(এর আগে বাংলার জমিদারির আদায় নিয়ে আলোচনা করেছি আমার পলাশীর পূর্বে বাংলার ৫০ বছর বইতে। বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের ভাবনা ভাবছি। জমি আর রাজস্ব ব্যবস্থা প্রথন খণ্ডে আলোচিত হয় নি। তাই এখানে ছুঁয়ে যাচ্ছি জাফরখানি ব্যবস্থার পটভূমিকা। কয়েক কিস্তিতে আলোচনা করব জাফরখানি ব্যবস্থা কেন আলাদা ছিল মুঘল শাসন থেকে। এটি মূলত নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল আর রমেশ দত্তর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া আরও বেশ কিছু বইএর অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। এখানে বিশদে লেখার সুযোগ নেই - তাই পটভূমি আলোচনা। বিশদে থাকবে বইতে - বিশ্বেন্দু}
এর জন্য অবশ্য সরকার থেকে তাদের বেতন দেওয়া হত। অনেক সময় এই বেতন দেওয়া হত নগদ টাকায়। এই সব মনসবদারকে বলা হত ‘মনসব-ই-নগদি’। কিন্তু অধিকাংশ সময় রাষ্ট্র নগদ বেতনের পরিবর্তে জমি দেওয়া হত এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী জমি থেকে প্রাপ্ত আয় ছিল তাদের বেতনের সমতুল। এই যে তাকে নির্দিষ্ট একটি ভূখন্ড ব্যয় নির্বাহের জন্যে দেওয়া হল একে জায়গির বলা হত। জায়গির পেতে হলে নিয়োগের মত আরেকটি দপ্তরে আরেকটি দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হত। যারা জমি থেকে রোজগার করত, তারা ছিল একই সঙ্গে মনসবদার এবং জায়গিরদার। তবে জমির উপর মনসবদারদের অবশ্য কোন চিরস্থায়ী অধিকার বা মালিকানা থাকত না এবং চাকরির শর্ত অনুযায়ী তারা এক জায়গির থেকে অন্য জায়গিরে বদলি হত। মনসবদারদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, অপসারণ এর সবকিছুই নির্ভর করত সম্রাটের মর্জির উপর। মনসবদারদের পুত্র সবসময় মনসবদার হতে পারত না, যদিও যোগ্যতা থাকলে পিতার স্থালাভিষিক্ত হতে বাধা থাকত না। এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা সবটাই নির্ভর করত সম্রাটের দক্ষতা ও যোগ্যতা আর নিয়ন্ত্রণের ওপর। মনসবদারদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে বা তারা বিদ্রোহ করলে, সৈনিকরা সম্রাটের পক্ষে যুদ্ধ না করে মনসবদারের পক্ষ নিত ; কারণ তাদের কাছে তিনিই ছিলেন কাছের মানুষ । সম্রাটকে তারা চিনত না। সেই জন্যে বাদশাহী নির্দিষ্ট মনসবদার পদের আর সওয়ারের মনসবদার না হলে ফৌজদার পদ দেওয়া হত না।
সমস্যা দাঁড়াল আওরঙ্গজেবের সময়। দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ করতে তার বিশাল এনা বাহিনীর দরকার ছিল। ফলে জায়গিরদারদের সংখ্যা গুণোত্তর হারে বাড়তে থাকে। এই অবস্থা বাংলায় দেখলেন মুর্শিদকুলি। এর আগেও বলেছি, বাদশাহী শাসন ব্যবস্থা তাঁর সময়ে প্রভূতভাবে পরিবর্তিত হল। মুর্শিদকুলিকে আওরঙ্গজেব বাংলা শাসনের পুরপুরি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। মুর্শিদকুলি সেই স্বাধীনতাকে অবলম্বন করে বাংলা শাসন ব্যবস্থাকে নিজের মত করে ঢেলে সাজালেন। দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেব দেখলেন দীর্ঘকালের নানান ঘাতপ্রতিঘাতে গড়ে ওঠা মুঘল শাসন ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে ফেলছেন তার প্রিয় মুর্শিদকুলি। তিনি নিরূপায়। কিন্তু বাংলার প্রশাসন সাজাবার কাজটা মুর্শিদকুলি করতে পারলেন কারণ সে সময় উপমহাদেশে নতুন এক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধে ব্যস্ত এবং আর্থিক টানাটানিতে জেরবার আওরঙ্গজেব তার প্রিয়পাত্রের কাজে বাধা দিতে পারেন নি। আর ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যর পর দিল্লির সিংহাসন দখলের যে লড়াই চলল তাতে মুর্শিদকুলির ব্যতিক্রমী কাজ করার স্বাধীনতা আরও বৃদ্ধি পেল।
