Tuesday, March 26, 2019

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩ - পলাশীপূর্ব রাজস্ব ব্যবস্থা - জাফরখানি ব্যবস্থার পটভূমিকা

(এর আগে বাংলার জমিদারির আদায় নিয়ে আলোচনা করেছি আমার পলাশীর পূর্বে বাংলার ৫০ বছর বইতে। বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের ভাবনা ভাবছি। জমি আর রাজস্ব ব্যবস্থা প্রথন খণ্ডে আলোচিত হয় নি। তাই এখানে ছুঁয়ে যাচ্ছি জাফরখানি ব্যবস্থার পটভূমিকা। কয়েক কিস্তিতে আলোচনা করব জাফরখানি ব্যবস্থা কেন আলাদা ছিল মুঘল শাসন থেকে। এটি মূলত নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল আর রমেশ দত্তর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া আরও বেশ কিছু বইএর অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। এখানে বিশদে লেখার সুযোগ নেই - তাই পটভূমি আলোচনা। বিশদে থাকবে বইতে - বিশ্বেন্দু}
এর জন্য অবশ্য সরকার থেকে তাদের বেতন দেওয়া হত। অনেক সময় এই বেতন দেওয়া হত নগদ টাকায়। এই সব মনসবদারকে বলা হত ‘মনসব-ই-নগদি’। কিন্তু অধিকাংশ সময় রাষ্ট্র নগদ বেতনের পরিবর্তে জমি দেওয়া হত এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী জমি থেকে প্রাপ্ত আয় ছিল তাদের বেতনের সমতুল। এই যে তাকে নির্দিষ্ট একটি ভূখন্ড ব্যয় নির্বাহের জন্যে দেওয়া হল একে জায়গির বলা হত। জায়গির পেতে হলে নিয়োগের মত আরেকটি দপ্তরে আরেকটি দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হত। যারা জমি থেকে রোজগার করত, তারা ছিল একই সঙ্গে মনসবদার এবং জায়গিরদার। তবে জমির উপর মনসবদারদের অবশ্য কোন চিরস্থায়ী অধিকার বা মালিকানা থাকত না এবং চাকরির শর্ত অনুযায়ী তারা এক জায়গির থেকে অন্য জায়গিরে বদলি হত। মনসবদারদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, অপসারণ এর সবকিছুই নির্ভর করত সম্রাটের মর্জির উপর। মনসবদারদের পুত্র সবসময় মনসবদার হতে পারত না, যদিও যোগ্যতা থাকলে পিতার স্থালাভিষিক্ত হতে বাধা থাকত না। এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা সবটাই নির্ভর করত সম্রাটের দক্ষতা ও যোগ্যতা আর নিয়ন্ত্রণের ওপর। মনসবদারদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে বা তারা বিদ্রোহ করলে, সৈনিকরা সম্রাটের পক্ষে যুদ্ধ না করে মনসবদারের পক্ষ নিত ; কারণ তাদের কাছে তিনিই ছিলেন কাছের মানুষ । সম্রাটকে তারা চিনত না। সেই জন্যে বাদশাহী নির্দিষ্ট মনসবদার পদের আর সওয়ারের মনসবদার না হলে ফৌজদার পদ দেওয়া হত না।
সমস্যা দাঁড়াল আওরঙ্গজেবের সময়। দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ করতে তার বিশাল এনা বাহিনীর দরকার ছিল। ফলে জায়গিরদারদের সংখ্যা গুণোত্তর হারে বাড়তে থাকে। এই অবস্থা বাংলায় দেখলেন মুর্শিদকুলি। এর আগেও বলেছি, বাদশাহী শাসন ব্যবস্থা তাঁর সময়ে প্রভূতভাবে পরিবর্তিত হল। মুর্শিদকুলিকে আওরঙ্গজেব বাংলা শাসনের পুরপুরি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। মুর্শিদকুলি সেই স্বাধীনতাকে অবলম্বন করে বাংলা শাসন ব্যবস্থাকে নিজের মত করে ঢেলে সাজালেন। দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেব দেখলেন দীর্ঘকালের নানান ঘাতপ্রতিঘাতে গড়ে ওঠা মুঘল শাসন ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে ফেলছেন তার প্রিয় মুর্শিদকুলি। তিনি নিরূপায়। কিন্তু বাংলার প্রশাসন সাজাবার কাজটা মুর্শিদকুলি করতে পারলেন কারণ সে সময় উপমহাদেশে নতুন এক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধে ব্যস্ত এবং আর্থিক টানাটানিতে জেরবার আওরঙ্গজেব তার প্রিয়পাত্রের কাজে বাধা দিতে পারেন নি। আর ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যর পর দিল্লির সিংহাসন দখলের যে লড়াই চলল তাতে মুর্শিদকুলির ব্যতিক্রমী কাজ করার স্বাধীনতা আরও বৃদ্ধি পেল।
বাংলা-বিহার-ওডিসার শাসক হিসেবে মুর্শিদকুলি ফিবতসর বাদশাহীর দাবি মত রাজস্ব পাঠিয়ে একটা নতুন রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি করলেন বাংলায়। তার আগে পর্যন্ত সাম্রাজ্যজুড়ে মনসবদার নিয়োগ, অপয়ারণ, উন্নতি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হত দিল্লি থেকে। মুর্শিদকুলি আসার কিছু বছর আগে মামা শায়েস্তা খান বদলি হওয়ার পর বহু নবাব এসেছেন আবার বদলিও হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বাংলা সুবায় আওরঙ্গজেব মুর্শিদিকুলিকে খোলা হাতে শাসন চালানো অধিকার অঙ্গীকার করায় মুর্শিদকুলি দেখলেন পাদশার নাতি আজিমুশ্বানের দুর্নীতিতে দেওয়ান চোখ বন্ধ করে আছেন। তিনি নিজের মত করে প্রশাসন চালিয়ে বেশ কিছু রাজস্ব বাড়িয়ে আওরঙ্গজেবকে পাঠিয়ে পাদশাহকে খুশি করলেন। শোভা সিংহ, হিম্মত সিংহ এবং চন্দ্রকোণার রাজার বিদ্রোহ দমন করে তিনি পাদশাহকে আরও খুশি করলেন। ১৭০৩ সালে তিনি রুখে দাঁড়ানোয় আজিমুশ্বান পাটনা পালালেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তার অবস্থান একটু নড়বড়ে হয়ে যায়। তাকে বাংলা থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি নগদি সেনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও নতুন দেওয়ান জায়াউল্লা খাঁ নগদী সৈন্যের হাতে খুন হলেন। ১৭১০ সালের শীতে তাকে আবার বাংলায় ফেরত আনা হল তিনহাজারি মনসবদার হিসেবে।
১৭১৩য় ফারুখশিয়র নতুন মুঘল পাদসা হলে তিনি উপদেওয়ান হলেন। সিংহাসন দখলের লড়াইতে তিনি ফারুখশিয়রের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তিনি ফিবছর প্রচুর অঙ্কের রাজস্ব পাঠাতেন বলে তাকে কোনও সম্রাটই ঘাঁটতে সাহস পায় নি। ১৭১৭য় উপদেওয়ান সুবাদার হলেন।
তিনি আজমুশ্বান তার ভয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তিনি দেওয়ানি আর ফৌজদারি দুই বিভাগ সামলাতে লাগলেন – যা মুঘল আমলে অচিন্ত্যনীয় ছিল। ফলে নিজামত আর দেওয়ানির পার্থক্য মুছে গেল। বাংলার নবাবেরা এক দিকে নিজামত অন্য দিকে নাজিম নিয়ন্ত্রণ করায় মোঘল অভিজাতদের এই সুবায় কাজ পাওয়ার সুযোগ কমে এল। নবাবেরা সাত হাজারি মনসবদার হয়ে প্রধান ওমরাহের অন্তর্ভূক্ত হলেন, কিন্তু সরকারি আমলা অভিজাতদের নিয়োগ আর পদোন্নতি দিল্লি থেকে সরাসরি প্রথমে ঢাকা পরে মুর্শিদাবাদে চলে আসায় বাংলার মনসবদারেরা দিল্লির ক্ষমতার প্রসাদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুর্বল হতে শুরু করল। মুর্শিদকুলি তার মত করে মনসবদার, ব্যাঙ্কার এবং জমিদারদের নিয়ে নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র হয়ে উঠলেন এবং বাংলাকে নতুনভাবে চালাবার উদ্যম নিলেন।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২ - পলাশীপূর্ব রাজস্ব ব্যবস্থা - জাফরখানি ব্যবস্থার পটভূমিকা

(এর আগে বাংলার জমিদারির আদায় নিয়ে আলোচনা করেছি আমার পলাশীর পূর্বে বাংলার ৫০ বছর বইতে। বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের ভাবনা ভাবছি। জমি আর রাজস্ব ব্যবস্থা প্রথন খণ্ডে আলোচিত হয় নি। তাই এখানে ছুঁয়ে যাচ্ছি জাফরখানি ব্যবস্থার পটভূমিকা। কয়েক কিস্তিতে আলোচনা করব জাফরখানি ব্যবস্থা কেন আলাদা ছিল মুঘল শাসন থেকে। এটি মূলত নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল আর রমেশ দত্তর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া আরও বেশ কিছু বইএর অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। এখানে বিশদে লেখার সুযোগ নেই - তাই পটভূমি আলোচনা। বিশদে থাকবে বইতে - বিশ্বেন্দু}

এই ছিল বাদশাহী আমলের কাঠামো। আমরা প্রথম খণ্ডেও দেখেছি, ইয়েলকোণ্ডার প্রশাসক, প্রশাসনবেত্তা ফৌজদার মহম্মদ হাজি, যিনি পরে মুর্শিদকুলি খাঁ নামে পরিচিত হবেন, বাংলায় পাঠিয়েছিলেন যতটা পারা যায় সুবা বাংলা থেকে রাজস্ব আদায় করে তাঁকে দাক্ষিণাত্যে পাঠাতে। মুর্শিদকুলির প্রশাসনিক সমস্ত দাবি তিনি মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি নিজের আত্মীয়দের তীব্র তিরষ্কার করেছিলেন মুর্শিদকুলির বিরোধিতা করার জন্যে। এবং তার সারা জীবন তিনি কার্যত স্বাধীনভাবে রাজত্ব চালিয়েও মুঘল সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে প্রতি বছর নিয়ম করেও দিল্লিতে রাজস্ব পাঠিয়ে গিয়েছেন। এমন কি আওরঙ্গজেবের এন্তেকালের পর এ সিংহাসনের লড়াই দেখা দেয়, সে সময়ও তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি।
বাংলায় এসে মুর্শিদকুলি খাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব বৃদ্ধি। সেই উদ্বৃত্ত রাজস্ব তার অন্নদাতা আওরঙ্গজেবের তহবিলে পাঠানো। তিনি বাংলায় প্রশাসন সামলে দেখলেন তহবিলে রাজস্ব বাড়াবার উপায় নেই। দাক্ষিণাত্যে উদ্বৃত্ত পাঠাবার কথা তো দূরস্থান, বাংলায় নবাবি চালানোর মত উদ্বৃত্তও তৈরি হচ্ছে না। মুর্শিদকুলি নিজে কৃচ্ছসাধন করার মত মানুষ। জাঁকজমক আতিশয্যে তাঁর খুব বেশি আকর্ষণ ছিল না – ফলে রাজস্ব বৃদ্ধি তাঁর নিজের ভোগের জন্যে নয় এটা পরিষ্কার। তিনি দেখলেন, বাংলা সুবার অধিকাংশ কৃষিযোগ্য জমি জায়গিরদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এগুলি জায়গিরদারদের রোজগার।
এমতাবস্থায় খুব সরল করে এই সময়ের বাংলার অর্থ সমস্যার রূপ এবং তার কারণটা বুঝে নেওয়া যাক। মুঘল রাজত্ব সামরিক শক্তির জন্য মনসবদের উপর নির্ভরশীল ছিল। মুর্শিদকুলি খাঁ যখন বাংলায় এলেন তখন পরিপূর্ণ মুঘল প্রাসনিক ব্যবাস্থা। মুঘল প্রাসনিক ব্যবস্থার একক সেনাবাহিনী বলছেন যদুনাথ সরকার, দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেসনএ। ‘মনসব’ কথাটির অর্থ হল পদ। কোন নির্দিষ্ট পদ বা মনসবের অধিকারকে বলা হত মনসবদার। মনসবদাররা মূলত সামরিক দায়দায়িত্ব পালন করলেও সামরিক ও বেসামরিক উভয় দায়িত্বই তাদের পালন করতে হত। জে জে এল গোমানস Mughal Warfare: Indian Frontiers and Highroads to Empire 1500–1700 বইএর ৮৪ পাতায় মনসবদারিকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলছেন In practice, every candidate for mansab needed the political and, as we shall see, financial backing of an already influential, high-ranking patron at court. The latter introduced the candidate and proposed a rank to the emperor, sometimes through the Mir Bakhshi, the main recruitment officer. After a personal assessment in public audience by the emperor, who was reportedly able to see ‘through men at the first glance’, the candidate received a fitting mansab to be followed by a lengthy bureaucratic procedure of registration and confirmation. Invested with dignity and nobility, the new mansabdar was now responsible for the enrolment and the equipment of a number of mounted retainers in accordance with his rank, mostly to be paid from jagirs for which he entered into another elaborate selection procedure involving another set of rules controlled by different officials. Thus an important element of the mansabdar’s quality was his function as a kind of military employment agency.
মনসবদার এমন এক পদাধিকারী, যার মুঘল দরবারে কোন না কোন প্রভাবশালী অভিজাতর সঙ্গে যোগাযোগ আছে এবং তাকে অবশ্যই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হতে হবে। সেই দরবারি অভিজাত তাকে অর্থ দপ্তরের মীর বক্সীর মাধ্যমে দরবারে পাদসাহের পরিচিতি করান। এবার সম্রাট তার সর্বসমক্ষে পরীক্ষা নিয়ে স্থির করতেন এই ব্যক্তিটি কত পরিমান মনসবদারির যোগ্য। যদুনাথ সরকার, দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেসনএ বলছেন শুধু সেনাবাহিনী নয়, মুঘল প্রাশাসনের প্রত্যেকটি পদকে মনসবদারি হিসেবে চিহ্নিত করা হত এবং সেনা বাহিনীর বেতনদার মীর বক্সী এদের মাইনে দিতেন। যার দরবারে যোগাযোগের মাত্রা যত বড়, তার মনসবদারি ততবেশি। মনসবদারি কিন্তু কোনভাবেই সেনাবাহিনীর কামান স্তর নির্নায়ক নয়। পাদশাহ কাকে কতটা পছন্দ করেন, মনসবদারি তার নিদর্শনমাত্র। তারপরে একটি দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তার নিযুক্তি ঘটত। মনসবদারদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সেনাবাহিনী গঠন করতে হত এবং ১০ থেকে ১০,০০০ সৈনিকের ভিত্তিতে তাদের পদমর্যাদা ঠিক করা হত। অর্থাৎ একজন মনসবদারের অধীনে যত সৈন্য ও ঘোড়া থাকত, সেই সংখ্যা অনুযায়ী তাকে তত হাজারি মনসবদার বলা হত। সাধারণত দশ হাজার মনসবদারি পদ নিরাপত্তার দিকে নজর রেখে কেবলমাত্র রাজ পরিবারের কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যেমন সন্তান অথবা সম্রাটের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেই প্রদান করা হত। যুদ্ধের প্রয়োজনে মনসবদাররা সম্রাটকে তাদের সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করত। সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ, অস্ত্রশস্ত্র বা ঘোড়ার জোগান– এর সবকিছুই মনসবদারকে করতে হত।

