ইউনিভার্সিটিজ অব ইওরোপ ইন মিডল এজেস বইতে হেস্টিংস রাশডাল বলছেন মধ্যযুগের
ইওরোপে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বোঝাত বিভিন্ন সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক,
ছাত্র, গবেষক, শহরে থাকা নানান ধরণের প্রযুক্তিবিদদের মিলিত জ্ঞানচর্চার
প্রচেষ্টাকে। তিনি যাকে স্টুডিয়াম জেনারেল বলে অভিহিত করছেন, সেটিই আসলে
আজকের লব্জে বিশ্ববিদ্যালয়। স্টুডিয়াম জেনারেল বলতে কিছু নিদির্ষ্ট
জ্ঞানচর্চার শিক্ষক এবং ছাত্রর সমাহার বোজাহত, এবং ছাত্ররা আসত শুধু
স্থানীয় অঞ্চল থেকে নয়, দূরদূরান্ত থেকেও - তাঁরা পড়ত উচ্চ শিক্ষার তিনটে
মূল বিষয় - ধর্মতত্ত্ব(থিওলজি), আইন এবং ডাক্তারি(ল এন্ড মেডিসিন) - পরে
কোনোদিন ব্রিটিশ পুর্ব ভারতের বিস্তৃত পড়াশোনার বিষয়াবলী আর সেই সময়ের
ব্রিটেনের পড়াশোনার তুলনামূলক আলোচনা করব। ইওরোপের সব থেকে পুরোনো
স্টুডিয়াম ছিল দ্বাদশ শতের ইতালির বোলোনা এবং রেজিওতে, এবং ফ্রান্সের
প্যারিসে আর ইংলন্ডের অক্সফোর্ডে। ভারতে যে জেসুইটরা জ্ঞান নথি করতে
এসেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ ছিলেন ইতালিতে শিক্ষিত - বিশেষ করে ম্যাটিও
রিশি।
সাধারণত আমরা খুব বেশি ইওরোপপন্থী নই। কিন্তু বর্তমান ভারতে বহু শিক্ষিত মানুষের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রপাত ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে, ইওরোপিয় বিশ্ববিদ্যালয় ধারণা ভারতে নিয়ে আসার উদ্যম - যা সর্বৈব মিথ্যে।ভারতে এই প্রচেষ্টার বহু আগে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সম শিক্ষা পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে বৃহতবঙ্গের নানা স্থানে। আজকে আমরা বিহারেরগুলি আলোচনা করব। বর্তমান বিহারে, অতীতে বিহার নামে একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল, যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন, শিক্ষাদান করতেন। এই বিহারে বিপুল সঙ্খ্যক ভিক্ষু থাকতেন, যারা বিদ্যচর্চা করতেন নির্লিপ্তভাবে। প্রাথমিকভাবে একএকটি বিহারের দায় নিতে হত একটি সঙ্ঘকে। প্রত্যেক বিহারের প্রবীন ভিক্ষুরা একজন শিষ্যকে শিক্ষিত করার ভার নিতেন, তাকে পাঠ করতে শেখাতেন, ধর্ম কি বলতেন, এবং নির্দিষ্ট সময়ে তার পরীক্ষা নিতেন, তার অগ্রগতি বুঝতেন। বিশ্ব জুড়ে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের সুযোগ বাড়তে থাকায় যারা সরাসরি বৌদ্ধ ধর্মের জ্ঞানচর্চার অংশ নন, তাদেরকেও বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চায় নিয়ে আসাহল উপশাখা নাম দিয়ে। ক্রমশঃ শধু ধর্মচর্চার পাশাপাশি