অহিফেন ঠাকুর
কুড়ি বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ১২৮৮র জৈষ্ঠ সংখ্যার ভারতীতে, জার্মান লেখার ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বন করে একটি প্রবন্ধ লেখেন, ভারতবর্ষীয় রাজস্বের অধিকাংশ এই অহিফেন বাণিজ্য হইতে উত্পন্ন হয়। কিন্তু অহিফেনের ন্যায় ক্ষতিবৃদ্ধিশীল বাণিজ্যের উপর ভারতবর্ষের রাজস্ব অথ অধিক পরিমানে নির্ভর করাকে সকলেই ভয়ের কারণ বলিয়া মনে করিতেছেন। ১৮৭১-৭২ খ্রিস্টাব্দে এই বাণিজ্য হইতে সাড়ে সাতকোটি পাউন্ডের অধিক রাজস্ব আদায় হইয়াছিল। কিন্তু কয়েক বতসরের মধ্যে তাহা ৫ কোটি ৩ লক্ষ পাউন্ডে নামিয়া আসে। এরূপ রাজস্বের উপর নির্ভর করা অত্যন্ত আশঙ্কার কারণ। ভারতবর্ষীয় অহিফেন নিকৃষ্ট হইয়া আসিতেছে, সুতরাং তার দাম কমিবার কথা। তাহা ভিন্ন চীনে ক্রমশঃই অহিফেন চাষ বাড়িতেছে।চীনে স্থানে স্থানে অহিফেন-সেবন-নিবারক সভা বসিয়াছে। ...এইরূপে চীনে অহিফেনের চাষ এত বাড়িতে পারে, ও অহিফেন সেবন কমিতে পারে যে, সহসা ভারতবর্ষীয় রাজস্বের হানি হইবার সম্ভাবনা। ... সমস্ত ভারতবর্ষে দেড় কোটি একর উর্বরতম জমি অহিফেনের জন্য নিযুক্ত আছে। পূর্বে সে সকল জমিতে শস্য ও ইক্ষু চাষ হইত। এক বাংলা দেশে আধ কোটি একরেরও অধিক জমি অহিফেন চাষের জন্য নিযুক্ত। ১৮৭৭-৭৮এর দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক কোটি লোক মরে। আধ কোটি উর্বর ভূমিতে এক কোটি লোকের খাদ্য জোগাইতে পারে। ১৮৭১ খৃস্টাব্দে জাক্তার উইলসন পার্লিয়ামেন্টে জানাইয়াছেন, মালোয়াতে অহিফেনের চাষে অন্যান্য চাষের এত ক্ষতি হইয়াছিল যে, নিকটবর্তী রাজপুতানা দেশে ১২ লক্ষ লোক না খাইয়া মরে। রাজপুতানায় ১২ লক্ষ লোক মরিল তাহাতে তেমন ক্শতি বিবেচনা করি না সে তো ক্ষণস্থায়ী ক্ষতি। এই অহিফেনে রাজপুতানার চিরস্থায়ী সর্বনাশের সূত্রপাত হইয়াছে। সমস্ত রাজপুতানা আজ অহিফেন খাইয়া আত্মহত্যা করিতে বসিয়াছে। অত বড় বীর জাতি আজ অকর্মণ্য, অলস, নির্জীব, নিরুদ্যম হইয়া ঝিমাইতেছে। আধুনিক রাজপুতানা নিদ্রার রাজ্য ও প্রাচীণ রাসজপুতানা স্বপ্নের রাজ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অতবড় জাতি অসার হইয়া যাইতেছে। কী দুঃখ! আসামে যেরূপে অহিফেন প্রবেশ করিয়াছে, তাহাতে আসামের অতিশয় হানি হইতেছে। বাণিজ্য-তত্বাবধায়ক ব্রুস সাহেব বলেন, অহিফেন সেবনরূপ ভীষণ মড়ক আসামের সুন্দর রাজ্য জনশূন্য ও বন্য জন্তুর বা,ভূমি করিয়া তুলিয়াছে এবং আসামীদের মতো অমন ভালো একটি জাতিকে ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধম, দাসবত্ এবং নীতিভ্রষ্ট করিয়া তুলিয়াছে। অহিফেন বাণিজ্য আমাদের ভারতবর্ষের তো এই সকল উপকার করিয়াছে।
কথিত যৌবনে বাপঠাকুর্দার ওপর রাগ করে দেবেন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রানাথ দুজনেই দ্বারকানাথের বহু কাজগপত্র পুড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে দ্বারকানাথকে নতুন করে উপস্থিত করার অন্য উপায়ও আজ আর নেই। রবীন্দ্রনাথ নিজে দ্বারকানাথের গুরু রামমোহনের স্মৃতি তর্পণ করলেও তিনি জ্ঞাণতঃ দ্বারকানাথের উপাসনা করেন নি। এমনই ছিল তাঁর ঠাকুর্দার প্রতি রবীন্দ্রবিতৃষ্ণা। তিনি জানতেন দ্বারকানাথ ছটি ক্লিপারের একটি বড় অংশিদারি অর্জন করেছিলেন। এরমধ্যে প্রধাণতমটি ছিল ৩৬৩টনের ওটারউইচ। খিদিরপুর ডকে পরিকল্পনা করে বানানো। এটির অর্ধেক অংশিদারি ছিল তাঁর আর অর্ধেক ছিল দুই ইংরেজ উইলিয়ম স্টর্ম আর এন্ড্রু হেন্ডারসনের। এটি কলকাতায় তৈরি তৃতীয় ক্লিপার। এর আগে যেদুটি তৈরি হয়েছে হাওড়া ডকে সেদুটি হল রুস্তমজী কাওয়াসজীর জন্য ১৮২৯এর রেড রোভার আর ১৮৩১এর সিল্ফ। সেই শতকের ত্রিশের দশকে চিনে অবৈধ আফিম চালানের পরিমান প্রায় তিনগুন হয়ে যায় এই ক্লিপারের দ্রুত পরিবহনক্ষমতা এবং উত্তর-পূর্ব বাতাস বয়ে শীতেই চিনে পৌঁছত যখন সেখানে আফিমের দাম থাকত চড়া এবং এই ক্লিপারের অনেকবেশি বোঝা নেওয়ার ক্ষমতার জন্যও আফিম ব্যবসায়ীদের কাছে ক্লিপার প্রধাণ পরিবহন হয়ে ওঠে। দ্বাকানাথের আরও দুটি আফিম ক্লিপার ছিল ৩৭১ টনের ১৮৩৭ সালে খিদিরপুরে তৈরি এরিয়েল এবং ১১২ টনের মাভিজ। এরিয়েল চিনে আফিম ব্যবসা করতে গিয়ে কমিশনার লিনএর হাতে ধরা পড়ে।
ইংরেজদের আফিম ব্যবসা
১৭৫৭র পর ইংরেজদের লোভী দৃষ্টি পড়ল আফিম ব্যবসায়। পলাশির পর ইংরেজ ব্যবসায়ীরা বাংলার সমাজের নানান বিধিনিষেধ ফুতকারে উড়িয়ে দিয়ে সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলার নানান ব্যবসার সঙ্গে আফিম ব্যবসাও। ইংরেজদের হাতে পড়ে চিরাচরিত আফিম চাষী শোষণ-শাসনের শিকার হয়ে উঠল। ব্যবসা এতই লাভজনক ছিল যে বাংলা ধংসের অন্যতম নায়ক ওয়ারেন হেস্টিংস তার বন্ধুদেরই বাংলা-বিহারের আফিম একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার দিয়ে সম্মানিত করতেন। সরকারের নানান অঙ্গের সাহায্যে শোষণের বেড়াজালে ব্যবসায়ীদের লাভের অঙ্ক আকাশ ছুঁত। দেশিয় দালাল মার্ফত চাষীদের কাছথেকে আফিম প্রায় বিনামূল্যে সংগ্রহ করে তা সরাকারের কাছে বিক্রি করত।
ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দেশিয় দালালেরা চাষীদের কাছথেকে বলপ্রয়োগে নামমাত্র মূল্যে আফিম কিনে সেই আফিম উচ্চমূল্যে সরকারের কাছে বিক্রি করছে দেখে চাষীরা আফিম চাষ করতে অস্বীকার করলে তাদের ওপর নিপীড়ন নামিয়ে আনা হত। দালাল, গুন্ডা আর পুলিশদের সহায়তায় ইংরেদরা চাষীদের অন্যচাষের বদলে জোর করে আফিম চাষ করতে বাধ্য করত। আফিম চাষের জন্য দালালেরা চাষীর খেতের ফসল পুড়িয়ে দিয়েছিল, এমনও উদাহরণ বিরল নয়। আর অনিচ্ছুক চাষীদের আটক আর প্রহার ছিল সাধারণ ঘটনা। জোর করে চাষ করিয়েও রেহাই নেই আফিম ওজন করার সময় ওজন চুরি করেও চাষীকে কম দেওয়া হত।
চাষীরা একসময় একযোগে প্রায় স্বাধীণতা সংগ্রাম করায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুধেলা গরু আফিম ব্যবসা মার খেতে শুরু করে। এই আফিমের একটি বড় অংশ বিক্রি হত বেআইনিভাবে চিন দেশে। সপ্তদশ শতকের মাঝখান থেকে বানিয়া ইংরেজরা বুঝতেপারে, বাংলাকে লুঠ করে ছিবড়ে করে দেওয়ার পর চিনে আফিম ব্যবসা তাদের বড় লাভের রোজগার হতে পারে। ক্রমশঃ তারা চিনে আফিম ব্যবসা বাড়াবার দিকে নজর দিল। ইতোমধ্যে চিনের অবৈধ কারবারিরা দেশের মানুষকে আফিমের মৌতাতে মাতিয়ে রেখে অযুত মুনাফা লাভ করার দিকে শনৈঃ শনৈঃ এগোতে থাকে। চিন সমাজের প্রায় প্রত্যেকটিস্তরে আফিমের নেশা দাবানলেরমত বাড়তে বাড়তে অষ্টাদশ শতকের প্রথমপাদে, এই নেশা দেশের মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। প্রত্যক ছজনের মধ্য একজন ছিলেন আফিম সেবী। কুইং সাম্রাজ্য আফিমের বিক্রি এবং দেশের মানুষের আফিম সেবন বন্ধ করে দেওয়ার ফরমান জারি করে।
ইতোমধ্যে বাংলার তন্তুজাত দ্রব্য ইংলন্ডে রপ্তানিও ক্রমশঃ কমতে শুরু করেছে। ব্রিটেন শুধু বস্ত্রজাত বস্তু নয়, রামমোহনের সনির্বন্ধ অনুরোধে বাংলায় নুন পর্যন্ত রপ্তানি করতে শুরু করে দিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। সব থেকে বড় কথা নানান দ্রব্য কিনতে ইংলন্ডকে ইওরোপ থেকে বাংলায় সোনা-রূপা আনতে হত। পলাশির চক্রান্তে, বাংলার শাসন ক্ষমতায় আসার পর, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে এত পরিমান লুঠ করে উদ্বৃত্ত তৈরি করে যে, পলাশির বছর থেকে আর তাকে বাংলার দ্রব্য কিনতে আর ইওরোপ থেকে দামি ধাতু আর আনতে হয় নি।
এখন লুঠ কর্ম শেষে, ভারতের শিল্প আর শিল্প পরিকাঠামো ধংস করে কোম্পানি নতুন লুঠের বাজারের দিকে নজর ফেরায়। শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে, আরও আরও কাঁচামালের জন্য, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধাণ রোজগেরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিনের দিকে নজর ফেরাতে থাকে। ততদিনে ইংলন্ডে চা, পোর্সেলিন আর চিনের রেশমএর বাজার জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। ইংলন্ডকে চিন থেকে এই বস্তুগুলি কিনতে প্রচুর সেনাদানা নিয়ে যেতে হচ্ছে। চিনের সঙ্গে ইংলন্ডের বাণিজ্য ঘাটতি চূড়ান্ত চূড়ায় পৌঁছে যায়। এরপর শুরু হয় চিন লুঠের নতুন পরিকল্পনা। যে সোনাদানা নিয়ে ইংরেজ কোম্পানি চিনের চা, পোর্সেলিন আর রেশম কিনত সেই সোনাদানা যাতে আর আগামী দিনে চিনে আনতে না হয়, তার সুচারু পরিকল্পনা তৈরি হয়ে যায় ব্রিটিশ সরকারের মদতে কোম্পানির সম্মেলন ঘরে, তার সাথী হলেন বাঙালি আর পার্সি উদ্যোগীরা।
পণ্য-পরিবহন জাহাজ, মশলা, নীল, রেশম, লৌহপিন্ড, নুন, সোরা অথবা পান-সুপুরিরমত বাংলার আফিমও ছিল বিশ্বের সেরাতম পণ্যদ্রব্য। বিশ্ববাজারা তার দাম অত্যন্ত চড়া। সমগ্র উনবিংশ শতক ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চিনে দামি অবৈধ আফিম সরবরাহ করত। এই অবৈধ বাণিজ্যই ছিল তত্কালীন ভারত সরকারের সবথেকে দামি বৈদেশিক বাণিজ্য। ১৭৯৭তে ভারতের জনগণমনঅধিনায়ক হয়ে এলেন কর্নওয়ালিস। হেস্টিংসএর সময় থেকে চলে আসা বেসরকারি উদ্যোগে আফিম চাষ আর আফিম তৈরির নীতি থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে ঠিক হল, ভারতে আগামীদিন থেকে আফিম তৈরি করবে ভারত সরকার অর্থাত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্বয়ং। ভারতের বাংলা, বিহার এবং পূর্বি-উত্তরপ্রদেশের নির্দিষ্ট কয়েকজন চাষীর সঙ্গে সরকারি বন্দোবস্ত লেখাপড়া করে বছরে নির্দিষ্ট পরিমান আফিম তৈরি হবে। গাঙ্গেয় সমভূমিতে চুক্তিবদ্ধ আফিম চাষীর কাছথেকে নির্দিষ্ট দামে চাষ করা আফিম কেনার চুক্তি হল। চিনের সঙ্গে অবৈধ এই ব্যবসায়ে ঘোরতর লিপ্ত কেন্পানি ফতেয়া দিল সরকারি ফরমানের বাইরে যে চাষী আফিম চাষ করবে তার চাষ অবৈধ ধরে নেওয়া হবে এবং সেই চাষীকে সরকার সাজা দেবে।
চাষের সময় দাদন দেওয়া চাষীর কাছ থেকে শুকনো আফিম রস কোম্পানি কিনে নিয়ে, সরকারের দেখরেখে চলা কারখানাতে পাঠিয়ে এক কেজির একএকটি গোলা তৈরি করা হত। চল্লিশটা গোলা নিয়ে তৈরি হত একটি চেস্ট। প্রত্যেকটি চেস্ট এবার চলে যেত কলকাতায় আফিম বাজারে নিলামের জন্য। পূর্ব ভারতে আফিম তৈরির পরিকাঠামো ছাড়াও সরাসরি ব্রিটিশ শাসিত ভারতের বাইরে ব্রিটিশ অভয়হস্তের নিচে থাকা রাজন্য শাসিত উত্তর-পশ্চিম রাজ্যগুলো থেকে আফিম তৈরির পরিকাঠামো তৈরি হল, যাকে তত্কালীন কোম্পানি কাগজপত্রে মালওয়া অথবা মালব আফিম বলা হচ্ছে। বাজারের আফিমের সরবরাহ আর চাহিদার তুল্যমূল্য অঙ্ক কষে ব্যক্তিগত উদ্যমীরা চাষীদের দাদন দিয়ে চাষ করাতেন। এদের দুটিস্থানে বড় ধরণের কর দিতে হত, প্রথমটি যে রাজ্যে তৈরি হচ্ছে, আর দ্বিতীয়টি