Monday, March 25, 2019

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১ - পলাশীপূর্ব রাজস্ব ব্যবস্থা - জাফরখানি ব্যবস্থার পটভূমিকা

(এর আগে বাংলার জমিদারির আদায় নিয়ে আলোচনা করেছি আমার পলাশীর পূর্বে বাংলার ৫০ বছর বইতে। বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের ভাবনা ভাবছি। জমি আর রাজস্ব ব্যবস্থা প্রথন খণ্ডে আলোচিত হয় নি। তাই এখানে ছুঁয়ে যাচ্ছি জাফরখানি ব্যবস্থার পটভূমিকা। কয়েক কিস্তিতে আলোচনা করব জাফরখানি ব্যবস্থা কেন আলাদা ছিল মুঘল শাসন থেকে। এটি মূলত নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল আর রমেশ দত্তর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া আরও বেশ কিছু বইএর অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। এখানে বিশদে লেখার সুযোগ নেই - তাই পটভূমি আলোচনা। বিশদে থাকবে বইতে - বিশ্বেন্দু}



বাদশা আওরঙ্গজেবের আমলে মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনুযায়ী সুবা বাংলাতে দিল্লি থেকে একজন নাজিম আরেকজন দেওয়ান আলাদা আলাদা করে নিযুক্ত হতেন। দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশনে যদুনাথ সরকার বলছেন বাদশারা চেকস এন্ড ব্যালেন্সের জন্যে পরস্পর প্রতিযোগী দুই উচ্চপদস্থ কর্মচারী পাঠাতেন যাতে দুজনের দপ্তর দুজনের দপ্তরের কাজের ওপর কড়া নজর রাখতে পারে। মুঘল শাসন ঐতিহ্য মেনে নিজামতের দায়িত্ব ছিল মনসবদারদের অধীনে থাকা অশ্বারোহী বাহিনীর তদারকি এবং অন্যান্য শাসন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে যত কছু করণীয় আছে সব করা। দেওয়ানির কাজ ছিল মূলত রাজস্ব সংগ্রহ। শাসনকাজে মূলত অমুসলমান কর্মচারী দিয়ে জমিদারদের থেকে খাজনা আদায় এবং জমি রাজস্ব ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়িক একক যেমন হাট, বাজার, গঞ্জ, বন্দর, চৌকি ইত্যাদি থেকে সায়ের অর্থাৎ অকৃষিজ ব্যবসায়িক শুল্ক আদায় করতেন। নবাব নাজিমের কাজ ছিল রাজস্ব আদায়ে দেওয়ানকে সাহায্য করা। রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে কোথাও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে, এ কাজ সুসম্পন্ন করার জন্যে দেওয়ানির কর্মচারী/আমলাদের সহায়তা করা। এছাড়া বিশাল আয়ের দপ্তর দেওয়ানিতে কারচুপি তছরূপ আটকাতে আর জমিদার রায়তের ভূমিত্বের দলিল রাখার জন্যে একজন স্বাধীন বঙ্গাধিকারী কানুনগো নিযুক্ত হতেন – স্বাধীন বলা হচ্ছে কারণ তারা হিসেব মনোমত না হলে নবাবের মুখের ওপর জবাব দিয়ে দিতেন, কারণ তারা স্বাক্ষর না করলে কেন্দ্রিয় দেওয়ানি এই হিসেব স্বীকার করত না - মুর্শিদকুলি খাঁর সময় এরকম একটি ঘটনা ঘটে – রসুম বাবদ ৩ লক্ষ টাকা না পেলে কাননুগো দর্পনারায়ণ হিসেবে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। তাঁর অধীনে বিভিন্ন পরগণা পরগণায় কানুনগোরা এবং মৌজায় মৌজায় পাটোয়ারিরা দলিল আর হিসেব রাখতেন। কতগুলি মৌজা/গ্রাম নিয়ে পরগণা এবং অনেকগুলি পরগণা নিয়ে সরকার তৈরি হত। প্রত্যেক সরকারে নিজামতের এক ফৌজদার এবং দেওয়ানির এক আমিল শান্তিরক্ষা আর রাজস্ব/সায়ের আদায়ে নিযুক্ত থাকতেন। ফৌজদার হতে নির্দিষ্ট পদ আর সওয়ারের মনসবদার হতে হত। অনেক সময় প্রতিপত্তির জোরে ফৌজদার মাঝখানের জমিদার সরিয়ে আমিলের নেতৃতে বিশাল আমলা বাহিনী দিয়ে খাজনা আদায় করতেন। জমিদারি ছিল মূলত বংশানুক্রমিক। পরগণায় নির্দিষ্ট সংখ্যায় নির্দিষ্ট পরিমান পাইক রেখে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। এই কাজের জন্যে মালজমি আর সায়েরের খাজনার দশভাগ অর্জন করতেন। বিদ্রোহ না করলে বা রাজস্ব দেওয়ার কাজে গাফিলতি না করলে এদের বংশানুক্রমিক অধিকার খারিজ হত না। নিজামত আর দেওয়ানির আমলাদের মত জমিদার বা চৌধুরীরা সরকারি কর্মচারী ছিলেন না। এদের সাহায্যে জমির খাজনার একাংশ যেত কেন্দ্রিয় তহবিলে আরেক অংশ পেতেন মনসবদারেরা, নির্দিষ্ট সঙ্খ্যক সওয়ার আর জাট রাখার জন্যে জায়গীর হিসেবে। নিজামত বা দেওয়ানির প্রধান বহু সময় খালিসা থেকে নগদে বেতন পেতেন না হলে জায়গীরের আয় থেকে। এছাড়া ছিল বেশ কিছু নিষ্কর জমি যা নবাব সরকার বা জমিদারেরা মদদইমাশ, লাখেরাজ, খয়রাত, আয়মা, পীরোত্তর, দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর, মহাত্রাণ, চাকরাণ, পাইকান ইত্যাদি নানান নামে নানান কাজে বিতরণ করতেন।