ব্যাকরণ, দর্শন, ডাক্তারি, জ্যোতর্বিদ্যা সহ নানান কলা ও বিজ্ঞান শেখানোর ব্যবস্থা হল। প্রত্যেক বিহারে গড়ে উঠেছিল জটিল ব্যবস্থাপনার এক বিস্তৃত পরিসর, এবং তার ফলে বিভিন্ন ধরণের জ্ঞানচর্চা অধ্যয়ণের সুযোগও বাড়ল। রমশ গঠিত হতে শুরু করল বিশেষ করে পূর্বভারতে নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, জগদ্দল বিহারের মত বিশালাকৃতি জ্ঞানচর্চা, বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্র।
নালন্দা
নালন্দা এক সময় অবৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র ছিল। গয়া ছিল বহুকালের সনাতন ধর্মের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। নাগার্জুন, তারানাথের স্মৃতি লিখতে গিয়ে, বৌদ্ধ জনগ্য এবং ব্রাহ্মণ সুদুর্জয়ের তর্কযুদ্ধের বিশদ বিররণ দিচ্ছেন। পঞ্চম শত পর্যন্ত সনাতন ধর্মের বড় জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান ছিল নালন্দা। গুপ্ত রাজাদের সময় এই অঞ্চলে বেশকিছু বিশালাকৃতি বিহার গড়ে উঠতে থাকে, এই অঞ্চলের দিকচক্রবাল ঢেকে দেয়। সেই জ্ঞানচর্চার ইতিহাস চলতে থাকে একাদশ শত পর্যন্ত - ইসলামি ধ্বংসক্রিয়া পর্যন্ত। নালন্দা ছিল এক মাইল লম্বা একমাইল চওড়া এলাকা নিয়ে তৈরি এক বিশাল বিদ্যালয়। ৩০০টি পড়ানোর ঘর ছিল। ৭টি বিশাল বিশাল প্রেক্ষাগৃহ ছিল। যশোবর্মার শিলালিপি আমাদের বলে বিশ্ববিদ্যালয়টি এত উঁচু ছিল যে সেটি যেন আকাশ চুম্বন করত(সেই সময় প্রত্যেক তলাকে বিমান নামে অভিহিত করা হত)। কোরিয় তীর্থযাত্রী হুই লুন বলছেন, নালন্দা বর্গাকার এলাকাছিল, প্রত্যেক সিংহ দরজা ৩৬ ফুট উঁচু ছিল। সবথেকে বড় প্রেক্ষাগৃহের পাশে ছিল বিশাল একটা স্তুপ, এবং বিভিন্ন ধরণের মণিমুক্তো এবং দুর্মূল্য পাথরে সাজানো চৈত্য - জল ঘড়ি সময় রাখত।
হিউএনসাং বলছেন ১০০০০ ছাত্র এবং শিক্ষক ছিলেন। ইতসিং(৬৭৫খ্রি) ৩০০০ ছাত্র দেখেছিলেন। শিক্ষক ভিক্ষুর সংখ্যা ছিল ১০০০ থেকে ১৫০০। হিউএনসাং বলছেন ১০০০ ভিক্ষু ২০টি আর ৫০০ জন ৩০টি, আড় ১০ জন- যাঁদের মধ্যে তিনি পড়েন ৫০টি বিভিন্ন সূত্র আর শাস্ত্র বিশদে বোঝাতে পারতেন। এই জ্ঞানচর্চার ধারা বজায় রাখতে। রত্নসাগর, রত্নদধি রত্নরাজ্ঞক নামে তিনিটি সুবিশাল গ্রন্থাগার ছিল। এই গ্রন্থাগারগুলিতে ইতসিং ৪০০টি সংস্কৃত শাস্ত্র থেকে ৫ লক্ষ শ্লোক নকল করে দেশে নিয়ে যান।
