ্বারকানাথ আর তার আত্মীয় চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়কে দিগম্বরীর দেবীর নেতৃত্বে জোড়াসাঁকোর মহিলারা মূল বাড়ি থেকে আলাদা করে দেন। দুজন পুরুষ বৈঠকখানাতে থাকতে শুরু করেন। মনেরাখতে হবে অনেক মহিলাই কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। তাঁরা কিন্তু বাড়র বাইরে আলাদা থাকেন নি। তাঁরা মূল বাড়িটিতেই থাকতেন। ইংরেজ সংসর্গে দোষী স্বামীদের থেকে আলাদা হয়ে।
...দিগম্বরীদেবী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতগণের নিকটে মতামত চাহিয়া পাঠাইলেন যে, যদি স্বামী ম্লেচ্ছদিগের সহিত একত্ত পানভোজন করেন, তবে তাঁহার সহিত একত্র অবস্থান কর্ত্তব্য কি না! তাঁহারা উত্তর দিলেন যে, স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্ত্তব্য। এই বিধান অনুসারে দিগম্বরী তাঁহার উপযুক্তমত সেবাকর্ম্ম ব্যতীত আর সর্বপ্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করিলেন। এখম বাহিরের লোকে তো আর ভিতরের সকল কথা জানিত না। তাহাদের আত্মীয়া স্ত্রীলেকেরা মা ঠাকুরুণের আসিয়া নিজ নিজ আব্দার জানাইত- কন্যা পিতার, ভগ্নী ভ্রাতার, মাতা পুত্রের, এইরূপে সকলেই আপনার লোকেক চাকরী করাইয়া দিবার জন্য দিগম্বরী দেবীকে অনুরোধ উপরোধ করত। তাঁহাকেও কাজেই ক্বারকানাথের সহিত এই সকল বিষয়ে কথা কহিতে হইত। শুনিতে পাই যে, যতবার তিনি দ্বারকানাথের সহিত কথা কহিতে বাধ্য হইতেন, ততবারই সাতঘড়া গঙ্গা জলে স্নান করিয়া নিজেকে পরিশুদ্ধ বোধ করিতেন। এ বিষয়ে তাঁহার দিনরাতের বিচার ছিল না(ঐ)।
কাজ সেরে রাতে দ্বারকানাথ জোড়াসাঁকো এস্টেটে ফিরে এলে, তাঁর সঙ্গে দেখা করে, জোড়াসাঁকো এস্টেটের দৈনন্দিনের পাইপয়সা হিসেবসহ নানান কর্ম বুঝিয়ে দিয়ে, দিগম্বরী হাড়কাঁপানো শীতের রাতে সাতঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করতেন। স্ত্রী আর জোড়াসাঁকোর মহিলাদের অসম্ভব জোরশিরদাঁড়া নিজের জীবনে অনুভব করেই, স্ত্রীর মৃত্যুর পরে পরেই দ্বারকানাথ স্বউদ্যোগে দেশের মহিলাদের ইংরেজি পদ্ধতিতে শিক্ষাদেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। প্যারীচরণ মিত্রের ভাই কিশোরীচাঁদ মিত্র মেমোয়ার অব দ্বারকানাথ ট্যাগোর পুস্তকে লিখছেন দ্বারকানাথ কলকাতার আর্চ বিশপকে স্ত্রীশিক্ষার উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে দেশের মানুষের এ বিষয়ে উদাসীনতার জন্য খেদ প্রকাশ করেন। স্বামীর সঙ্গে দেখা হলেই সাতঘড়া গঙ্গা জলে স্নান করতে করতে দিগম্বরীর নিউমোনিয়া হয় এবং, ১৮৩৯এর জানুয়ারিতে দ্বারকানাথের ১৩ বছরের সন্তান ভূপেন্দ্রনাথের মৃত্যুর দু দিন পরেই অসামান্য বাঙালি বিপ্লবী দিগম্বরীর দেহত্যাগ করলেন। বাংলার তথাকথিত নবজাগরণের ঐতিহাসিকেরা দিগম্বরীকে মনে রাখেননি, মনেরাখেন নি তথাকথিত মহিলা আন্দোলনের কর্তৃরাও। বেশ্যাপাড়া যাওয়া, মদখেয়ে মাতলামি করা, বিদ্রোহের নামে ধর্মবিশ্বাসীর বাড়ি গরুর হাড়সহ এঁটো কাঁটা ছোঁড়া, নিজের সংস্কৃতিকে সরাসরি অশ্রদ্ধা জানানো, স্বধর্ম পরিত্যাগ করারমত বাখিল্যতা, সর্বোপরি ইংরেজ হয়ে ওঠা চেষ্টাকে প্রগতিশীলতার, যেখানে রেনেসাঁজাত বিদ্রোহের ছাপ্পামেরেদিলেও আজও ঐতিহাসিকদের কাছে গ্রামীণ স্বাধীণতা সংগ্রামীদেরমতই দিগম্বরী আর ঠাকুরবাড়ির অন্য মহিলারা অচ্ছুত থেকেগিয়েছেন।