বখতিয়ার, নালন্দা ধ্বংস আর ছদ্ম-ইসলামবিদ্বেষ

এর আগে বিশদে বখতিয়ারের হাতে নালন্দা ধ্বংস হওয়ায় কেন সে নতুন করে উঠে দাঁড়াল না, সেটা নিয়ে লিখে জামাতি আখ্যা জুটেছিল। তবুও বলব যারা মনে করেন বখতিয়ার খলজি নালন্দার মৃত্যুর জন্যে দায়ি, তারা হয় নবজাগরিত মুক্তবাজার অনুগামী বাম-মধ্য রাজনৈতিক চেতনাধারী ইসলামবিদ্বেষী না হয় না জেনে সঙ্ঘি ইতিহাসের অনুগামী। 
এ বিষয়ে ঘোরতর বাম দেবী-অলকা চট্টোর ৮৪ সিদ্ধ বিষয়ক বই দেখুন কেন কৌবর্ত যুদ্ধ উত্তর সময়ে নালন্দা বিশাল আকার ধারণ করে এলিটিস্ট হয়ে ওঠে এবং সিদ্ধরা কেন বৌদ্ধ নয়। নালন্দা ইত্যাদি শিক্ষা কেন্দ্র এলিটিস্ট ছিল অন্তত একটা মানে, দরজাতেই এন্ট্রান্স পরীক্ষা নিত, ঠিক যেমন করে আজ নানান ধর্মের মিশন নামধারী শিক্ষা কেন্দ্র ভর্তি পরীক্ষা নেই।
বিশাল কলেবরের নালন্দা টেকেনা রাজ-শ্রেষ্ঠী সমর্থন ছাড়া, কিন্তু আজও বাংলার কেমন করে বৈষ্ণব পাট, আসামে বৈষ্ণব সত্র, মাজার ইত্যাদি জনগণের অর্থে শয়ে শয়ে বছর টিকে থাকে - এই তত্ত্ব না বুঝলে ইসলামবিদ্বেষীভাবেই একমাত্র ধ্বংসকারী বখতিয়ারকে দায়ি করতে হয়।
তুর্কিদের আক্রমন সাম্রাজ্যবাদী ছিল এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই - কিন্তু এটা এই লেখার মুল আলোচ্য নয়।
---
১/
সোজা কথা সোজাভাবে বলা দরকার। এতদিন বৌদ্ধপন্থ নিয়ে প্রচুর রোমান্টিসিজম হয়েছে পশ্চিমিদের কল্যানে এবং স্থায়ী বঙ্গভাগের পর ভারতীয় শাসকদের অত্যাচারী চরিত্র ধুয়ে মুছে সাফ করতে - উচ্ছেদকারী নেহরুকে 'সাম্যবাদী' অশোক হিসেবে উপস্থিত করতে। এর পেছনে বামেদের একটা বড় অবদান ছিল।
বৌদ্ধপন্থ খুবই ভাল। কিন্তু মনে রাখা দরকার ব্যপকভাবে তারা ১৮০০-১৯০০ বছর ধরে রাজ/শ্রেষ্ঠী পোষিত।বৌদ্ধ রাজারা যখন সরে গেলেন, বৌদ্ধ শ্রেষ্ঠীরা যখন বলহীন, সে সময় বৌদ্ধপন্থ টিকে গ্যাল ঠিকই কিন্তু আগের ধমকচমকের অবস্থা আর থাকল না।
নালন্দা ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। বখতিয়ারের আগেও নালন্দার ওপর আক্রমন হয়েছে, সে উঠে দাঁড়িয়েছে কারণ বিপুল পরিমান সাহায্য আসত রাজাদের থেকে। কিন্তু ১২০০-১৩০০ র পরে যখন উপমহাদেশের গতিপথ পাল্টাতে লাগল তারপরে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি পূর্বের মহিমায়।
২/
তানসেন সেন জামাতি নন ওনার লেখায় তুর্কি আক্রমনে নালন্দা ধ্বংস হয়েছে এই আপ্তবাক্যটি বার বার এসেছে। তবুও তিনি চিনা তথ্য তুলে জানাচ্ছেন যে তুর্কি আক্রমনের পরেও নালন্দায় পাঠদান হয়েছে, মগধের শ্রেষ্ঠী এবং মুসলমান রাজত্বের বন্ধু রাজারা দানও করেছেন নালন্দায়।
কিন্তু এই প্রশ্নটার কেন কোন উত্তর নেই তানসেন সেন এবং আপনাদের কাছে, নালন্দা এর আগে বহুবার আক্রান্ত হয়ে বেঁচে উঠেছে। কিন্তু ১৩০০র পরে আর এদের বেঁচে ওঠার কোন নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না কেন? উত্তর আসবে অপ্রতিরোধ্য তুর্কিদের জন্যে। তুর্কিরা যদি এতই শক্তিশালী হবে তাহলে সেনেদের রাজত্ব আরও প্রায় ১০০ বছর বাংলায় বেঁচে রইল কি করে?
আমার প্রামান্য হল বুদ্ধপন্থর সঙ্গে তান্ত্রিক বাংলার আম-জনগণের ধর্মাচরণের কোন সম্বন্ধ ছিল না, ঠিক যেমন একটা রাজ পোষিত ধর্মের অবস্থা হয় এরও একই অবস্থা হয়েছিল রাজারা এই ধর্ম ফান্ডিং বন্ধ করে দেওয়ার পরে ঠিক যেমন করে বৈষ্ণব পাট, আসামে বৈষ্ণব সত্র, মাজার ইত্যাদি জনগণের অর্থে শয়ে শয়ে বছর টিকে থাকে। যদি জনগনের সমর্থন থাকত তাহলে বিহারগুলি বেঁচে উঠত কোন না কোন ভাবেই। আদতে বিহারগুলি এত বড় ছিল তা চালানোর জন্যে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ জরুরি ছিল।
৩/
চিন-ভারত ঐতিহাইক যোগ বিষয়ে গবেষণা করা তানসেন সেন যদিও বুদ্ধিজম ডিপ্লোম্যাসি এন্ড ট্রেডএর ১০৭ পাতায় বলছেন ইসলামের আক্রমনে নালন্দা ধ্বংস হল। একটা স্তবক বাদ দিয়ে নিচে উল্লিখিত স্তবকে তিনিই বলছেন, তিব্বতি ধর্মাঙ্কুর ধর্মস্বামী (১১৮৪-১২৬৪), রাহুলশ্রীভদ্রের অধীনে নালন্দায় পড়াশোনা করছিলেন, ১২৩৫ সালে পূর্ব ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের পতনম্নুখ অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। এতে প্রমান হয় নালন্দার পড়াশোনার ঐতিহ্য এক্কেবারে ধ্বংস হয় নি। চৌদ্দশতের একটি কোরিয় লেখতে পাচ্ছি দীনবতী বা ধ্যানভদ্রকে উল্লেখকরে বলছে ভিক্ষু শূন্যদিশ্যকে ১২৫৪ সালে মোঙ্গল রাজধানী বেইজিং যাবার জন্যে শিক্ষিত এবং তৈরি করা হচ্ছিল নালন্দায়। তানসেন আরও বলছেন, মগধের ধনবান শ্রেষ্ঠীদের এবং মুসলমান রাজার বন্ধু রাজা বুদ্ধসেনএর থেকেও আর্থিক সাহায্য পেত।
The teaching of Buddhist doctrines at Nalanda, in fact, lingered on even after the invasion of Islamic forces in the twelfth century. The Tibetan monk DharmaSvamin (Chag Chosrjedpal, 1194-1264) , for example, points out the declining state of the monastic institution in 1235. However, he was still able to spend several months studying Buddhist philosophy under the monk Rahulasribhadra at the Monastery. Moreover, according to a Korean inscription dedicated to the fourteenth-century Indian monk Tinabotuo (Dinavati; also known as Chanxian [Dhyanabhadra?] and Zhikong [Sunyadisya?] ), the Indian master was trained and ordained at Nalanda before he traveled to Beijing, the Mongol capital, in 1254. Nalanda seems to have continued to receive support in the thirteenth century from wealthy merchants and the Magadhan king Buddhasena, who had forged an alliance with the local Muslim rulers
---
বিদ্বেষ কত গভীরে গেলে এই সাধারণ বিষয়টুকু প্রমানের জন্যে জামাতি অভিযোগ শুনতে হয়।
Kamal Shah এই ছবিটা দিলেন। তাঁকে ধন্যবাদ।