যদিও নালন্দার খ্যাতি ছিল মহাযান বিশেষ করে বসুবন্ধু, নাগার্জুন, অসঙ্গ, ধর্মকীর্তির নানান বিদ্যাচর্চা জ্ঞানচর্চা ক্ষেত্র রূপে; কিন্তু হীনযান জ্ঞানচর্চা, আথবা বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য জ্ঞানচর্চা যেমন বেদ, হেতুবিদ্যা, শব্দবিদ্যা এবং আয়ুর্বেদ পড়ানো হত। ভারতে এমন কোন জ্ঞানচর্চা ছিল না যা নালন্দায় পড়ানো হত না। চিন, কোরিয়া, তিব্বত এবং তোখারা থেকে ছাত্ররা পড়তে আসতেন সেখানে, পড়াতেন বিশ্বশ্রুত পণ্ডিতেরা। ফলে বিশ্বের নানান স্থানে নালন্দার ছাত্র শিক্ষদের চাহিদা ছিল উত্তুঙ্গ। পাশের বাড়ির তিব্বতে অষ্টম শতে রাজা চন্দ্রাগোমিনের উদ্যোগে তব্বতীয় বিদ্যা শুরু হয়, বিভিন্ন বৌদ্ধ এবং সংস্কৃত গ্রন্থ তিব্বতী ভাষায় অনুদিত হতে থাকে। চিনে নালন্দার ছাত্র হিসেবে অষ্টম শতে শুভঙ্কর সিংহ এবং দশম শতে ধর্মদেব পড়াতে যান। তবে নালন্দার পাঠ্যক্রম পাওয়া যায় নি।
সাধারণত আমরা খুব বেশি ইওরোপপন্থী নই। কিন্তু বর্তমান ভারতে বহু শিক্ষিত মানুষের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রপাত ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে, ইওরোপিয় বিশ্ববিদ্যালয় ধারণা ভারতে নিয়ে আসার উদ্যম - যা সর্বৈব মিথ্যে।ভারতে এই প্রচেষ্টার বহু আগে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সম শিক্ষা পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে বৃহতবঙ্গের নানা স্থানে। আজকে আমরা বিহারেরগুলি আলোচনা করব। বর্তমান বিহারে, অতীতে বিহার নামে একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল, যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন, শিক্ষাদান করতেন। এই বিহারে বিপুল সঙ্খ্যক ভিক্ষু থাকতেন, যারা বিদ্যচর্চা করতেন নির্লিপ্তভাবে। প্রাথমিকভাবে একএকটি বিহারের দায় নিতে হত একটি সঙ্ঘকে। প্রত্যেক বিহারের প্রবীন ভিক্ষুরা একজন শিষ্যকে শিক্ষিত করার ভার নিতেন, তাকে পাঠ করতে শেখাতেন, ধর্ম কি বলতেন, এবং নির্দিষ্ট সময়ে তার পরীক্ষা নিতেন, তার অগ্রগতি বুঝতেন। বিশ্ব জুড়ে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের সুযোগ বাড়তে থাকায় যারা সরাসরি বৌদ্ধ ধর্মের জ্ঞানচর্চার অংশ নন, তাদেরকেও বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চায় নিয়ে আসাহল উপশাখা নাম দিয়ে। ক্রমশঃ শধু ধর্মচর্চার পাশাপাশি ব্যাকরণ, দর্শন, ডাক্তারি, জ্যোতর্বিদ্যা সহ নানান কলা ও বিজ্ঞান শেখানোর ব্যবস্থা হল। প্রত্যেক বিহারে গড়ে উঠেছিল জটিল ব্যবস্থাপনার এক বিস্তৃত পরিসর, এবং তার ফলে বিভিন্ন ধরণের জ্ঞানচর্চা অধ্যয়ণের সুযোগও বাড়ল। রমশ গঠিত হতে শুরু করল বিশেষ করে পূর্বভারতে নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, জগদ্দল বিহারের মত বিশালাকৃতি জ্ঞানচর্চা, বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্র।
নালন্দা
