এর
বাইরে গৃহভিত্তিক বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্র ছিল। সে ক্ষেত্রে দিগদর্শন করাতেন
কোন এক গুণী ওস্তাদ। এই গুণী ওস্তাদের গৃহক্ষেত্রজুড়ে গড়ে উঠত এক বিশাল
বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র। যে সব সম্রাট এই শিক্ষা ব্যবস্থা বিস্তৃতির
কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ফিরোজ শাহ তুঘলক(১৩৫১-১৩৮৮) অন্যতম। তার রাজসভায়
বহু জ্ঞানী গুনীর সমাগম হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি,
সিরাজ আরিফ, জিয়াউদ্দিন বার্নি, মৌলানা খ্বাজা, কাজি আবদুর কাদির,
আজিজুদ্দিন খালিদ খানি অন্যতম।
ফরিস্তা লিখছেন ফিরোজ যে সব পরিকাঠামো গড়ে ছিলেন তার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র অন্যতম ছিল। আবুল বাকি বলছেন তিনি এধরণের অন্তর ৫০টি মাদ্রাসা তৈরি করিয়েছিলেন যেখানে রাষ্ট্র শিক্ষকদের মাইনে দিত। এগুলির মধ্যে সবথেকে প্রখ্যাত ছিল ফিরুজাবাদের ফিরোজশাহী মাদ্রাসা যার বর্ণনা বার্নি বিশদে দিয়েছেন। এখানে পড়াতেন রুমি, বহু শিক্ষককে সমরখন্দ থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছিল। দিল্লির লাহোর গেটের কাছে তার পুত্র ফাতা খানের সমাধিতে সে শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে তার নাম কদম শরিফ।
সিকান্দর লোধি(১৪৫৮-১৫১৮)র বিষয়ে ফরিস্তা লিখছেন, এ সময়ে অমুসলমানেরা পার্সি পঠন পাঠন আর ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থায় অংশ নিলেন। একশ বছরও লাগল না, তাঁরা হয়ে উঠলেন ইসলামি জ্ঞানীদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার উপযুক্ত। তিনি আয়ুর্বেদকে পার্সি ভাষায় অনুবাদের কাজ শুরু করান। সিকান্দর লোধির প্রধানমন্ত্রী মিঞা ভোয়া, সুলতানের নির্দেশে হাকিম আর বৈদ্যদের দিয়ে বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা লেখান। এই বইটির নাম দেওয়া হয় মাদনুষ সাইফি সিকান্দরি। ওয়াকয়াতি মুস্তাকি লিখছেন এই বইটির নাম টিবইসিকান্দরি, সে সময় ভারতে আয়ুর্বেদ বিষয়ে এর থেকে ভাল বই আর ছিল না। তার সূত্র থেকে জানতে পারি সেই সময় খোরসান এবং অন্যান্য এলাকা থেকে থেকে পাঁচজন হস্তলেখবিদ নিয়ে আসা হয়েছিল সব ধরণের বিজ্ঞান বিষয়ে পুস্তক তৈরির জন্য। মুঘল আম্লের জ্ঞানচর্চা নিয়ে বিশদে চর্চা হয়েছে। পরম আমরা মুঘল বিদুষীও ছেপেছি। ফলে এখন মুঘল আমল এড়িয়ে যাওয়া গেল।
প্রযুক্তি শিক্ষা