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৪ - নবজাগরিত জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় - সাম্রাজ্য লুঠের অনন্য সঙ্গী

তো জয়কৃষ্ণ যখন জমিদারিতে বিনিয়োগ করতে এলেন তখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা লুঠের সময়। যে কোম্পানি ব্যবসার সময় দালাল রেখে পণ্য কিনত, যে কোনও দিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে খুব বেশি কথাবার্তা বলে নি, ব্রিটিশ রাষ্ট্র যাকে কাজে লাগিয়েছিল বাংলা লুঠের জন্যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও যে আদতে লুঠের একটা হাতিয়ার এটা পরোক্ষে অস্বীকার করতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রয়োগ করতে আমলাদের নানান মহৎ বিতর্ককে ভূমি ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের আগমধ্বনি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
জয়কৃষ্ণ যখন জমিদারিতে আসছেন, সে সময় চিরস্থায়ী  বন্দোবস্তর ৮ নম্বর রেগুলেশন নির্ভর করে জমিদারেরা ঔপনিবেশিক লুঠের রাজত্ব নামিয়ে আনছেন। ১৮৩২এ নভেম্বরে সিঙ্গুরে শ্রীনাথ রায়ের জমিদারির কিছু অংশ কেনার পর থেকেই একে একে অন্যান্য জমিদারি কিনতে থাকেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর যেমন জমিদারদের থেকে অর্থ ধার করে তেজারতি ব্যবসা শুরু করেন, তেমনি জয়কৃষ্ণও যতদূরসম্ভব তার সাহেব যোগের কারণেই শ্রীরামপু্রের গোস্বামী, ভাগ্যকূলের রায়, দুর্গাচরণ লাহাদের থেকে অর্থ ধার করে জমিদারিতে বিনিয়োগ করছেন। তার বাজার দর এতই, তার ব্রিটিশ ঘনিষ্ঠতা এত বেশি যে জমিদারি কিনতেও বিপুল পরিমান অর্থ জমিদারদের থেকে ধার পেতে অসুবিধে হচ্ছে না।
১৮৪০এ জগমোহনের মৃত্যু ঘটে। জয়কৃষ্ণ নিজে যেহেতু ঔপনিবেশিক লুঠেরা সেরেস্তাদারিতে ছিলেন তার কাছে খবর থাকত কম দামে, সূর্যাস্ত ইত্যাদি আইনে কোন কোন জমিদারি বিক্রি হচ্ছে। তিনি সেগুলি কিনে নিতেন। তিনি উদ্যমী হয়ে একে একে হুগলী, হাওড়া, বর্ধমান, অবিভক্ত মেদিনীপুর, বীরভূম, অবিভক্ত ২৪ পরগণা ইত্যাদি জেলার ৪ লক্ষ বিঘা জমিদারির মালিক হয়ে বসেন।
আদতে জয়কৃষ্ণ বিষয়ে আলোচনা করছি কেন, যে জন্যে আমরা লুঠেরাদের সঙ্গী দ্বারকানাথ বা রামমোহনের কীর্তিকলাপ আলোচনা করি, সেই কারণেই – তিনি ব্রিটিশদের রাজস্ব বাড়াতে সাহায্য করেছেন। অন্য জমিদার আগে বর্ণিত নানান নামের মধ্যসত্ত্বভোগীকে জমিদারিটি নিশ্চিন্তে হস্তান্তর করে কলকাতায় নবজাগণে সাহেবদের পরিকল্পনা অনুয়ায়ী মোসাহেবি করে বা প্রগতিশীলতার নাম করে ইওরোপের স্বার্থ দেখত অথবা ইয়ার দোস্ত নিয়ে বেলেল্লাপনা বা বেশ্যা গমন করত। যেহেতু অষ্টম আইনে জমিদারি হস্তান্তর করা মধ্যসত্ত্বভোগীকে কাজে ফাঁকিমারার জন্যে সোপার্দ করা যেত, জমিদারেরা তাদের ওপর আরও বেশি বেশি নির্ভর করা শুরু করলেন। কিন্তু জয়কৃষ্ণ অন্যধাতুর উদ্যমী। তিনি তার প্রভুদের সন্তুষ্টির জন্যে নিজে গ্রামে ঘুরে ঘুরে লুকিয়ে রাখা জমি খুঁজ বেড়াতেন, যাতে শৈশবেই ইওরোপিয় শিল্পাযনের শিশু মৃত্য না ঘটে, সেখানে জমিথেকে রাজস্ব তুলে পাঠানো যায়।  
গবেষক বলছেন তিনি জমিদারি কিনেই দৌড়োতেন সেটি দেখতে। দেখতেন ভাল ভাল উৎকৃষ্ট জমি নাকি গ্রামের মহাজন, পুরোহিত, গুরু, উকিল, সরকারি কর্মচারী ইত্যাদি অনুতপাদক শ্রেণীর হাতে চলে যাচ্ছে। অনেক সময় মণ্ডল প্রভৃতি রায়তেরা খাজনা জমিকে নিষ্কর হিসেবে বিক্রি করে দিত। সম্পদশালী মানুষ মারা গেলে তার জমি মহাজন, গুরু, পুরোহিতদের নিষ্কর হিসেবে দান করা হত। অনেক জমি লুকিয়ে রাখা হত। এগুলি গোমস্তাদের সাহায্য ছাড়া তালুকদারের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। অনেক সময় গোমস্তা ঘুষ খেয়ে বিষয়গুলো চেপে যায়। তিনি সেগুলোকে রাজস্বের আওতায় আনতেন।
আসলে মাথায় রাখতে হবে বড় পুঁজির উদ্যম উপনিবেশই একমাত্র উতপাদক – আর সবাই অনুতপাদক এমন একটা তত্ত্ব ছড়িয়ে আছে। ফলে কোনও জমি যখন সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে কন্ট্রিবিউট করে সেটা আদতে অনুতপাদক ব্যয়ই ধরে নেয় লুঠেরারা। আমরা যারা কারিগর অর্থনীতির মানুষ, তাদের কাছে এটাই উতপাদক ব্যয়, আর সব অনুতপাদক ব্যয়।

