(এর আগে বাংলার জমিদারির আদায় নিয়ে আলোচনা করেছি আমার পলাশীর পূর্বে বাংলার ৫০ বছর বইতে। বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের ভাবনা ভাবছি। জমি আর রাজস্ব ব্যবস্থা প্রথন খণ্ডে আলোচিত হয় নি। তাই এখানে ছুঁয়ে যাচ্ছি জাফরখানি ব্যবস্থার পটভূমিকা। কয়েক কিস্তিতে আলোচনা করব জাফরখানি ব্যবস্থা কেন আলাদা ছিল মুঘল শাসন থেকে। এটি মূলত নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব বেঙ্গল আর রমেশ দত্তর দ্য ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া আরও বেশ কিছু বইএর অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। এখানে বিশদে লেখার সুযোগ নেই - তাই পটভূমি আলোচনা। বিশদে থাকবে বইতে - বিশ্বেন্দু}
এই ছিল বাদশাহী আমলের কাঠামো। আমরা প্রথম খণ্ডেও দেখেছি, ইয়েলকোণ্ডার প্রশাসক, প্রশাসনবেত্তা ফৌজদার মহম্মদ হাজি, যিনি পরে মুর্শিদকুলি খাঁ নামে পরিচিত হবেন, বাংলায় পাঠিয়েছিলেন যতটা পারা যায় সুবা বাংলা থেকে রাজস্ব আদায় করে তাঁকে দাক্ষিণাত্যে পাঠাতে। মুর্শিদকুলির প্রশাসনিক সমস্ত দাবি তিনি মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি নিজের আত্মীয়দের তীব্র তিরষ্কার করেছিলেন মুর্শিদকুলির বিরোধিতা করার জন্যে। এবং তার সারা জীবন তিনি কার্যত স্বাধীনভাবে রাজত্ব চালিয়েও মুঘল সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে প্রতি বছর নিয়ম করেও দিল্লিতে রাজস্ব পাঠিয়ে গিয়েছেন। এমন কি আওরঙ্গজেবের এন্তেকালের পর এ সিংহাসনের লড়াই দেখা দেয়, সে সময়ও তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নি।
বাংলায় এসে মুর্শিদকুলি খাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব বৃদ্ধি। সেই উদ্বৃত্ত রাজস্ব তার অন্নদাতা আওরঙ্গজেবের তহবিলে পাঠানো। তিনি বাংলায় প্রশাসন সামলে দেখলেন তহবিলে রাজস্ব বাড়াবার উপায় নেই। দাক্ষিণাত্যে উদ্বৃত্ত পাঠাবার কথা তো দূরস্থান, বাংলায় নবাবি চালানোর মত উদ্বৃত্তও তৈরি হচ্ছে না। মুর্শিদকুলি নিজে কৃচ্ছসাধন করার মত মানুষ। জাঁকজমক আতিশয্যে তাঁর খুব বেশি আকর্ষণ ছিল না – ফলে রাজস্ব বৃদ্ধি তাঁর নিজের ভোগের জন্যে নয় এটা পরিষ্কার। তিনি দেখলেন, বাংলা সুবার অধিকাংশ কৃষিযোগ্য জমি জায়গিরদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এগুলি জায়গিরদারদের রোজগার।
এমতাবস্থায় খুব সরল করে এই সময়ের বাংলার অর্থ সমস্যার রূপ এবং তার কারণটা বুঝে নেওয়া যাক। মুঘল রাজত্ব সামরিক শক্তির জন্য মনসবদের উপর নির্ভরশীল ছিল। মুর্শিদকুলি খাঁ যখন বাংলায় এলেন তখন পরিপূর্ণ মুঘল প্রাসনিক ব্যবাস্থা। মুঘল প্রাসনিক ব্যবস্থার একক সেনাবাহিনী বলছেন যদুনাথ সরকার, দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেসনএ। ‘মনসব’ কথাটির অর্থ হল পদ। কোন নির্দিষ্ট পদ বা মনসবের অধিকারকে বলা হত মনসবদার। মনসবদাররা মূলত সামরিক দায়দায়িত্ব পালন করলেও সামরিক ও বেসামরিক উভয় দায়িত্বই তাদের পালন করতে হত। জে জে এল গোমানস Mughal Warfare: Indian Frontiers and Highroads to Empire 1500–1700 বইএর ৮৪ পাতায় মনসবদারিকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলছেন In practice, every candidate for mansab needed the political and, as we shall see, financial backing of an already influential, high-ranking patron at court. The latter introduced the candidate and proposed a rank to the emperor, sometimes through the Mir Bakhshi, the main recruitment officer. After a personal assessment in public audience by the emperor, who was reportedly able to see ‘through men at the first glance’, the candidate received a fitting mansab to be followed by a lengthy bureaucratic procedure of registration and confirmation. Invested with dignity and nobility, the new mansabdar was now responsible for the enrolment and the equipment of a number of mounted retainers in accordance with his rank, mostly to be paid from jagirs for which he entered into another elaborate selection procedure involving another set of rules controlled by different officials. Thus an important element of the mansabdar’s quality was his function as a kind of military employment agency.
মনসবদার এমন এক পদাধিকারী, যার মুঘল দরবারে কোন না কোন প্রভাবশালী অভিজাতর সঙ্গে যোগাযোগ আছে এবং তাকে অবশ্যই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হতে হবে। সেই দরবারি অভিজাত তাকে অর্থ দপ্তরের মীর বক্সীর মাধ্যমে দরবারে পাদসাহের পরিচিতি করান। এবার সম্রাট তার সর্বসমক্ষে পরীক্ষা নিয়ে স্থির করতেন এই ব্যক্তিটি কত পরিমান মনসবদারির যোগ্য। যদুনাথ সরকার, দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেসনএ বলছেন শুধু সেনাবাহিনী নয়, মুঘল প্রাশাসনের প্রত্যেকটি পদকে মনসবদারি হিসেবে চিহ্নিত করা হত এবং সেনা বাহিনীর বেতনদার মীর বক্সী এদের মাইনে দিতেন। যার দরবারে যোগাযোগের মাত্রা যত বড়, তার মনসবদারি ততবেশি। মনসবদারি কিন্তু কোনভাবেই সেনাবাহিনীর কামান স্তর নির্নায়ক নয়। পাদশাহ কাকে কতটা পছন্দ করেন, মনসবদারি তার নিদর্শনমাত্র। তারপরে একটি দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তার নিযুক্তি ঘটত। মনসবদারদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সেনাবাহিনী গঠন করতে হত এবং ১০ থেকে ১০,০০০ সৈনিকের ভিত্তিতে তাদের পদমর্যাদা ঠিক করা হত। অর্থাৎ একজন মনসবদারের অধীনে যত সৈন্য ও ঘোড়া থাকত, সেই সংখ্যা অনুযায়ী তাকে তত হাজারি মনসবদার বলা হত। সাধারণত দশ হাজার মনসবদারি পদ নিরাপত্তার দিকে নজর রেখে কেবলমাত্র রাজ পরিবারের কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যেমন সন্তান অথবা সম্রাটের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেই প্রদান করা হত। যুদ্ধের প্রয়োজনে মনসবদাররা সম্রাটকে তাদের সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করত। সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ, অস্ত্রশস্ত্র বা ঘোড়ার জোগান– এর সবকিছুই মনসবদারকে করতে হত।
No comments:
Post a Comment