ইসলামি যুগের আগে থেকেই বাংলা তথা ভারত শিল্প উৎপাদনে মাহির ছিল। তবে সে প্রচেষ্টা কিছুটা গতি পায় ইসলামি আমলে। বিশেষ করে বয়ন শিল্প, সূচের কাজ করা ফেজ টুপি, চিত্রিত এবং এনামেলের কাজ করা পাত্র, বিভিন্ন তৈজস্পতে, ইস্পাতের বন্দুক, ছুরি, কামান, কাঁচি, সাদা কাগজ, সোনা রূপা এবং নানান দামি ধাতুর অলঙ্কারের কাজ আজও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই প্রযুক্তি বিষয়ে বিশদ বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চা ছাড়া এত অগ্রগতি যে করা যেত না তা বলাই বাহুল্য। গৃহস্থ ভিত্তিকই হোক বা শিক্ষাক্ষেত্র, উস্তাদেরা ছিলেন শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রে। তাঁর গুণ আর তাঁর শিক্ষা দেওয়ার মানের ওপর নির্ভর করত সেই ক্ষেত্রটির উতকর্ষ। শাগির্দরা গুরুর বাড়িতে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন - এই ব্যবস্থাটা আগে আমরা আলোচনা করা শিক্ষানবিশী ব্যবস্থারই অনুরূপ।
আদতে শিক্ষাব্যবস্থার বাইরের রূপ আর গন্ধ পরিবর্তন ঘটলেও যে শুদ্র শিক্ষা ব্যবস্থার কথা আমরা আলোচনা করছি, তার মৌলিক কোন পরিবর্তন আসে নি, যতদিন না বিশ্বাসঘাতক, দেশিয় শিল্প-বিদ্যাচর্চা ধ্বংসকারী মধ্যবিত্তকে ট্যাঁকে নিয়ে দেশিয় জ্ঞানচর্চা ভিত্তিক উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থা ধ্বংস করে নি। পারিবারিক ক্ষেত্রে বাবা পুত্রের শিক্ষার দায়িত্ব নিতেন, আর মা পুত্রীর। বিভিন্ন ধরণের প্রযুক্তির যন্ত্র তৈরি করার অসীম দক্ষতার বিকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন পরিবারে - যেমন নক্ষত্র যন্ত্র - এস্ট্রোলেবেল তৈরি করতেন চার প্রজন্মের পরিবারে বিকশিত লাহোরের শেখ আল্লাদাদএর পুত্র মুল্লা ইশার পুত্র কায়িম মহম্মদের পুত্র জিয়াউদ্দিন মহম্মদ। এই যন্ত্রের চাহিদা ছিল সারা এশিয়া জুড়ে। ইওরোপের কথা না বলাই ভাল।
কারখানা
ওস্তাদ-শাগির্দ পরম্পরার বাইরে গড়ে উঠেছিল কারখানা ব্যবস্থা। প্রথমে ছিল শুধুই উৎপাদন ব্যবস্থা, কিন্তু ক্রমশ তাঁরা উৎপাদনের পাশাপাশি শিক্ষা দিতেও উদ্যমী হয়। এই ব্যবস্থা যাতে ঠিকমত চলতে পারে তার জন্য শাসকেরা জনকৃত্য বিভাগ সুরাতিআম তৈরি করেন। এই বিভাগের কাজ ছিল কারখানাগুলি ঠিক মত চলছে কিনা তা দেখা শোনা করা এবং তাঁরা যাতে সঠিকভাবে শিক্ষা দান করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। প্রত্যেক কারখানায় বিভিন্ন বিভাগ থাকত, সেখানে থাকত নানান কাজের যন্ত্র কাজের বিভাগ অনুসারে।
বার্ণিয়ে বিভিন্ন কারখানা ঘুরে দেখে তার বিশদ বিবরণ দিয়ে গিয়েছেন। বড় একটি ঘরকে কারখানা বলা হত। হয়ত সেটি বিভিন্ন উপঘরে ভাগ করা হত। একটি ঘরে সূচীকারীরা ওস্তাদের নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত হয়ে আছেন। অন্য ঘরে হয়ত আছেন স্বর্ণিকার, কোথাও চিত্রকর, কোথাও গালার কাজের শিল্পী, কোথাও বা বার্নিশ হচ্ছে, পঞ্চম ঘরে জোড়াদার, টার্নার, দর্জি, আর মুচি কাজ করছেন একযোগে, ষষ্ঠ ঘরে মসলিন, তসর, রেশম কাপড় দিয়ে উষ্ণীষ, ব্রোকেড, সোনার ফুল, ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে মহিলাদের জন্য - সেগুলি এতই স্পর্শকাতর যে এক রাত্র পরলেই সেগুলি নষ্ট হয়ে যায়। এই একরাতের পরিধানগুলির দাম হয়ত ১০ থেকে ১২ ক্রাউন বা আরও বেশি।