সূত্র – ইতিকথা, জানু ২০১৩
ময়ূখ দাস - জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় – মেট্রোপলিটন মনন ফীলান্থ্রপিক চেতনা

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩ - নবজাগরিত জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় - সাম্রাজ্য লুঠের অনন্য সঙ্গী

জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের জমিদারি নিয়ে আলোচনার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তার সময় কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জমিদারিও যে একটা গুরুত্বতম  কাজ, এই কাজ করতে গায়ে গতরে খাটতে হয়, কষ্ট করে গ্রামে থেকে নবাবি আমলের মত প্রজাদের সমস্যা বুঝতে হয়, নানান দায়িত্ব নিতে হয়, এ সব ধারণা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভাবনায় মোটামুটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জমিদারদের বাস হয়েউঠল কলকাতা। পলাশীর পরে রাণী ভবানী ইত্যাদির মত প্রজাবতসল পরম্পরার জমিদারেরা ততদিনে অস্ত গিয়েছেন। যারা আসছেন, তাদের অধিকাংশই জোহুজুর, অন্য পেশার, জমিদারি সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ।
১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রয়োগ করার পর থেকে রাজস্ব আদায় অনিয়মিত ও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, প্রশাসনিক ব্যয় বেড়ে যায়, রাজস্ব আয় কমে আসে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ওয়েলেসলি তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কিত মূল বিধিগুলির কিছু সংশোধন করে জমিদাদের সঙ্গে আপস করার সিদ্ধান্ত নেন। এরই প্রেক্ষাপটে প্রণীত হয় ১৭৯৯ সালের ৭ নং রেগুলেশন যা সাধারণত হফতম বা সপ্তম আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ আইনের ফলে রায়তদের ওপর জমিদারদের লাগামহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়। জমিদার বকেয়া আদায়ের নামে প্রজাদের ফসল, গবাদি ও সম্পত্তি ক্রোক এবং বিক্রয় করে বকেয়া আদায়ের অধিকার লাভ করে। স্বত্বাধিকারী হিসেবে তারা খেলাপি রায়তদের তাদের নিজ নিজ কাছারিতে তলব করার ও বকেয়া পরিশোধ না করা পর্যন্ত তাদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে আটকে রাখার, কোনো খেলাপি রায়ত তার পরিবার ও সহায়-সম্পত্তি নিয়ে অন্য কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে গেলে ওই  রায়তের গ্রামের সকলের ওপর পাইকারি জরিমানা আরোপের ক্ষমতা লাভ করে। পরগনাপ্রথা(প্রশাসনিক সুবিধার জন্য জমির বিভিন্ন ধরনের স্বত্বাধিকারীদের অধিকার ও দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির অভিন্নতার ভিত্তিতে পরগনাগুলিকে দস্তুর বা এলাকায় ভাগ করা হতো। সরকার ও অপরাপর সকল পক্ষ প্রথাগতভাবেই পরগনা দস্তুর বা পরগনা নিয়ম কানুন মেনে চলতে বাধ্য ছিল। পরগনা দস্তুরে পরগনা নিরিখ বলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। পরগনা নিরিখের মাধ্যমে জমির খাজনা, ফিস ও মজুরি, ওজন ও পরিমাপ নিয়ন্ত্রিত হতো। প্রতিটি পরগনার নিজস্ব নিরিখ ছিল যা সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণ জানত ও বুঝত, যদিও বহিরাগতদের কাছে এগুলি অদ্ভুত ও কৌতুকাবহ মনে হতো। এ পরগনা দস্তুর ও পরগনা নিরিখ প্রথাগতভাবে বহুকাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল।} অগ্রাহ্য করে জমিদাররা যথেচ্ছভাবে খাজনা বৃদ্ধির ক্ষমতা লাভ করে। সংক্ষেপে, রায়তগণ এতকাল যাবৎ ঐতিহ্যগতভাবে যেসব প্রথাগত অধিকার ভোগ করে আসছিল হফতম সেসব অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে। রায়ত অসহায় কোর্ফা প্রজায় পরিণত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে বদলে দেয় ১৮১৯ সালের ৮নং রেগুলেশন যা সাধারণভাবে পত্তনি আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ আইনবলে জমিদার ও রায়তের মধ্যবর্তী একটি বহুস্তরবিশিষ্ট মধ্যস্বত্ব শ্রেণি সৃষ্টি করার অধিকার লাভ করে। বাস্তবিকপক্ষে, এ ছিল জমিদারি ক্ষমতার চরম শিখর এবং একই সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল উদ্দেশ্যের ব্যর্থতা। এ আইনের আওতায় জমিদারগণ তাদের খেলাপি পত্তনিদারদের জমি প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় করার অধিকার লাভ করে, ঠিক যেভাবে সূর্যাস্ত আইনের আওতায় খেলাপি জমিদারের জমি নিলাম হয়ে যেতো।
তো মুখোপাধ্যায়েরা যখন বিনিয়োগ করতে ঢুকছেন ততদিনে এই বন্দোবস্ত ত্রিশ বছরের যুবক।  বিনিয়োগকারী ভদ্রবিত্তছায়েরা জমিদারির একফোঁটা জ্ঞান আর চালানোর মানসিকতা না নিয়েই তাদের জমিদারির রাজস্ব আদায়, প্রাজাপীড়ন ইত্যাদি জরুরি কাজ একে একে আইনিভাবেই পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, তেপত্তনিদার, ছেপত্তনিদার(বিনয় ঘোষ এরকম ২২ রকম মধ্যস্বত্ত্বভোগীর নাম নিয়েছেন} মত দালালদের হাতে তুলে দিয়ে বিনাশ্রমে রোজগার করতে থাকেন।



সূত্র – ইতিকথা, জানু ২০১৩
ময়ূখ দাস - জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় – মেট্রোপলিটন মনন ফীলান্থ্রপিক চেতনা

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা২ - নবজাগরিত জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় - সাম্রাজ্য লুঠের অনন্য সঙ্গী

