তো জয়কৃষ্ণ যখন জমিদারিতে
বিনিয়োগ করতে এলেন তখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা লুঠের সময়। যে কোম্পানি ব্যবসার
সময় দালাল রেখে পণ্য কিনত, যে কোনও দিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে খুব বেশি কথাবার্তা
বলে নি, ব্রিটিশ রাষ্ট্র যাকে কাজে লাগিয়েছিল বাংলা লুঠের জন্যে, চিরস্থায়ী
বন্দোবস্তও যে আদতে লুঠের একটা হাতিয়ার এটা পরোক্ষে অস্বীকার করতে চিরস্থায়ী
বন্দোবস্ত প্রয়োগ করতে আমলাদের নানান মহৎ বিতর্ককে ভূমি ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের আগমধ্বনি
হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
জয়কৃষ্ণ যখন জমিদারিতে
আসছেন, সে সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর ৮
নম্বর রেগুলেশন নির্ভর করে জমিদারেরা ঔপনিবেশিক লুঠের রাজত্ব নামিয়ে আনছেন। ১৮৩২এ
নভেম্বরে সিঙ্গুরে শ্রীনাথ রায়ের জমিদারির কিছু অংশ কেনার পর থেকেই একে একে
অন্যান্য জমিদারি কিনতে থাকেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর যেমন জমিদারদের থেকে অর্থ ধার করে
তেজারতি ব্যবসা শুরু করেন, তেমনি জয়কৃষ্ণও যতদূরসম্ভব তার সাহেব যোগের কারণেই
শ্রীরামপু্রের গোস্বামী, ভাগ্যকূলের রায়, দুর্গাচরণ লাহাদের থেকে অর্থ ধার করে
জমিদারিতে বিনিয়োগ করছেন। তার বাজার দর এতই, তার ব্রিটিশ ঘনিষ্ঠতা এত বেশি যে
জমিদারি কিনতেও বিপুল পরিমান অর্থ জমিদারদের থেকে ধার পেতে অসুবিধে হচ্ছে না।
১৮৪০এ জগমোহনের মৃত্যু ঘটে।
জয়কৃষ্ণ নিজে যেহেতু ঔপনিবেশিক লুঠেরা সেরেস্তাদারিতে ছিলেন তার কাছে খবর থাকত কম
দামে, সূর্যাস্ত ইত্যাদি আইনে কোন কোন জমিদারি বিক্রি হচ্ছে। তিনি সেগুলি কিনে
নিতেন। তিনি উদ্যমী হয়ে একে একে হুগলী, হাওড়া, বর্ধমান, অবিভক্ত মেদিনীপুর,
বীরভূম, অবিভক্ত ২৪ পরগণা ইত্যাদি জেলার ৪ লক্ষ বিঘা জমিদারির মালিক হয়ে বসেন।
আদতে জয়কৃষ্ণ বিষয়ে আলোচনা
করছি কেন, যে জন্যে আমরা লুঠেরাদের সঙ্গী দ্বারকানাথ বা রামমোহনের কীর্তিকলাপ
আলোচনা করি, সেই কারণেই – তিনি ব্রিটিশদের রাজস্ব বাড়াতে সাহায্য করেছেন। অন্য
জমিদার আগে বর্ণিত নানান নামের মধ্যসত্ত্বভোগীকে জমিদারিটি নিশ্চিন্তে হস্তান্তর
করে কলকাতায় নবজাগণে সাহেবদের পরিকল্পনা অনুয়ায়ী মোসাহেবি করে বা প্রগতিশীলতার নাম
করে ইওরোপের স্বার্থ দেখত অথবা ইয়ার দোস্ত নিয়ে বেলেল্লাপনা বা বেশ্যা গমন করত।
যেহেতু অষ্টম আইনে জমিদারি হস্তান্তর করা মধ্যসত্ত্বভোগীকে কাজে ফাঁকিমারার জন্যে
সোপার্দ করা যেত, জমিদারেরা তাদের ওপর আরও বেশি বেশি নির্ভর করা শুরু করলেন।
কিন্তু জয়কৃষ্ণ অন্যধাতুর উদ্যমী। তিনি তার প্রভুদের সন্তুষ্টির জন্যে নিজে গ্রামে
ঘুরে ঘুরে লুকিয়ে রাখা জমি খুঁজ বেড়াতেন, যাতে শৈশবেই ইওরোপিয় শিল্পাযনের শিশু
মৃত্য না ঘটে, সেখানে জমিথেকে রাজস্ব তুলে পাঠানো যায়।
গবেষক বলছেন তিনি জমিদারি
কিনেই দৌড়োতেন সেটি দেখতে। দেখতেন ভাল ভাল উৎকৃষ্ট জমি নাকি গ্রামের মহাজন,
পুরোহিত, গুরু, উকিল, সরকারি কর্মচারী ইত্যাদি অনুতপাদক শ্রেণীর হাতে চলে যাচ্ছে।
অনেক সময় মণ্ডল প্রভৃতি রায়তেরা খাজনা জমিকে নিষ্কর হিসেবে বিক্রি করে দিত। সম্পদশালী
মানুষ মারা গেলে তার জমি মহাজন, গুরু, পুরোহিতদের নিষ্কর হিসেবে দান করা হত। অনেক
জমি লুকিয়ে রাখা হত। এগুলি গোমস্তাদের সাহায্য ছাড়া তালুকদারের পক্ষে বোঝা সম্ভব
ছিল না। অনেক সময় গোমস্তা ঘুষ খেয়ে বিষয়গুলো চেপে যায়। তিনি সেগুলোকে রাজস্বের
আওতায় আনতেন।
আসলে মাথায় রাখতে হবে বড়
পুঁজির উদ্যম উপনিবেশই একমাত্র উতপাদক – আর সবাই অনুতপাদক এমন একটা তত্ত্ব ছড়িয়ে
আছে। ফলে কোনও জমি যখন সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে কন্ট্রিবিউট করে
সেটা আদতে অনুতপাদক ব্যয়ই ধরে নেয় লুঠেরারা। আমরা যারা কারিগর অর্থনীতির মানুষ,
তাদের কাছে এটাই উতপাদক ব্যয়, আর সব অনুতপাদক ব্যয়।
সূত্র – ইতিকথা, জানু ২০১৩
ময়ূখ দাস - জমিদার জয়কৃষ্ণ
মুখোপাধ্যায় – মেট্রোপলিটন মনন ফীলান্থ্রপিক চেতনা
No comments:
Post a Comment