রাজ্যটি ছেড়ে বেরোবার পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে প্রবেশ পথে আরও একবার। এই পাশ ফি ছিল ব্যবসায়ীটির বম্বের বন্দর থেকে তার তৈরি আফিমটি চিনের উদ্দেশ্যে রওনা করানোর ছাড়পত্র। সেই আফিম চিনে বিক্রি করে চিন বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত তৈরি করতে হবে। এই পরিকল্পনা অনুসারে ভারতের আফিম চাষীদের সঙ্গে সমঝোতা করে যথেষ্ট বেশি আফিম তৈরির পরিকল্পনা হল। ভারতীয় দালালদেরমত চিনেও এই আফিম ব্যবসার ইংরেজদের অন্যতম সহযোগী ছিল হং ব্যবসায়ীরা।
ভারতে আফিম স্বাধীণতা সংগ্রামের পরে সরাসরি সরকারি পরিকাঠামো সম্বল করে, জনগণের দেয় খাজনার অর্থে যে কোম্পানি সরকারের আফিম উত্পাদন পরিকাঠামো গড়ে উঠল বাংলা-বিহার-উত্তরপ্রদেশ জুড়ে, সেই কাঠামোকে ভিত্তি করেই প্রাথমিকভাবে কিন্তু গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চিনে অবৈধ আফিম সরবরাহ করার অতি লাভের পারানি। বিহারের পাটনা অঞ্চলে সরকারি নজরদারিতে ব্রিটিশদের চিনের ব্যবসা বছরের পর বছর বাড়তে থাকে। চিন থেকে ইংলন্ডে চা রপ্তানি ১৭০০তে ৯২,০০০ পাউন্ড থেকে বেড়ে ১৭৫১তে ২৭ লক্ষ পাউন্ডে দাঁড়াল। ১৮০০তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিন থেকে ২কেটি ৩০ লক্ষ পাউন্ড চা কিনতে খরচ করতে হত ৩৬ লক্ষ পাউন্ড রূপো।
বাংলার রূপো আনা বন্ধ হয়েছে এবং চিনেও যেনতেনপ্রকারেণ চা ব্যবসা বন্ধ না করে রূপো নিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে চাইল ব্রিটিশ সরকারের বকলমে কোম্পানি। ১৭৯৩তে ব্রিটেন চিনে জর্জ ম্যাকার্টনিকে দূত হিসেবে পাঠাল। ম্যাকার্টনি পশ্চিমি প্রযুক্তির তৈরি সর্বশ্রষ্ঠ জিনিষপত্র দিয়ে সম্রাটকে প্রভাবিত করতে চাইলেন এবং ইংলন্ড-চিনের ব্যবসাকে নতুন ভাবে দেখতে আর্জি জানালেন। তখনও শিল্প, শিল্পিয় প্রযুক্তি আর শিল্প সৌকর্যে শিশু রাষ্ট্র ব্রিটেন তার সেই উপহারে সম্রাটকে প্রভাবিত করতে পারল না এবং ম্যাকার্টনির সমস্ত দাবি খারিজ হয়ে গেল। এর পরেও আরও একবার ব্রিটেন চেষ্টা করেছিল আফিম ব্যবসা নিয়ে সমঝোতা করার কিন্তু চিনের সম্রাট সেই দৌত্য খারিজ করে দেন।
ইতোমধ্যে ভারতীয় কয়েক হাজার বছরের ভারতের পরীক্ষিত সমুদ্রপোত প্রযুক্তি এবং ভারতীয় হাল্কা কাঠ দিয়ে লন্ডনে তৈরি হল ক্লিপার জাহাজ। সহজে বাতাস কেটে বেরোবার জন্য সরু ডেক, বড় হাল এবং বহু মাস্তুল ওয়ালা ক্লিপারগুলি সহজে তাড়াতাড়ি এবং অনেকবেশি বহন করে নিয়ে যেতে পারত বহু পণ্য দ্রব্য, এবং আফিমও। নতুন করে জমে উঠল ইংরেজদের চিনে আফিম পাঠানোর অবৈধ ব্যবসা। এবার একটি ওপিয়াম ক্লিপার জাহাজ, বছরে দুটি বাণিজ্য(যদি একে বাণিজ্য আখ্যা দেওয়া যায়) যাত্রা করতে পারত, ফলে আরও বেশি লাভ, আরও বেশি অবৈধ বাণিজ্য।
