বাপ-ব্যাটায় মীরাট থেকে ফিরে
এলেন উত্তরপাড়ায়। ১৮২৫এ চুঁচড়ো ওলান্দাজদের থেকে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে
ইংরেজদের হাতে আসে। ২০০ বছরের কেল্লাকে অধিকার করে ইংরেজরা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে।
যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী বলছেন মিরাট থেকে ফিরে এসে অভিজ্ঞ দুজনই নতুন সামরিক ছাউনিতে
কাজে যোগ দিচ্ছেন। বেন্টিঙ্কের ব্যয় সংকোচনের নীতিতে ১৮৩০এ বন্ধ হয় এই ছাউনি। এই
সময় জগমোহন কলকাতার চারটি এজেন্সি হৌসে – মেসার্স ফ্রাইডলি, মেসার্স ফার্গুসন এন্ড
কোং, মেসার্স কলভিন ডিনস্লে এন্ড কোং, আর মেসার্স আলেকজান্ডার এন্ড কোংএ তাদের
লুণ্ঠিত অর্থ বিনিয়োগ করে। এদের সঙ্গে বিল অব এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনে
জুড়ে ছিলেন জগমোহন। এছাড়া বিলাতি পণ্যেরও ব্যবসা করতেন। ১৮২৮ সালে জয়কৃষ্ণর বিবাহ
হয় পার্বতী দেবীর সঙ্গে।
কিন্তু ভাগ্য অপ্রসন্ন।
এজেন্সি হৌসগুলো বহুমানুষের সঙ্গে উত্তরপাড়ার মুখোপাধ্যায়দের বিনিয়োগ নিয়ে ডুবতে
শুরু করে ১৮৩১-৩৪ সালে। একে একে বন্ধ হয়ে যায় এজেন্সি হৌসগুলো। কপর্দকহীন হয়ে
বিশাল সংসারের ভরণ করার জন্যে জয়কৃষ্ণ আবার ইংরেজ কর্তাদের স্মরণ নেন। বরাবরের মত
তারা তাকে হতাশ করেন নি। তিনি জেলা জজের অধীনে চৌকিদারির ট্যাক্সো আদায়ের কাজ শুরু
করেন ১৮৩১এ। ঐ বিভাগে এক বছর কাজ করার পর হুগলির কালেক্টর, বেলি তাকে অতি লাভের
সেরেস্তাদারির কাজ দিলেন। সেরেস্তাদারি ইংরেজ আমলে কিভাবে চলত তা আমরা বাবু
দ্বারকানাথ ঠাকুরের সেরেস্তাদারিত্বের কাহিনী থেকে জেনে নিয়েছি তার উত্তরাধিকারী
ক্ষিতীন্দ্র ঠাকুর আর জীবনীকার ব্লেয়ার বিক্লিংএর জবানীতে – কিভাবে ৩৫ টাকা মাস
মাইনের সেরেস্তাদার তার উর্দ্ধতনকে ৫০০ টাকা ঘুষ দেয় তার গোপন কথা। আরেকটু বিশদ
আলোচনায় কিছুক্ষণ বাদে যাব।
১৭৬৫ থেকেই ব্রিটিশদের
লক্ষ্য যেনতেনভাবে রাজস্ব বৃদ্ধি। বাংলার নবাবি আমলে যত জমি রাজস্বমুক্ত ছিল,
সেগুলি খুঁজে খুঁজে রাজস্বের আওতায় আনা হতে শুরু করল। বাংলার প্রখ্যাতরা
ব্রিটিশদের হয়ে এই কাজ করেছেন। কারণ বাংলা লুঠের অর্থ দেশে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হলে
চিত্তির, হামাগুড়ি দেওয়া শিল্পায়ন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। এর জন্যে চিরস্থায়ী
বন্দোবস্তের আগে ছিয়াত্তরও করতে হয়েছে তাকে ১ কোটি মানুষ মেরে – এবং সেই বছরই সব
থেকে বেশি রাজস্বও আদায় করেছে তারা।
চুঁচুড়ায় এত দিন ওলান্দাজদের
নীতি অনুয়ায়ী জমি আর তার রাজস্বের হিসেব হত। এবারে উদয় হলেন স্বয়ং লুঠেরারাজ
ব্রিটিশ ব্যবসায়ী সরকার – তাদের এবং তাদের নবজাগরিত বন্ধুদের কবল থেকে কারোর
মুক্তি নাই। ব্রিটিশদের হাতে চুঁচড়ো আসার পর নতুন করে পাট্টা দেওয়া শুরু হল নতুন
রাজার রাজস্ব নীতিতে। দায়িত্ব পড়ল যোগ্যতম করণিক জয়কৃষ্ণের ওপর। জয়কৃষ্ণ তখন বেশ