ফরিস্তা লিখছেন ফিরোজ যে সব পরিকাঠামো গড়ে ছিলেন তার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র অন্যতম ছিল। আবুল বাকি বলছেন তিনি এধরণের অন্তর ৫০টি মাদ্রাসা তৈরি করিয়েছিলেন যেখানে রাষ্ট্র শিক্ষকদের মাইনে দিত। এগুলির মধ্যে সবথেকে প্রখ্যাত ছিল ফিরুজাবাদের ফিরোজশাহী মাদ্রাসা যার বর্ণনা বার্নি বিশদে দিয়েছেন। এখানে পড়াতেন রুমি, বহু শিক্ষককে সমরখন্দ থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছিল। দিল্লির লাহোর গেটের কাছে তার পুত্র ফাতা খানের সমাধিতে সে শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে তার নাম কদম শরিফ।
সিকান্দর লোধি(১৪৫৮-১৫১৮)র বিষয়ে ফরিস্তা লিখছেন, এ সময়ে অমুসলমানেরা পার্সি পঠন পাঠন আর ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থায় অংশ নিলেন। একশ বছরও লাগল না, তাঁরা হয়ে উঠলেন ইসলামি জ্ঞানীদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার উপযুক্ত। তিনি আয়ুর্বেদকে পার্সি ভাষায় অনুবাদের কাজ শুরু করান। সিকান্দর লোধির প্রধানমন্ত্রী মিঞা ভোয়া, সুলতানের নির্দেশে হাকিম আর বৈদ্যদের দিয়ে বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা লেখান। এই বইটির নাম দেওয়া হয় মাদনুষ সাইফি সিকান্দরি। ওয়াকয়াতি মুস্তাকি লিখছেন এই বইটির নাম টিবইসিকান্দরি, সে সময় ভারতে আয়ুর্বেদ বিষয়ে এর থেকে ভাল বই আর ছিল না। তার সূত্র থেকে জানতে পারি সেই সময় খোরসান এবং অন্যান্য এলাকা থেকে থেকে পাঁচজন হস্তলেখবিদ নিয়ে আসা হয়েছিল সব ধরণের বিজ্ঞান বিষয়ে পুস্তক তৈরির জন্য। মুঘল আম্লের জ্ঞানচর্চা নিয়ে বিশদে চর্চা হয়েছে। পরম আমরা মুঘল বিদুষীও ছেপেছি। ফলে এখন মুঘল আমল এড়িয়ে যাওয়া গেল।
প্রযুক্তি শিক্ষা
ইসলামি যুগের আগে থেকেই বাংলা তথা ভারত শিল্প উৎপাদনে মাহির ছিল। তবে সে প্রচেষ্টা কিছুটা গতি পায় ইসলামি আমলে। বিশেষ করে বয়ন শিল্প, সূচের কাজ করা ফেজ টুপি, চিত্রিত এবং এনামেলের কাজ করা পাত্র, বিভিন্ন তৈজস্পতে, ইস্পাতের বন্দুক, ছুরি, কামান, কাঁচি, সাদা কাগজ, সোনা রূপা এবং নানান দামি ধাতুর অলঙ্কারের কাজ আজও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই প্রযুক্তি বিষয়ে বিশদ বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চা ছাড়া এত অগ্রগতি যে করা যেত না তা বলাই বাহুল্য। গৃহস্থ ভিত্তিকই হোক বা শিক্ষাক্ষেত্র, উস্তাদেরা ছিলেন শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রে। তাঁর গুণ আর তাঁর শিক্ষা দেওয়ার মানের ওপর নির্ভর করত সেই ক্ষেত্রটির উতকর্ষ। শাগির্দরা গুরুর বাড়িতে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন - এই ব্যবস্থাটা আগে আমরা আলোচনা করা শিক্ষানবিশী ব্যবস্থারই অনুরূপ।
