আমরা নজর দেব জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের
কাজে। সময়টা নবজাগরিত বাবুদের সাম্রাজ্য-লুঠের সঙ্গী হওয়ার। জয়কৃষ্ণ যখন ভরতপুর
লুঠের মাল নিয়ে উত্তরপাড়ায় ফিরছেন রামমোহন দ্বারকানাথ মধ্যগগণে। তিনি ফিরে
জমিদারিতে মন দেবেন।
১৮০৮এ জন্ম জয়কৃষ্ণর। আদি
নিবাদ ফুলিয়া। ঠাকুদ্দা নন্দগোপাল বিবাহ সুত্রে উত্তরপাড়ায় আসেন। ১৭৯৪এ মারা
যাওয়ার সময়, ছেলে জগমোহনের দুবছরমাত্র বয়স। ঠাকুমা শিবানীদেবী যুগের হাওয়া বুঝে
তাঁকে কলকাতায় ইংরেজি শেখান। ২০ বছর বয়সে জগমোহনের চাকরি হয় কলকাতার কমিসারিয়েটে।
উচ্চাভিলাষী জগমোহন পদাতিক বাহিনীর মেস রাইটারের পদ খুঁজে নেন। বাহিনীর সঙ্গে
নানান জায়গায় ঘোরেন, মীরাটে পেমাস্টার পদে নিযুক্ত হলেন। তার আগেই জগমোহনের বিবাহ
শেষ – ছেলেও হয়েছে – নাম জয়কৃষ্ণ। ঠাকুমা তেজারতির কারবার করতেন। ছোটবেলা থেকেই
ঠাকুমার হিসেব রাখতেন জয়কৃষ্ণ। যুগের দাবি বুঝেই বাবার মত ইংরেজিও শেখা শুরু করেন
বাল্য বয়সেই।
১৮২০তে জগমোহন উত্তরপাড়ায়
আসেন। মীরাটে যাওয়ার আগে কলভিন এন্ড কোংএ নামে একটি এজেন্সি হৌসে কিছু রূপারপাত্র
আর সামান্য রত্ন গচ্ছিত রেখেগিয়েছিলেন। গুদামবাবু সেগুলি নিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার
সেখান থেকে বেশ মোটা টাকা উদ্ধার করেন এবং পরিবারের সুদের ব্যবসা থেকেও বেশ কিছু
অর্থ তুলে তৃতীয় বিবাহ এবং দুর্গাপুজো আয়োজন করেন। ১৮২১এ পরিবারশুদ্ধ মীরাটে যান।
সকলে চলে এলেও জয়কৃষ্ণ বাবার সঙ্গে থেকে যান মীরাট ছাউনিতে।
এখানে নানানভাবে ব্যবহারিক
ইংরেজিতে নিজেকে তৈরি করে তোলেন – বাবার থেকে আরাবিয়ান নাইটস, বাবার সহকর্মী
ভোলানাথ ঘোষের থেকে ইউনিভার্সাল লেটার রাইটিং, ক্লার্ক বাবু রাজচন্দ্র নিয়োগীর
থেকে কমপ্লিট লেটার রাইটিং শিখতে শুরু করেন। রেজিমেন্টাল স্কুল ছয় মাস পড়েন।
গ্রন্থাগারেও নানান বিষয় পড়তে থাকেন। বাবা তাঁকে ক্যাপ্টেন ওয়াটকিনসনের মিলিটারি
পে দপ্তরে শিক্ষানবিশি হিসেবে লাগিয়ে দেন। বছর খানেক পরে বাবার মত মেস হৌস আর
রেজিমেন্টাল পে মাস্টার হিসেবে এবং ১৮২৪ সালে ক্যাপ্টেন কম্বের আপিসে প্রধান করণিক
হিসেবে যোগ দেন।
১৮২৬এ একটা গুরুত্বপূর্ণ
ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যান বাবা-ছেলে – যা তাদের ভবিষ্যতের রাতা চিনিয়ে দেবে – কোম্পা্নির
ভরতপুর অভিয়ান। বাহিনীর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে ছিলেন করণিক বাবা-ছেলে। জয়কৃষ্ণর
ইংরেজি দক্ষতাহেতু নানান সেনার গোপনীয় চিঠি পড়তে পেতেন। সেনাপতি নিকোলাসের ধারণা
ছিল বালক করণিক চিঠির মর্মবস্তু উদ্ধার করতে পারবে না। তাই তিনি তাকে চিঠি নকল
করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জয়কৃষ্ণ প্রথম ব্রিগেডের সঙ্গে সামনে ছিলেন। জানুয়ারিতে
বিনাবাধায় সেনা দুর্গতে ঢোকে। সৈন্যেরা লুঠ শুরু করে। হাতাহাতি ইত্যাদির মধ্যেই
সুযোগ বুঝে রাজপ্রাসাদ, অভিজাতদের বাড়ি, ধনী শেঠেদের বাড়ি ইত্যাদি অবাধে লুঠ হতে
থাকে কয়েক ঘন্টা ধরে। ঘন্টা তিনেক অবাধ লুঠ শেষ হলে লুঠের যে অংশ প্রাইজ এজেন্টের কাছে
জমা পড়ে তার মূল্য ১১ কোটি টাকা। যা জমা পড়ল না, তার মূল্য কষা হয়েছিল দ্বিগুণেরও
অনেক বেশি। আইনিভাবে বাবা-ছেলে লুঠের অংশ পায় – এই যুগে ৫৬০০০ টাকা! অগ্রবর্তী
সেনার সঙ্গে বেআইনিভাবে কত লুটেছেন কেউ জানে না।
কাজের সুবাদে অন্যান্য
সেনানায়কের সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্ব হয়। এই বাহিনীতেই বড়লাট লর্ড আমহার্স্টের ছেলে
সামরিক শিক্ষা নিচ্ছিলেন। তার সঙ্গে জয়কৃষ্ণের অদ্ভুত বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
ভরতপুরের ঘটনার শেষে দুজনকেই
আগরা দুর্গে পাঠানো হয়। ১৮২৬এ মিরাটে ফিরে আসেন। হঠাৎ সেনাবাহিনীর কাজ ছেড়ে দেন।
বড়লাটের ছেলের বন্ধুত্ব ঠুকরে, কাজ ছেড়ে বাবা-ছেলে কেন বাংলায় ফিরে এলেন, এর কোনও
যথাযোগ্য উত্তর আজও মেলে নি।
সূত্র – ইতিকথা, জানু ২০১৩
ময়ূখ দাস - জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় – মেট্রোপলিটন মনন ফীলান্থ্রপিক চেতনা
No comments:
Post a Comment