কিছু লুকিয়ে রাখা জমির হদিশ পেলেন। গবেষক বলছেন জয়কৃষ্ণ বেশ কিছু প্রভাবশালী
প্রজার বিরাজভাজন হন। অভিযোগ জমা পড়ে। তিনি কিছু দিন কারারুদ্ধও হন এবং কয়েকজন
ব্রিটিশ কর্মচারী সহ তিনিও পদচ্যুত হন। ইংরেজরা পরে যদিও বুঝল তদের বফাদার জয়কৃষ্ণ
নির্দোষ। কিন্তু অপমানিত জয়কৃষ্ণ চাকরিতে ফিরে যেতে অস্বীকার করেন। সাম্রাজ্যের
অভয় হস্ত মাথায় নিয়েই নিজেই জমিদারির ব্যবসায় নামার মনস্থির করেন।
কেন জয়কৃষ্ণ সেরেস্তাদারিরতে
আবার ফিরতে রাজি হলেন না খতিয়ে দেখি – যদিও হাতে কোনও প্রমান নেই, কিন্তু
দ্বারকানাথের উদাহরণে আমরা জানি যে সে সময় সেরেস্তাদারির চাকরিতে দুটো সুযোগ ছিল
১। বেআইনি রোজগার - দ্বারকানাথের চাকরি পাওয়ার সময়ে ঘুষের বড় কড়ার ছিল।...৩৫ টাকা বেতনের কর্মচারী তাহার উপরিতন সাহেব কর্মচারীকে মাসিক ৫০০ টাকা
দিবার বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন – তিনি নিজে
কেন না আর ৫০০ টাকা মুনাফা করিবেন (ক্ষিতীন্দ্রনাথ
ঠাকুর – দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী)।
এবং ২। জমিদারির সুলুক সন্ধান করা – তিনি যেমন
ভরতপু্র আক্রমনের গোপন সামরিক চিঠি পড়ে অগ্রবাহিনীর সঙ্গে লুঠতে গিয়েছিলেন, তেমনি সেরেস্তাদারিতে
কোন জমিদারি সাতান আর কোন জমিদারি নাতান তা বিলক্ষণ জানতে পেরেছিলেন চাকরি করার
সময়।
ভদ্রবিত্ত বাঙালিকে জমিদারি চুষিকাঠি ধরিয়েছে ইংরেজ। পলাশীর পর
যতটুকু লুঠের অর্থ জোগাড় করতে পেরেছিল দাদনিবণিকদের উত্তরাধিকারী বাঙালি অবাঙ্গালি
সক্কলে, তারা তাদের সর্বস্ব দিয়ে যে জমাটুকু রেখেছিল, তা সব ব্রিটিশ শিল্পাযনের
যুপকাষ্ঠে বলি দেয় জমিদারি কিনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। অনুপস্থিত থেকেই জমিদারিতেই
মন দিতে থাকে শহুরে ভদ্রবিত্ত বাঙালি। তাকে জমিদারির মধু খাওয়ার পথ দেখিয়ে গিয়েছেন দ্বারকানাথ
ঠাকুর।
ক্ষিতীন্দ্রানাথ
ঠাকুর তাঁর পূ্র্বপুরুষ,
দ্বারকানাথের জীবনীতে বলছেন, ...দ্বারকানাথ
২৪ পরগণার কালেক্টরেটের সেরেস্তাদার হওয়াতে কোন জমিদারীর কিরূপ আয়, সাতান কি
নাতান, এই সকল বিষয় সকলই নিশ্চই জানিতে পারিয়াছিলেন। সুতরাং যেই কোন জমিদারী নীলামে উঠিল, অমনি তাহা কিনিয়া লইলেন। ...কালিগ্রাম ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে এবং সাহাজাদপুর ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে এবং অন্যান্য জমিদারীও এই সময়ের কাছাকাছি কেনা হইয়াছিল। শুধু
দ্বারকানাথের মত কলকাতার সৌভাগ্যবানেরাই নয়, জেলার নানান
সুযোগসন্ধানী – যেমন জয়কৃষ্ণ, সাম্রাজ্যের নানান সেবা
করার ফলস্বরূপ এই উপহার অর্জন করার সৌভাগ্য লাভ করেন।
চাকরি করে যা রোজগার করেছেন,
সেই পুঁজি নিয়েই তিনি নিজে জমিদারি কিনে, নতুন করে ভাগ্য ফেরানোর কাজে নামলেন।
সূত্র – ইতিকথা, জানু ২০১৩
ময়ূখ দাস - জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় – মেট্রোপলিটন মনন ফীলান্থ্রপিক চেতনা
No comments:
Post a Comment