নালন্দা এক সময় অবৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র ছিল। গয়া ছিল বহুকালের সনাতন ধর্মের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। নাগার্জুন, তারানাথের স্মৃতি লিখতে গিয়ে, বৌদ্ধ জনগ্য এবং ব্রাহ্মণ সুদুর্জয়ের তর্কযুদ্ধের বিশদ বিররণ দিচ্ছেন। পঞ্চম শত পর্যন্ত সনাতন ধর্মের বড় জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান ছিল নালন্দা। গুপ্ত রাজাদের সময় এই অঞ্চলে বেশকিছু বিশালাকৃতি বিহার গড়ে উঠতে থাকে, এই অঞ্চলের দিকচক্রবাল ঢেকে দেয়। সেই জ্ঞানচর্চার ইতিহাস চলতে থাকে একাদশ শত পর্যন্ত - ইসলামি ধ্বংসক্রিয়া পর্যন্ত। নালন্দা ছিল এক মাইল লম্বা একমাইল চওড়া এলাকা নিয়ে তৈরি এক বিশাল বিদ্যালয়। ৩০০টি পড়ানোর ঘর ছিল। ৭টি বিশাল বিশাল প্রেক্ষাগৃহ ছিল। যশোবর্মার শিলালিপি আমাদের বলে বিশ্ববিদ্যালয়টি এত উঁচু ছিল যে সেটি যেন আকাশ চুম্বন করত(সেই সময় প্রত্যেক তলাকে বিমান নামে অভিহিত করা হত)। কোরিয় তীর্থযাত্রী হুই লুন বলছেন, নালন্দা বর্গাকার এলাকাছিল, প্রত্যেক সিংহ দরজা ৩৬ ফুট উঁচু ছিল। সবথেকে বড় প্রেক্ষাগৃহের পাশে ছিল বিশাল একটা স্তুপ, এবং বিভিন্ন ধরণের মণিমুক্তো এবং দুর্মূল্য পাথরে সাজানো চৈত্য - জল ঘড়ি সময় রাখত।
হিউএনসাং বলছেন ১০০০০ ছাত্র এবং শিক্ষক ছিলেন। ইতসিং(৬৭৫খ্রি) ৩০০০ ছাত্র দেখেছিলেন। শিক্ষক ভিক্ষুর সংখ্যা ছিল ১০০০ থেকে ১৫০০। হিউএনসাং বলছেন ১০০০ ভিক্ষু ২০টি আর ৫০০ জন ৩০টি, আড় ১০ জন- যাঁদের মধ্যে তিনি পড়েন ৫০টি বিভিন্ন সূত্র আর শাস্ত্র বিশদে বোঝাতে পারতেন। এই জ্ঞানচর্চার ধারা বজায় রাখতে। রত্নসাগর, রত্নদধি রত্নরাজ্ঞক নামে তিনিটি সুবিশাল গ্রন্থাগার ছিল। এই গ্রন্থাগারগুলিতে ইতসিং ৪০০টি সংস্কৃত শাস্ত্র থেকে ৫ লক্ষ শ্লোক নকল করে দেশে নিয়ে যান।
যদিও নালন্দার খ্যাতি ছিল মহাযান বিশেষ করে বসুবন্ধু, নাগার্জুন, অসঙ্গ, ধর্মকীর্তির নানান বিদ্যাচর্চা জ্ঞানচর্চা ক্ষেত্র রূপে; কিন্তু হীনযান জ্ঞানচর্চা, আথবা বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্য জ্ঞানচর্চা যেমন বেদ, হেতুবিদ্যা, শব্দবিদ্যা এবং আয়ুর্বেদ পড়ানো হত। ভারতে এমন কোন জ্ঞানচর্চা ছিল না যা নালন্দায় পড়ানো হত না। চিন, কোরিয়া, তিব্বত এবং তোখারা থেকে ছাত্ররা পড়তে আসতেন সেখানে, পড়াতেন বিশ্বশ্রুত পণ্ডিতেরা। ফলে বিশ্বের নানান স্থানে নালন্দার ছাত্র শিক্ষদের চাহিদা ছিল উত্তুঙ্গ। পাশের বাড়ির তিব্বতে অষ্টম শতে রাজা চন্দ্রাগোমিনের উদ্যোগে তব্বতীয় বিদ্যা শুরু হয়, বিভিন্ন বৌদ্ধ এবং সংস্কৃত গ্রন্থ তিব্বতী ভাষায় অনুদিত হতে থাকে। চিনে নালন্দার ছাত্র হিসেবে অষ্টম শতে শুভঙ্কর সিংহ এবং দশম শতে ধর্মদেব পড়াতে যান। তবে নালন্দার পাঠ্যক্রম পাওয়া যায় নি।
No comments:
Post a Comment