রাভা বয়ন কর্মশালা
১৪ অক্টোবর থেকে ২৮
অক্টোবর,
খট্টিমারি গোঁসাইহাট
বনবস্তি, ধুপগুড়ি, জলপাইগুড়ি
জলপাইগুড়ির ধুপগুড়ির
কাছে গয়েরকাটা জঙ্গলের বাইরের গ্রামে বসবাস করা খট্টিমারির গোঁসাইহাট বনবস্তিতে
রাভা সমাজের প্রায় ভুলে যাওয়া বয়ন শিল্পের দক্ষতাকে নতুন করে শান দিতে ওয়াটাগের
সদস্য সংগঠন কলাবতী মুদ্রা এবং ভারতীয় মানব বিজ্ঞান সর্বেক্ষণের যৌথ উদ্যোগে, ১৪
অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর, ২০১৬ আয়োজন করা হল একটি কর্মশালা। এই উদ্যোগে গোঁসাইহাট
বনবস্তির রাভা সমাজের প্রায় ৩০ জন বয়নদক্ষ মহিলা অংশগ্রহণ করেন।
রাভা সমাজ আজও
পুরোপুরি প্রায় জঙ্গলের উতপাদনের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে তাদের প্রধান খাদ্য
কচু, তারা যাকে সুজি নামে ডেকে থাকেন, তা তারা এই জঙ্গল থেকেই পান – তাদের একটি
অসাধারণ পদ কচু দিয়ে ডাল – সুজি ডাল অসামান্য। এছাড়াও মাছ, জঙ্গলের ছাতু এবং বেত গাছের একাংশ তারা তাদের খাদ্যরূপে ব্যবহার
করেন- আজও অধিকাংশ মানুষ কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িতে থাকেন। এছাড়াও রাভা সমাজ
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় অন্যতম সুখাদ্য স্টিকি রাইস বা মণ্ড ভাত খান। এই ভাতটি খেতে
অসাধারণ – অসাধারণ পুষ্টিকরও। কম্বোডিয়া, হংকং, লাওস, ভিয়েতনাম,
থাইল্যান্ডএ বিভিন্ন দামি হোটেলে সুন্দর করে সাজিয়ে স্টিকি রাইস – বা মণ্ড ভাত
খেতে দেওয়া হয় সক্কাল বেলায় প্রাতঃরাশ হিসেবে। এই রাভা সমাজ আজও এই ভাত খান নিজেরা
চাল চাষ করে – সকালে এই ভাত খেয়ে তারা কাজ করতে চলে যান জঙ্গলে বা নিজেদের জমিতে। এছাড়াও পাহাড়ী জঙ্গল থেকে বেরোনো
নোনাই নদী বা সুল্টুং সহ অন্যান্য ছোট ছোট ঝোরার ছোট ছোট মাছ, কাঁকড়া আর চিংড়ির
অসাধারণ সব পদ তৈরি করেন এই মানুষেরা – যার স্বাদ অনাস্বাদিত অন্তত শহরের মানুষের
কাছে। এখনো এই গ্রামে রান্নার জন্য গ্যাস পৌঁছয়নি। রান্না হয় জঙ্গলের কাঠে।
রান্নার স্বাদই অসাধারণ আজও। বিশেষ করে যারা তেল মশলা একটু কম ভাল বাসেন তাদের
কাছে বেত গাছের আগা পোড়া পেঁয়াজ, জঙ্গলের রসুন দিয়ে মাখা অথবা কাঁকড়ার সাধারণ তেল
দিয়েই চাটনি বা ছোট মাছের রান্না করা সাধারণ পদ অসাধারণ স্বাদ অনুভব করতে সাহায্য
করে। এই পনের দিনে তারা তাদের পরম্পরার খাদ্য রান্না করে বাইরে থেকে যাওয়া
অতিথিদের এবং স্থানীয় অংশগ্রহণকারী দক্ষ কারিগরদের জন্য দৈন্দিনভাবে রান্না করেছেন।
রাভাদের যে আশিটা
গোষ্ঠী রয়েছে পূর্ব ভারত জুড়ে, তারা প্রত্যেকে কাপড়ে নিজস্ব গোষ্ঠীর নিজস্ব ধরণের নকশা
তৈরি করে পরতেন – আজও পরেন – যা দিয়ে তারা পরস্পরকে চিনতে পারেন তারা কোন গোষ্ঠীর
মানুষ। গোঁসাইহাট বনবস্তির রাভাদেরও দীর্ঘ দিনের বয়ন
বিদ্যার চর্চা ছিল। কিন্তু বিগত দুই তিন দশকে তারা তাদের ঐতিহ্যসম্পন্ন বয়ন বিদ্যার চর্চা হাতে কলমে করছিলেন না। অর্থাৎ নিজেরা আর নিজেদের পরার কাপড় নিজেরা বুনছিলেন না। তারা বাইরের
বাজার থেকে পরিধেয় বিগত প্রায় তিন দশক ধরে কিনছেন। অথচ বহু কাল ধরে এই সমাজ তুলো
চাষ থেকে শুরু করে কাপড়ে রঙ করা থেকে শুরু করে ঠকঠকি বা তাঁতপোই(কোমরে বাঁধা
তাঁতে) তাঁতে কাপড় তৈরি করতে মাহির ছিলেন।
যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে
ওয়াটাগের সদস্য সংগঠন, বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘ এবং কলাবতী
মুদ্রা রাভা সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, রাভা সমাজের বহু মানুষ তাদের সদস্য ফলে
তারা রাভা সমাজের মাথাদের কাছে নিবেদন করছিল যাতে তারা তাদের নিজেদের বস্ত্র
নিজেরা বুনে নিতে পারে এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া। বোনা আর পরার পরে যদি কিছু কাপড় উদ্বৃত্ত হয় তাহলে সংঘ সেই কাপড় তাদের নিজেদের বিক্রয় কেন্দ্র পরম মাটি বা