বাংলা-বিহার-ওডিসার শাসক হিসেবে মুর্শিদকুলি ফিবতসর বাদশাহীর দাবি মত রাজস্ব পাঠিয়ে একটা নতুন রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি করলেন বাংলায়। তার আগে পর্যন্ত সাম্রাজ্যজুড়ে মনসবদার নিয়োগ, অপয়ারণ, উন্নতি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হত দিল্লি থেকে। মুর্শিদকুলি আসার কিছু বছর আগে মামা শায়েস্তা খান বদলি হওয়ার পর বহু নবাব এসেছেন আবার বদলিও হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বাংলা সুবায় আওরঙ্গজেব মুর্শিদিকুলিকে খোলা হাতে শাসন চালানো অধিকার অঙ্গীকার করায় মুর্শিদকুলি দেখলেন পাদশার নাতি আজিমুশ্বানের দুর্নীতিতে দেওয়ান চোখ বন্ধ করে আছেন। তিনি নিজের মত করে প্রশাসন চালিয়ে বেশ কিছু রাজস্ব বাড়িয়ে আওরঙ্গজেবকে পাঠিয়ে পাদশাহকে খুশি করলেন। শোভা সিংহ, হিম্মত সিংহ এবং চন্দ্রকোণার রাজার বিদ্রোহ দমন করে তিনি পাদশাহকে আরও খুশি করলেন। ১৭০৩ সালে তিনি রুখে দাঁড়ানোয় আজিমুশ্বান পাটনা পালালেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তার অবস্থান একটু নড়বড়ে হয়ে যায়। তাকে বাংলা থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি নগদি সেনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও নতুন দেওয়ান জায়াউল্লা খাঁ নগদী সৈন্যের হাতে খুন হলেন। ১৭১০ সালের শীতে তাকে আবার বাংলায় ফেরত আনা হল তিনহাজারি মনসবদার হিসেবে।
১৭১৩য় ফারুখশিয়র নতুন মুঘল পাদসা হলে তিনি উপদেওয়ান হলেন। সিংহাসন দখলের লড়াইতে তিনি ফারুখশিয়রের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তিনি ফিবছর প্রচুর অঙ্কের রাজস্ব পাঠাতেন বলে তাকে কোনও সম্রাটই ঘাঁটতে সাহস পায় নি। ১৭১৭য় উপদেওয়ান সুবাদার হলেন।
তিনি আজমুশ্বান তার ভয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তিনি দেওয়ানি আর ফৌজদারি দুই বিভাগ সামলাতে লাগলেন – যা মুঘল আমলে অচিন্ত্যনীয় ছিল। ফলে নিজামত আর দেওয়ানির পার্থক্য মুছে গেল। বাংলার নবাবেরা এক দিকে নিজামত অন্য দিকে নাজিম নিয়ন্ত্রণ করায় মোঘল অভিজাতদের এই সুবায় কাজ পাওয়ার সুযোগ কমে এল। নবাবেরা সাত হাজারি মনসবদার হয়ে প্রধান ওমরাহের অন্তর্ভূক্ত হলেন, কিন্তু সরকারি আমলা অভিজাতদের নিয়োগ আর পদোন্নতি দিল্লি থেকে সরাসরি প্রথমে ঢাকা পরে মুর্শিদাবাদে চলে আসায় বাংলার মনসবদারেরা দিল্লির ক্ষমতার প্রসাদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুর্বল হতে শুরু করল। মুর্শিদকুলি তার মত করে মনসবদার, ব্যাঙ্কার এবং জমিদারদের নিয়ে নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র হয়ে উঠলেন এবং বাংলাকে নতুনভাবে চালাবার উদ্যম নিলেন।
১৭১৩য় ফারুখশিয়র নতুন মুঘল পাদসা হলে তিনি উপদেওয়ান হলেন। সিংহাসন দখলের লড়াইতে তিনি ফারুখশিয়রের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তিনি ফিবছর প্রচুর অঙ্কের রাজস্ব পাঠাতেন বলে তাকে কোনও সম্রাটই ঘাঁটতে সাহস পায় নি। ১৭১৭য় উপদেওয়ান সুবাদার হলেন।
তিনি আজমুশ্বান তার ভয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তিনি দেওয়ানি আর ফৌজদারি দুই বিভাগ সামলাতে লাগলেন – যা মুঘল আমলে অচিন্ত্যনীয় ছিল। ফলে নিজামত আর দেওয়ানির পার্থক্য মুছে গেল। বাংলার নবাবেরা এক দিকে নিজামত অন্য দিকে নাজিম নিয়ন্ত্রণ করায় মোঘল অভিজাতদের এই সুবায় কাজ পাওয়ার সুযোগ কমে এল। নবাবেরা সাত হাজারি মনসবদার হয়ে প্রধান ওমরাহের অন্তর্ভূক্ত হলেন, কিন্তু সরকারি আমলা অভিজাতদের নিয়োগ আর পদোন্নতি দিল্লি থেকে সরাসরি প্রথমে ঢাকা পরে মুর্শিদাবাদে চলে আসায় বাংলার মনসবদারেরা দিল্লির ক্ষমতার প্রসাদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুর্বল হতে শুরু করল। মুর্শিদকুলি তার মত করে মনসবদার, ব্যাঙ্কার এবং জমিদারদের নিয়ে নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র হয়ে উঠলেন এবং বাংলাকে নতুনভাবে চালাবার উদ্যম নিলেন।