বাপ-ব্যাটায় মীরাট থেকে ফিরে এলেন উত্তরপাড়ায়। ১৮২৫এ চুঁচড়ো ওলান্দাজদের থেকে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে ইংরেজদের হাতে আসে। ২০০ বছরের কেল্লাকে অধিকার করে ইংরেজরা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে। যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী বলছেন মিরাট থেকে ফিরে এসে অভিজ্ঞ দুজনই নতুন সামরিক ছাউনিতে কাজে যোগ দিচ্ছেন। বেন্টিঙ্কের ব্যয় সংকোচনের নীতিতে ১৮৩০এ বন্ধ হয় এই ছাউনি। এই সময় জগমোহন কলকাতার চারটি এজেন্সি হৌসে – মেসার্স ফ্রাইডলি, মেসার্স ফার্গুসন এন্ড কোং, মেসার্স কলভিন ডিনস্লে এন্ড কোং, আর মেসার্স আলেকজান্ডার এন্ড কোংএ তাদের লুণ্ঠিত অর্থ বিনিয়োগ করে। এদের সঙ্গে বিল অব এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনে জুড়ে ছিলেন জগমোহন। এছাড়া বিলাতি পণ্যেরও ব্যবসা করতেন। ১৮২৮ সালে জয়কৃষ্ণর বিবাহ হয় পার্বতী দেবীর সঙ্গে।
কিন্তু ভাগ্য অপ্রসন্ন। এজেন্সি হৌসগুলো বহুমানুষের সঙ্গে উত্তরপাড়ার মুখোপাধ্যায়দের বিনিয়োগ নিয়ে ডুবতে শুরু করে ১৮৩১-৩৪ সালে। একে একে বন্ধ হয়ে যায় এজেন্সি হৌসগুলো। কপর্দকহীন হয়ে বিশাল সংসারের ভরণ করার জন্যে জয়কৃষ্ণ আবার ইংরেজ কর্তাদের স্মরণ নেন। বরাবরের মত তারা তাকে হতাশ করেন নি। তিনি জেলা জজের অধীনে চৌকিদারির ট্যাক্সো আদায়ের কাজ শুরু করেন ১৮৩১এ। ঐ বিভাগে এক বছর কাজ করার পর হুগলির কালেক্টর, বেলি তাকে অতি লাভের সেরেস্তাদারির কাজ দিলেন। সেরেস্তাদারি ইংরেজ আমলে কিভাবে চলত তা আমরা বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুরের সেরেস্তাদারিত্বের কাহিনী থেকে জেনে নিয়েছি তার উত্তরাধিকারী ক্ষিতীন্দ্র ঠাকুর আর জীবনীকার ব্লেয়ার বিক্লিংএর জবানীতে – কিভাবে ৩৫ টাকা মাস মাইনের সেরেস্তাদার তার উর্দ্ধতনকে ৫০০ টাকা ঘুষ দেয় তার গোপন কথা। আরেকটু বিশদ আলোচনায় কিছুক্ষণ বাদে যাব।
১৭৬৫ থেকেই ব্রিটিশদের লক্ষ্য যেনতেনভাবে রাজস্ব বৃদ্ধি। বাংলার নবাবি আমলে যত জমি রাজস্বমুক্ত ছিল, সেগুলি খুঁজে খুঁজে রাজস্বের আওতায় আনা হতে শুরু করল। বাংলার প্রখ্যাতরা ব্রিটিশদের হয়ে এই কাজ করেছেন। কারণ বাংলা লুঠের অর্থ দেশে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হলে চিত্তির, হামাগুড়ি দেওয়া শিল্পায়ন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। এর জন্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে ছিয়াত্তরও করতে হয়েছে তাকে ১ কোটি মানুষ মেরে – এবং সেই বছরই সব থেকে বেশি রাজস্বও আদায় করেছে তারা।
চুঁচুড়ায় এত দিন ওলান্দাজদের নীতি অনুয়ায়ী জমি আর তার রাজস্বের হিসেব হত। এবারে উদয় হলেন স্বয়ং লুঠেরারাজ ব্রিটিশ ব্যবসায়ী সরকার – তাদের এবং তাদের নবজাগরিত বন্ধুদের কবল থেকে কারোর মুক্তি নাই। ব্রিটিশদের হাতে চুঁচড়ো আসার পর নতুন করে পাট্টা দেওয়া শুরু হল নতুন রাজার রাজস্ব নীতিতে। দায়িত্ব পড়ল যোগ্যতম করণিক জয়কৃষ্ণের ওপর। জয়কৃষ্ণ তখন বেশ কিছু লুকিয়ে রাখা জমির হদিশ পেলেন। গবেষক বলছেন জয়কৃষ্ণ বেশ কিছু প্রভাবশালী প্রজার বিরাজভাজন হন। অভিযোগ জমা পড়ে। তিনি কিছু দিন কারারুদ্ধও হন এবং কয়েকজন ব্রিটিশ কর্মচারী সহ তিনিও পদচ্যুত হন। ইংরেজরা পরে যদিও বুঝল তদের বফাদার জয়কৃষ্ণ নির্দোষ। কিন্তু অপমানিত জয়কৃষ্ণ চাকরিতে ফিরে যেতে অস্বীকার করেন। সাম্রাজ্যের অভয় হস্ত মাথায় নিয়েই নিজেই জমিদারির ব্যবসায় নামার মনস্থির করেন।
কেন জয়কৃষ্ণ সেরেস্তাদারিরতে আবার ফিরতে রাজি হলেন না খতিয়ে দেখি – যদিও হাতে কোনও প্রমান নেই, কিন্তু দ্বারকানাথের উদাহরণে আমরা জানি যে সে সময় সেরেস্তাদারির চাকরিতে দুটো সুযোগ ছিল
১। বেআইনি রোজগার - দ্বারকানাথের চাকরি পাওয়ার সময়ে ঘুষের বড় কড়ার ছিল...৩৫ টাকা বেতনের কর্মচারী তাহার উপরিতন সাহেব কর্মচারীকে মাসিক ৫০০ টাকা দিবার বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন তিনি নিজে কেন না আর ৫০০ টাকা মুনাফা করিবেন (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী)
 এবং ২। জমিদারির সুলুক সন্ধান করা – তিনি যেমন ভরতপু্র আক্রমনের গোপন সামরিক চিঠি পড়ে অগ্রবাহিনীর সঙ্গে লুঠতে গিয়েছিলেন, তেমনি সেরেস্তাদারিতে কোন জমিদারি সাতান আর কোন জমিদারি নাতান তা বিলক্ষণ জানতে পেরেছিলেন চাকরি করার সময়। 
ভদ্রবিত্ত বাঙালিকে জমিদারি চুষিকাঠি ধরিয়েছে ইংরেজ। পলাশীর পর যতটুকু লুঠের অর্থ জোগাড় করতে পেরেছিল দাদনিবণিকদের উত্তরাধিকারী বাঙালি অবাঙ্গালি সক্কলে, তারা তাদের সর্বস্ব দিয়ে যে জমাটুকু রেখেছিল, তা সব ব্রিটিশ শিল্পাযনের যুপকাষ্ঠে বলি দেয় জমিদারি কিনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। অনুপস্থিত থেকেই জমিদারিতেই মন দিতে থাকে শহুরে ভদ্রবিত্ত বাঙালি। তাকে জমিদারি মধু খাওয়ার পথ দেখিয়ে গিয়েছেন দ্বারকানাথ ঠাকুর
ক্ষিতীন্দ্রানাথ ঠাকুর তাঁর পূ্র্বপুরুষ, দ্বারকানাথের জীবনীতে বলছেন, ...দ্বারকানাথ ২৪ পরগণার কালেক্টরেটের সেরেস্তাদার হওয়াতে কোন জমিদারীর কিরূপ আয়, সাতান কি নাতান, এই সকল বিষয় সকলই নিশ্চই জানিতে পারিয়াছিলেন সুতরাং যেই কোন জমিদারী নীলামে উঠিল, অমনি তাহা কিনিয়া লইলেন ...কালিগ্রাম ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে এবং সাহাজাদপুর ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে এবং অন্যান্য জমিদারীও এই সময়ের কাছাকাছি কেনা হইয়াছিল  শুধু দ্বারকানাথের মত কলকাতার সৌভাগ্যবানেরাই নয়, জেলার নানান সুযোগসন্ধানী – যেমন জয়কৃষ্ণ, সাম্রাজ্যের নানান সেবা করার ফলস্বরূপ এই উপহার অর্জন করার সৌভাগ্য লাভ করেন
চাকরি করে যা রোজগার করেছেন, সেই পুঁজি নিয়েই তিনি নিজে জমিদারি কিনে, নতুন করে ভাগ্য ফেরানোর কাজে নামলেন। 