আদতে শিক্ষাব্যবস্থার বাইরের রূপ আর গন্ধ পরিবর্তন ঘটলেও যে শুদ্র শিক্ষা ব্যবস্থার কথা আমরা আলোচনা করছি, তার মৌলিক কোন পরিবর্তন আসে নি, যতদিন না বিশ্বাসঘাতক, দেশিয় শিল্প-বিদ্যাচর্চা ধ্বংসকারী মধ্যবিত্তকে ট্যাঁকে নিয়ে দেশিয় জ্ঞানচর্চা ভিত্তিক উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থা ধ্বংস করে নি। পারিবারিক ক্ষেত্রে বাবা পুত্রের শিক্ষার দায়িত্ব নিতেন, আর মা পুত্রীর। বিভিন্ন ধরণের প্রযুক্তির যন্ত্র তৈরি করার অসীম দক্ষতার বিকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন পরিবারে - যেমন নক্ষত্র যন্ত্র - এস্ট্রোলেবেল তৈরি করতেন চার প্রজন্মের পরিবারে বিকশিত লাহোরের শেখ আল্লাদাদএর পুত্র মুল্লা ইশার পুত্র কায়িম মহম্মদের পুত্র জিয়াউদ্দিন মহম্মদ। এই যন্ত্রের চাহিদা ছিল সারা এশিয়া জুড়ে। ইওরোপের কথা না বলাই ভাল।
কারখানা
ওস্তাদ-শাগির্দ পরম্পরার বাইরে গড়ে উঠেছিল কারখানা ব্যবস্থা। প্রথমে ছিল শুধুই উৎপাদন ব্যবস্থা, কিন্তু ক্রমশ তাঁরা উৎপাদনের পাশাপাশি শিক্ষা দিতেও উদ্যমী হয়। এই ব্যবস্থা যাতে ঠিকমত চলতে পারে তার জন্য শাসকেরা জনকৃত্য বিভাগ সুরাতিআম তৈরি করেন। এই বিভাগের কাজ ছিল কারখানাগুলি ঠিক মত চলছে কিনা তা দেখা শোনা করা এবং তাঁরা যাতে সঠিকভাবে শিক্ষা দান করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। প্রত্যেক কারখানায় বিভিন্ন বিভাগ থাকত, সেখানে থাকত নানান কাজের যন্ত্র কাজের বিভাগ অনুসারে।
বার্ণিয়ে বিভিন্ন কারখানা ঘুরে দেখে তার বিশদ বিবরণ দিয়ে গিয়েছেন। বড় একটি ঘরকে কারখানা বলা হত। হয়ত সেটি বিভিন্ন উপঘরে ভাগ করা হত। একটি ঘরে সূচীকারীরা ওস্তাদের নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত হয়ে আছেন। অন্য ঘরে হয়ত আছেন স্বর্ণিকার, কোথাও চিত্রকর, কোথাও গালার কাজের শিল্পী, কোথাও বা বার্নিশ হচ্ছে, পঞ্চম ঘরে জোড়াদার, টার্নার, দর্জি, আর মুচি কাজ করছেন একযোগে, ষষ্ঠ ঘরে মসলিন, তসর, রেশম কাপড় দিয়ে উষ্ণীষ, ব্রোকেড, সোনার ফুল, ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে মহিলাদের জন্য - সেগুলি এতই স্পর্শকাতর যে এক রাত্র পরলেই সেগুলি নষ্ট হয়ে যায়। এই একরাতের পরিধানগুলির দাম হয়ত ১০ থেকে ১২ ক্রাউন বা আরও বেশি।
No comments:
Post a Comment