সত্যের অনুসন্ধান করে, যদি দ্বারকানাথ দোষী হয়েন, তাঁহাকে দোষী বল তাহাতে কাহারও কোনোরূপ আপত্তি হইতে পারে না। কিন্তু আজ হইতে বঙ্গবাসী ভ্রাতৃগণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও যে – যে সকল মহাপুরুষ তোমাদের মুখোজ্জ্বল করিয়াছেন, যাঁহাদের জন্য তোমরা রাজার জাতির নিকট প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছ, স্বদেশ গৌরবমন্ডিত হইয়াছে, বিনা অনুসন্ধানে, বিনা বিচারে তাঁহাদের নামে অপবাদ রটাইয়া দুর্ণাম ঘোষণা করিয়া নিজেদের সঙ্গে কলঙ্ক লেপন করিও না, আত্মহত্যায় প্রবৃত্ত হইও না - ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী।
রামমোহন রায়ের পৌত্তলিক শিষ্য দ্বারকানাথ ঠাকুরের সাম্রাজ্যবন্ধুত্ব সর্বজনবিদিত। ভারতের সর্বপ্রথম শিল্পদ্যোগীরূপে তাঁর পরিচয় দিতে শুধু বাঙালিরা শ্লাঘা বোধ করে তাই নয়, সর্বভারতীয়স্তরেও বেশকয়েকজন ঐতিহাসিকও সেই তথ্য পরিবেশন করেছেন অবাধে। ১৮৩০ নাগাদ দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার সমাজে, জমিদারিতে এবং সাহেবদের ব্যবসা মহলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক নাম। ১৮১২তে তিনি পূর্বজ রামলোচনের থেকে তাঁর উত্তরাধিকার বুঝে নিচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে দ্বারকানাথ জমিদারির আইনগত নানান দিক বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, যাতে আগামীদিনে শুধু নিজের জমিদারিই নয়, অন্য জমিদারদের থেকে তিনি তাঁর আর একটি আয়ের ব্যবস্থা তৈরি করতে পারেন। ১৮১৫তে বাংলার জমিদারির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বছর। কর্নওয়ালিসের দাওয়াই হিসেবে ১৭৯৩তে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থাকে মাথায় নিয়ে বাংলার জমিদারদের যে পথ চলা শুরু হয়, ১৮১২তে দেখাগেল, বাংলার প্রায় অর্ধেক জমিদারি নিলামে উঠেছে। যশোরের উদাহরণই দেখাযাক, ১৭৯৩তে ১২২টি জমিদারি ছিল, সেখানে ১৮০০তে দেখাগেল সেখানে ৫,০৪৪জনের ছোট জমিদারি তৈরি হয়েছে। রানী ভবানীর নাটোরের এই জমিদারির খন্ডীকরণে যেসমস্ত প্রখ্যাতরা তাদের জমিদারির শখ মেটাতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে দর্পনারায়ণ ঠাকুর আর গোপিমোহন ঠাকুর অন্যতম প্রখ্যাত। ঠাকুরবাড়ির যে সব প্রখ্যাতরা জমিদারিত্বকে কর্নওয়ালিসের দাওয়াই হিসেবে ব্যবসাররূপ দিয়েছিলেন তাদেরমধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর দুই প্রখ্যাততম উত্তরপূরূষ দেবেন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথের কাছে সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়েও বাংলার অন্যতম প্রধাণপুরুষরূপে আজও পরিগণিত। সরাসরি না হলেও রবীন্দ্রানাথ এবং কিছুটা দেবেন্দ্রনাথ যার সম্বন্ধে আশ্চর্যজনক হিরন্ময় নীরবতা অবলম্বন করেছেন, পুড়িয়েদিয়েছেন তাঁর ব্যবসা সংক্রান্ত নানান নথিপত্র, সেই উদ্যমী তিনি এই নতুন সহস্রাব্দেও নাকউঁচু মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্যতম প্রধাণপুরুষ হয়ে রয়েছেন, বাঙালি হিসেবে এমন সৌভাগ্য শুধু দ্বারকানাথ ঠাকুর ছাড়া বোধহয় অন্য কোনে প্রখ্যাতর জীবনে দেখা যায় না।
দ্বারকানাথ যে অসম্ভব উদ্যমী পুরুষ ছিলেন তা আজ নানান লেখায় প্রমাণিত, তথ্যভারে ভারাক্রান্ত। সমকালীন অনেকগুলি ব্যর্থতায় শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি একচক্ষু হরিণেরমত নিজের কাজকর্মে- চাকরি ও ব্যবসায় উদ্যমী ইংরেজদের সংশ্লেষ ঘটিয়েছিলেন অমিত দক্ষতায়। প্রায় নিজ হাতে তিনি গড়েতুলেছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একটি একটি ভিত্তিপ্রস্তর। ব্যবসার মুনাফা লাভে কোনও বাধাকেই তিনি বাধা বলে মনে করতেন না। তিনি একটু একটু করে মদ্যপান আর মাংস খেতে শিখলেন গুরু রামমোহনের হাত ধরে, যা তাকে ইংরেজ সংসর্গে অনেকটা এগিয়ে দেবে। নানান কাজে তাঁর উত্সাহ আজকেও বিষ্ময়কর। জমিদারি থেকে আফিম ব্যবসা, নীল উত্পাদন আর ব্যবসা থেকে রাম আর চিনি তৈরি, জাহাজের মালিকানা থেকে কয়লা খনির মালিকানা, টাকা ধার দেওয়া থেকে ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা সবকিছুতেই তার সাফল্য মাথা ঘুরিয়েদেওয়ারমতই। তবুও তিনি এই লাভের অংশিদার হয়েছেন তারই প্রজাদের শোষণ করে, জমিদারি তৈরি করছেন ঘুষ গ্রহণ করে, নীলচাষীদের সমর্থন করেছেন তাঁর নীল ব্যবসা বাঁচাতে এসব অস্বস্তিকর তথ্য আজও তার জীবনীকারেরা উহ্যরেখে যান। সেই উদ্দেশ্যে এই রচনাটি উত্সর্গীকৃত।