সূত্র – ইতিকথা, জানু ২০১৩
ময়ূখ দাস - জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় – মেট্রোপলিটন মনন ফীলান্থ্রপিক চেতনা

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১ - নবজাগরিত জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় - সাম্রাজ্য লুঠের অনন্য সঙ্গী

আমরা নজর দেব জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের কাজে। সময়টা নবজাগরিত বাবুদের সাম্রাজ্য-লুঠের সঙ্গী হওয়ার। জয়কৃষ্ণ যখন ভরতপুর লুঠের মাল নিয়ে উত্তরপাড়ায় ফিরছেন রামমোহন দ্বারকানাথ মধ্যগগণে। তিনি ফিরে জমিদারিতে মন দেবেন।
১৮০৮এ জন্ম জয়কৃষ্ণর। আদি নিবাদ ফুলিয়া। ঠাকুদ্দা নন্দগোপাল বিবাহ সুত্রে উত্তরপাড়ায় আসেন। ১৭৯৪এ মারা যাওয়ার সময়, ছেলে জগমোহনের দুবছরমাত্র বয়স। ঠাকুমা শিবানীদেবী যুগের হাওয়া বুঝে তাঁকে কলকাতায় ইংরেজি শেখান। ২০ বছর বয়সে জগমোহনের চাকরি হয় কলকাতার কমিসারিয়েটে। উচ্চাভিলাষী জগমোহন পদাতিক বাহিনীর মেস রাইটারের পদ খুঁজে নেন। বাহিনীর সঙ্গে নানান জায়গায় ঘোরেন, মীরাটে পেমাস্টার পদে নিযুক্ত হলেন। তার আগেই জগমোহনের বিবাহ শেষ – ছেলেও হয়েছে – নাম জয়কৃষ্ণ। ঠাকুমা তেজারতির কারবার করতেন। ছোটবেলা থেকেই ঠাকুমার হিসেব রাখতেন জয়কৃষ্ণ। যুগের দাবি বুঝেই বাবার মত ইংরেজিও শেখা শুরু করেন বাল্য বয়সেই।
১৮২০তে জগমোহন উত্তরপাড়ায় আসেন। মীরাটে যাওয়ার আগে কলভিন এন্ড কোংএ নামে একটি এজেন্সি হৌসে কিছু রূপারপাত্র আর সামান্য রত্ন গচ্ছিত রেখেগিয়েছিলেন। গুদামবাবু সেগুলি নিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার সেখান থেকে বেশ মোটা টাকা উদ্ধার করেন এবং পরিবারের সুদের ব্যবসা থেকেও বেশ কিছু অর্থ তুলে তৃতীয় বিবাহ এবং দুর্গাপুজো আয়োজন করেন। ১৮২১এ পরিবারশুদ্ধ মীরাটে যান। সকলে চলে এলেও জয়কৃষ্ণ বাবার সঙ্গে থেকে যান মীরাট ছাউনিতে।
এখানে নানানভাবে ব্যবহারিক ইংরেজিতে নিজেকে তৈরি করে তোলেন – বাবার থেকে আরাবিয়ান নাইটস, বাবার সহকর্মী ভোলানাথ ঘোষের থেকে ইউনিভার্সাল লেটার রাইটিং, ক্লার্ক বাবু রাজচন্দ্র নিয়োগীর থেকে কমপ্লিট লেটার রাইটিং শিখতে শুরু করেন। রেজিমেন্টাল স্কুল ছয় মাস পড়েন। গ্রন্থাগারেও নানান বিষয় পড়তে থাকেন। বাবা তাঁকে ক্যাপ্টেন ওয়াটকিনসনের মিলিটারি পে দপ্তরে শিক্ষানবিশি হিসেবে লাগিয়ে দেন। বছর খানেক পরে বাবার মত মেস হৌস আর রেজিমেন্টাল পে মাস্টার হিসেবে এবং ১৮২৪ সালে ক্যাপ্টেন কম্বের আপিসে প্রধান করণিক হিসেবে যোগ দেন।
১৮২৬এ একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যান বাবা-ছেলে – যা তাদের ভবিষ্যতের রাতা চিনিয়ে দেবে – কোম্পা্নির ভরতপুর অভিয়ান। বাহিনীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে ছিলেন করণিক বাবা-ছেলে। জয়কৃষ্ণর ইংরেজি দক্ষতাহেতু নানান সেনার গোপনীয় চিঠি পড়তে পেতেন। সেনাপতি নিকোলাসের ধারণা ছিল বালক করণিক চিঠির মর্মবস্তু উদ্ধার করতে পারবে না। তাই তিনি তাকে চিঠি নকল করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জয়কৃষ্ণ প্রথম ব্রিগেডের সঙ্গে সামনে ছিলেন। জানুয়ারিতে বিনাবাধায় সেনা দুর্গতে ঢোকে। সৈন্যেরা লুঠ শুরু করে। হাতাহাতি ইত্যাদির মধ্যেই সুযোগ বুঝে রাজপ্রাসাদ, অভিজাতদের বাড়ি, ধনী শেঠেদের বাড়ি ইত্যাদি অবাধে লুঠ হতে থাকে কয়েক ঘন্টা ধরে। ঘন্টা তিনেক অবাধ লুঠ শেষ হলে লুঠের যে অংশ প্রাইজ এজেন্টের কাছে জমা পড়ে তার মূল্য ১১ কোটি টাকা। যা জমা পড়ল না, তার মূল্য কষা হয়েছিল দ্বিগুণেরও অনেক বেশি। আইনিভাবে বাবা-ছেলে লুঠের অংশ পায় – এই যুগে ৫৬০০০ টাকা! অগ্রবর্তী সেনার সঙ্গে বেআইনিভাবে কত লুটেছেন কেউ জানে না।
কাজের সুবাদে অন্যান্য সেনানায়কের সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্ব হয়। এই বাহিনীতেই বড়লাট লর্ড আমহার্স্টের ছেলে সামরিক শিক্ষা নিচ্ছিলেন। তার সঙ্গে জয়কৃষ্ণের অদ্ভুত বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

ভরতপুরের ঘটনার শেষে দুজনকেই আগরা দুর্গে পাঠানো হয়। ১৮২৬এ মিরাটে ফিরে আসেন। হঠাৎ সেনাবাহিনীর কাজ ছেড়ে দেন। বড়লাটের ছেলের বন্ধুত্ব ঠুকরে, কাজ ছেড়ে বাবা-ছেলে কেন বাংলায় ফিরে এলেন, এর কোনও যথাযোগ্য উত্তর আজও মেলে নি। 


সূত্র – ইতিকথা, জানু ২০১৩


ময়ূখ দাস - জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় – মেট্রোপলিটন মনন ফীলান্থ্রপিক চেতনা