দিনে দিনে শশীকলাপ্রায় বেড়েছে চিনে ইংরেজ শাসনের অবৈধ আফিম সাম্রাজ্য, চিন সম্রাটের নাকের ডগা গিয়েই। কর্নওয়ালিশ ভারতে আসার আগে আগেই ১৭৯০ সালে চিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবৈধ আফিম রপ্তানি ছিল চার হাজার চেস্ট। ১৮২০তে কর্নওয়ালিশের সরকারি নীতির ফলে এই পরিমান বেড়ে দাঁড়াল প্রায় দুগুণের কাছাকাছি। ত্রিশের দশকে সেই রপ্তানি আরও বাড়তে শুরু করল এবং ১৮৩৪এ কোম্পানির ভারত বাণিজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরও বেশি করে আফিম অবৈধ আফিম ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে শুরু করল। তবুও চিনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যক্তিগত উদ্যোগে আফিম ব্যবসা শেষ হল না। চিন সম্রাটও এই বাণিজ্য রুখতে কড়া পদক্ষেপ নিতে শুরু করায় প্রথম আফিম যুদ্ধ বাধাল ইংরেজ সাম্রাজ্যশক্তি। প্রথম আফিম যুদ্ধের আগে প্রায় ইংরেজ রাজশক্তি বছরে ভারত থেকে প্রায় ৪০,০০০ চেস্ট রপ্তানি করত। ব্রিটিশদের হিসেবে সেসময় চিনে কম করে এক কোটি আফিম সেবী রয়েছে যার মধ্যে ২০ লক্ষ আফিম মৌতাতে পুরোপুরি আসক্ত।
এ প্রসঙ্গে আর একটি উত্তেজকর তথ্য দেওয়া যাক, ১৮০০ থেকে ১৮৩৯ সালের মধ্যে আমেরিকার ব্যবসায়ীরা চিনে সরবরাহ করেছিল দশ হাজার চেস্ট আফিম। এবার ভারত থেকে অবৈধ আফিম রপ্তানির লেখাজোখা ১৭৭৩এ ১০০০ চেস্ট, ১৭৯০তে ৪০০০ চেস্ট, ১৮২০র দশকের আগে ১০,০০০ চেস্ট, ১৮২৮এ ১৮,০০০ চেস্ট, ১৮৩৯এ ৪০,০০০ চেস্ট, ১৮৬৫তে ৭৬,০০০ চেস্ট, ১৮৮৪তে ৮১,০০০ চেস্ট। ১৮৮১তে এই রপ্তানি সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছয়(সূত্র চাইনিজ রাউন্ডএবাউট, জনাথন স্পেন্স)। তবে প্রথম আফিম যুদ্ধ করেও ব্রিটিশরা চিনে আফিম ব্যবসাকে চিনে বৈধতা দিতে পারেনি। তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৮৫৬-১৮৬০এর ব্রিটেন-ফ্রান্সএর যৌথ দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধে বেজিং দখল করা পর্যন্ত। ১৮৮০ পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের সবথেকে দামি রপ্তানি ছিল আফিম। সে সময় চিনে, প্রায় দেড় কোটি আফিমখোরদের চাহিদা মেটাতে রপ্তানির পরিমান ছিল চুয়ান্ন হাজার মেট্রিক টন। প্রথমে অবৈধ পরে গায়ের জোরে যুদ্ধ করে বৈধতা দেওয়া আফিম ব্যবসায় প্রত্যক বছর নয় কোটি তিরানব্বই লক্ষ রূপো টাকা আসত ভারত সরকারের সিন্দুকে, বৈদেশিক মোট রপ্তানির ১৬শতাংশ।
No comments:
Post a Comment