মনেরাখতে হবে ক্ষিতীন্দ্রনাথের লেখায় কিন্তু পাচ্ছি যে, দিগম্বরী রক্ষণশীল ছিলেন- মালা জপতেন ইত্যাদি। এমত রক্ষণশীল দিগম্বরী দেখছেন রামমোহন তাঁর স্বামীকে মদ্য মাংস সেবন করতে বাধ্য করতেন। প্রথম প্রথম দ্বারকানাথের শরীর খারাপ হতে শুরু করে। কিন্তু নিজের ভবিষ্যত ভেবে দ্বারকনাথ রামমোহনের অনুগামী হন। রামমোহন মদ্যমাংস প্রবেশ করিয়েছেন এমন এক বাড়িতে, যেখানে পেঁয়াজ পর্যন্ত প্রবেশ নিযেধ ছিল। সমগ্র বাড়িটি বাঘনাপাড়ার গোস্বামীদিগের অনুগামী ছিলেন। আশ্চর্য বাংলায় উপেক্ষিত মহীয়সী নারীটি কিন্তু স্বামীর মাংস ও মদ্য সেবনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন নি। তাঁর বিদ্রোহ ছিল স্বামীর ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশায়। তিনি এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মহিলারা যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সে যুগে, তা আজও প্রায় অকল্পনীয় বললেও অত্যুক্তি হয় না। দেশভাঙার কারিগরদের সঙ্গে তার স্বামীর মাখামাথি যে তিনি আর ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মহিলারা ভাল চোখে দেখছেন না এবং স্বামীকে বহিস্কারেরমত, স্বামীর সঙ্গ ত্যাগকরে আলাদা থাকার বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিজেরা দলবেঁধে নিচ্ছেন, তার স্বামীর পিতার ঠাঁই, জোড়াসাঁকো জমিদারিতে থেকেই। এই বৈপ্লবিক কর্মটি তিনি সে সময়ের কলকাতার আলালদের বালখিল্যতার মাধ্যেও কঠিণ হৃদয়ে মাথাউঁচু করে করতে পেরেছিলেন তা আজও অপার বিষ্ময় জাগায়। তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন, চরিত্র বিযয়টি ভীষণতম দুর্লভবস্তু – পুরুষ নারী ভেদ করা যায় না। বরং বাংলায় নারীরা যা পেরেছেন অর্বাচীণ পুরুষেরা তার ধারেপাশেও পৌঁছতে পারেন নি। চরিত্র ইংলন্ডের সংসর্গে, বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আদেখলেপনা করলে, বিদেশিদের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে দিলেও গজিয়ে ওঠে না। দেশজ সংস্কৃতি দিয়ে তাকে ধারণ করতে হয়, পালন করতে হয়, সময় এলে তাকে নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রয়োগ করতে হয়, এমনকী সে যদি আপন থেকে আপনতর কেউ হয়, সেও সেই চরিত্রানুগামী না হলেও তাকেও সেই ফল ভুগতে হয়। মহীয়সী নারী কথাটি ব্যবহারে ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এছাড়া গিদম্বরীর অন্যকোনও জুতসই সম্বোধন খুঁজে পাচ্ছি না। সেই অসামান্যা নারীকে আজ আমরা এই হৃদয়ের আকুতি জানিয়ে আভূমি প্রণাম জানালাম।
No comments:
Post a Comment