খোলা বাজারে বিক্রি করে দেওয়ায় সাহায্য করবে – কিন্তু প্রাথমিক কাজ হবে রাভা
সমাজের নিজেদের হারিয়ে যাওয়া বয়ন ব্যবস্থা উদ্ধার করা – কাপড় বুনে নিজেরা পরা –
তার পরে বাণিজ্য। রাভা সমাজের মোড়ল গনাত রাভা এবং তার শিষ্যা
সিতিন রাভা সংঘের এই আবেদনে সাড়া দেন। ঠিক সেই সময়েই ভারতীয়
মানব বিজ্ঞান সর্বেক্ষণের পূর্বাঞ্চলীয় দপ্তরের অবরনির্দেশক কাকলী চক্রবর্তী
মহাশয়া কালতালীয়ভাবে যৌথভাবে এই ধরণের একটি কর্মশালা আয়োজন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন
– যেখানে তাঁরাই সমস্ত খরচ করবেন নিজেদের হাতে। এই তিন পক্ষর সঙ্গে কথা বলে ঠিক হয়
দুর্গা পুজো শেষ এবং কালী পুজো শুরুর মাঝামাঝি সময়েই এই ১৫ দিনের কর্মশালাটি আয়োজন
করা হবে।
একটি উদ্বোধনী
অনুষ্ঠনের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। উদ্বোধনে ছিলেন অবরনির্দেশক স্বয়ং, স্থানীয়
বিধায়ক, জেলার জেলাপরিষদের সভাধিপতি এবং স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান।
সেই দিন দুপুরে
খাওয়াদাওয়ার পর থেকেই বয়ন দক্ষতায় শান দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যায়। সমাজের মধ্যে
থেকেই দক্ষ মহিলা বয়নবিদেরা এক সঙ্গে জড়ো হয়ে এই কাজে হাত লাগান – হয়ত তারা দুতিন
দশক তাঁতে হাতই দেন নি – কিন্তু কয়েক হাজার বছরের দক্ষতা তো কয়েক দশকে উপে যেতে
পারেনা। তারা অনায়াস দক্ষতায় দুটো গোটা তাঁত তৈরি থেকে বয়নের কাজ শুরু করেদেন
কর্মশালার মধ্যেই – সেই তাঁত খাড়া হতে লাগে মাত্র দুদিন – অবিশ্বাস্য – নাদেখলে
বিশ্বাসই করতাম না – কি দক্ষতা আজও রয়েছে এই মহিলাদের মধ্যে। তার সঙ্গে চলে দু
রকম তাঁতে কাপড় বোনার দক্ষতার শান দেওয়া। সমাজের প্রবীনা এবং দক্ষ কারিগরেরা
নবীনদের এই কাজে হাতে তাঁতে শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন এই পনের দিন ধরে।
এ ছাড়াও অবাক হয়ে
দেখা গেল এই সমাজে প্রায় প্রত্যেক বিবাহিতা নারীই তকলি আর চরকায় সুতো কাটতে
অসাধারণ দক্ষ। ফলে সংঘ বাঁকুড়া বর্ধমান বা নদীয়ায় রাজ্য কৃষি দপ্তরের তুলো চাষের
উতপাসন কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেই তুলো এই সমাজের দক্ষ কাটুনিদের দিয়ে কাটানো
যাবে। আরও তথ্য পাওয়া গেল যে অন্তত কুড়ি বছর আগে এই সমাজে কাপাস তুলোর চাষ হত –
সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে নানান কারণে। চাষের প্রস্তাব দেওয়ায় তারা নতুন করে কাপাস তুলোর চাষ করার
কাজে সম্মতি প্রদান করেছেন। বিশেষ করে এগিয়ে এসেছেন সিতিন রাভা। তিনি বলছেন যেহেতু
তারা হাতির উপদ্রবে বছরে মাত্র একবার ধান/ফসল চাষ করতে পারেন, তাই একবার ধান চাষ
করার পরই তাদের জমি সারাবছর ফাঁকা থেকে যায়। সংঘ যদি তাদের তুলো চাষে সাহায্য করে
তাহলে সে বিষয়ে তাদের কাজ করতে অসুবিধে নেই। তিনি নিজের পাঁচ বিঘে জমি এই কাজে
লাগাতে ইচ্ছুক বলে জানিয়েছেন।
সঙ্গে উপরি পাওনা
ছিল রাভা মুখোশের নতুন জন্ম। রাভা সমাজের মুখোশ নৃত্য বহু পুরোনো কৃষ্টি। কলাবতী
মুদ্রা এবং বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘ যৌথভাবে বহু কাল ধরে তাঁদের
নিবেদন জানিয়ে আসছিলেন তাঁরা যদি এই মুখোশের কাজটি নতুন করে চালু করেন – সংঘের এক
সদস্য বিশ্বেন্দু নন্দ এই মুখোশটি ২০০৭ সালে সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু যে মানুষটি
এই কাজ করতেন তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়ায় সেই কাজ বন্ধ করে দেন। তো
এই বস্ত্র বয়নের দক্ষতা শান দেওয়ার অনুষ্ঠানে তিনি নতুন করে উদ্বুদ্ধ হন। আবার
তাদের দৈনন্দিন জীবনের বাঁশের নানান ব্যবহার্য দ্রব্য আর তার সঙ্গে মুখোশ তৈরি করা
শুরু করলেন এই অনুষ্ঠানে।
No comments:
Post a Comment