দ্বারকানাথ নিজের উদ্যোগেই জমিদারি আইন বিষয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করে তাঁর জমিদার জাতভাইদের জমিদারি নিয়ে আইনি পরামর্শ দানে উদ্যমী হলেন। ১৮১৫তে কলকাতাবাসী জমিদারেরা, সর্বগ্রাসী ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের কবল থেকে জমিদারি বাঁচাতে, সর্বস্বপণকরে নতুন ব্রিটিশ আইন বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ততদিনে দ্বারকানাথ নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা করে, এই আইনে বেশ সড়গড় হয়ে উঠেছেন। সে সময়ের কলকাতায় তাঁরমত জমিদারির নানান আইনি মারপ্যাঁচ জানার সঙ্গে সঙ্গে নানান ব্যবসা উদ্যমের আইন জানা উদ্যমী মানুষের সংখ্যা কিন্তু বেশ কম ছিল। যশোরের জমিদার রাজা বরদাকান্ত রায়, বাগবাজারের দুর্গাচরণ মুখার্জী, কাশিমবাজারের হরিনাথ রায় বা পাইকপাড়ার রানী কাত্যায়নীর জমিদারির আইনি পরামর্শদাতারূপে কাজ করতে শুরু করেছেন তিনি।
জমিদারদের আইন পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করার অনেকগুলি সুফল তার জীবনে পেয়েছিলেন দ্বারকানাথ। জমিদারদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের জেরে, কলকাতা বাজারের যথন সুদ ৮ থেকে ১২ শতাংশ, তিনি তখন জমিদার হরিনাথের থেকে ৭৫,০০০টাকা ধার নিচ্ছেন মাত্র ৪ শতাংশ সুদে। এর আগে তাঁর পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশদের দালালি করেই শুধু ধণ উপার্জন করেছেন। দ্বারকানাথ, তেমনি নিজে জমিদার হওয়ায় জমিদারদের সুবিধে অসুবিধেগুলো ভাল বুঝতেন বলে তাঁদের সমস্যাগুলো নিজেরমত করে সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। তিনিই বেধহয় প্রথম কয়েকজন জমিদারদের মধ্যে অন্যতম যিনি জমির বাজারটা, যে বাজারটা বিদেশিদের হাতেই তৈরি, বিদেশিদেরমতকরে বোঝার চেষ্টা করেছেন। দ্বারকানাথ বুঝতে পেরেছিলেন এদেশে ইংরেজি আইনকে দেশিয় জমিদার অথবা নতুন ধরনের উকিলেরা তখনও, চাইলেও ভালকরে বুঝতে পারেন নি। বুঝলেও কাজে লাগাতে পারেননি, নানান রকম সংযোগের অভাবে, যে যোগাযোগ ছিল দ্বারকানাথের, বিশেষ করে সাহেব মহলে। তিনি জানতেন-বুঝতেন বিদেশি আইন ব্যবস্থার মূল খাঁজখোঁজগুলি, যার মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর মক্কেলের সুবিধে বার করে আনতে পারতেন। তিনি জানতেন বিদেশি আইন ব্যবস্থায় মামলার রায় অনেকটা নির্ভর করে উকিলের ব্যাক্তিগত যোগাযোগর ওপর। দ্বারকানাথের সেটি ছিল, এবং পরে আরও সেই যোগাযোগ নিজে নানান ভাবে তৈরি করে নিয়েছিলেন। নিজ দক্ষতায়, যোগাযোগে, দ্বারকানাথ একে একে বাংলার জমিদারদের আইনি অভিভাবক হয়ে উঠলেন। ...সেকালে আজকালকারমত উকিল ব্যরিস্টারে ছড়াছড়ি ছিল না। যে দুই একজন ব্যারিস্টার ছিলেন, বাঙালিরা তখন সাহেব বলিয়া তাঁহাদের কাছে ঘেঁসিতেই সাহস করিতেন না। দ্বারকানাথ তখনকার বাঙালিদের মধ্যে অদ্বিতীয় আইনজ্ঞ ছিলেন বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। ব্যবস্থাশাস্ত্রে তাঁহার আশ্চর্য পারদর্শিতা ছিল। সুতরাং লোকেরা প্রয়োজন হইলে, তাহার নিকট আইন সম্বন্ধে পরামর্শ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে আসিতেন। অবশ্য দ্বারকানাথের কতকগুলি বাঁধা ঘর ছিল, তদ্ব্যতীত যে সকল লোক তাঁহার নিকট পরামর্শ গ্রহণ করিতেন, তাঁহাদেরও যথেষ্ট সুবিধা হইত এবং দ্বারকানাথের নিকট যে উপকার পাইতেন, তাহার প্রতিদানস্বরূপ তাঁহারা তাঁহাকে অর্থ প্রদান করিতেন। বলিতেগেলে দ্বারকানাথ নামে উকিল না হইলেও কার্য্যত একপ্রকার ওকালতী ব্যবসায় খুলিয়াছিলেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী
No comments:
Post a Comment