Monday, March 25, 2019

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৩ - নবজাগরিত জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় - সাম্রাজ্য লুঠের অনন্য সঙ্গী

জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের জমিদারি নিয়ে আলোচনার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তার সময় কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জমিদারিও যে একটা গুরুত্বতম  কাজ, এই কাজ করতে গায়ে গতরে খাটতে হয়, কষ্ট করে গ্রামে থেকে নবাবি আমলের মত প্রজাদের সমস্যা বুঝতে হয়, নানান দায়িত্ব নিতে হয়, এ সব ধারণা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভাবনায় মোটামুটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জমিদারদের বাস হয়েউঠল কলকাতা। পলাশীর পরে রাণী ভবানী ইত্যাদির মত প্রজাবতসল পরম্পরার জমিদারেরা ততদিনে অস্ত গিয়েছেন। যারা আসছেন, তাদের অধিকাংশই জোহুজুর, অন্য পেশার, জমিদারি সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ।
১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রয়োগ করার পর থেকে রাজস্ব আদায় অনিয়মিত ও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, প্রশাসনিক ব্যয় বেড়ে যায়, রাজস্ব আয় কমে আসে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ওয়েলেসলি তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কিত মূল বিধিগুলির কিছু সংশোধন করে জমিদাদের সঙ্গে আপস করার সিদ্ধান্ত নেন। এরই প্রেক্ষাপটে প্রণীত হয় ১৭৯৯ সালের ৭ নং রেগুলেশন যা সাধারণত হফতম বা সপ্তম আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ আইনের ফলে রায়তদের ওপর জমিদারদের লাগামহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়। জমিদার বকেয়া আদায়ের নামে প্রজাদের ফসল, গবাদি ও সম্পত্তি ক্রোক এবং বিক্রয় করে বকেয়া আদায়ের অধিকার লাভ করে। স্বত্বাধিকারী হিসেবে তারা খেলাপি রায়তদের তাদের নিজ নিজ কাছারিতে তলব করার ও বকেয়া পরিশোধ না করা পর্যন্ত তাদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে আটকে রাখার, কোনো খেলাপি রায়ত তার পরিবার ও সহায়-সম্পত্তি নিয়ে অন্য কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে গেলে ওই  রায়তের গ্রামের সকলের ওপর পাইকারি জরিমানা আরোপের ক্ষমতা লাভ করে। পরগনাপ্রথা(প্রশাসনিক সুবিধার জন্য জমির বিভিন্ন ধরনের স্বত্বাধিকারীদের অধিকার ও দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির অভিন্নতার ভিত্তিতে পরগনাগুলিকে দস্তুর বা এলাকায় ভাগ করা হতো। সরকার ও অপরাপর সকল পক্ষ প্রথাগতভাবেই পরগনা দস্তুর বা পরগনা নিয়ম কানুন মেনে চলতে বাধ্য ছিল। পরগনা দস্তুরে পরগনা নিরিখ বলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। পরগনা নিরিখের মাধ্যমে জমির খাজনা, ফিস ও মজুরি, ওজন ও পরিমাপ নিয়ন্ত্রিত হতো। প্রতিটি পরগনার নিজস্ব নিরিখ ছিল যা সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণ জানত ও বুঝত, যদিও বহিরাগতদের কাছে এগুলি অদ্ভুত ও কৌতুকাবহ মনে হতো। এ পরগনা দস্তুর ও পরগনা নিরিখ প্রথাগতভাবে বহুকাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল।} অগ্রাহ্য করে জমিদাররা যথেচ্ছভাবে খাজনা বৃদ্ধির ক্ষমতা লাভ করে। সংক্ষেপে, রায়তগণ এতকাল যাবৎ ঐতিহ্যগতভাবে যেসব প্রথাগত অধিকার ভোগ করে আসছিল হফতম সেসব অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে। রায়ত অসহায় কোর্ফা প্রজায় পরিণত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে বদলে দেয় ১৮১৯ সালের ৮নং রেগুলেশন যা সাধারণভাবে পত্তনি আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ আইনবলে জমিদার ও রায়তের মধ্যবর্তী একটি বহুস্তরবিশিষ্ট মধ্যস্বত্ব শ্রেণি সৃষ্টি করার অধিকার লাভ করে। বাস্তবিকপক্ষে, এ ছিল জমিদারি ক্ষমতার চরম শিখর এবং একই সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল উদ্দেশ্যের ব্যর্থতা। এ আইনের আওতায় জমিদারগণ তাদের খেলাপি পত্তনিদারদের জমি প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় করার অধিকার লাভ করে, ঠিক যেভাবে সূর্যাস্ত আইনের আওতায় খেলাপি জমিদারের জমি নিলাম হয়ে যেতো।
তো মুখোপাধ্যায়েরা যখন বিনিয়োগ করতে ঢুকছেন ততদিনে এই বন্দোবস্ত ত্রিশ বছরের যুবক।  বিনিয়োগকারী ভদ্রবিত্তছায়েরা জমিদারির একফোঁটা জ্ঞান আর চালানোর মানসিকতা না নিয়েই তাদের জমিদারির রাজস্ব আদায়, প্রাজাপীড়ন ইত্যাদি জরুরি কাজ একে একে আইনিভাবেই পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, তেপত্তনিদার, ছেপত্তনিদার(বিনয় ঘোষ এরকম ২২ রকম মধ্যস্বত্ত্বভোগীর নাম নিয়েছেন} মত দালালদের হাতে তুলে দিয়ে বিনাশ্রমে রোজগার করতে থাকেন।



সূত্র – ইতিকথা, জানু ২০১৩
ময়ূখ দাস - জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় – মেট্রোপলিটন মনন ফীলান্থ্রপিক চেতনা

No comments: