মেচ বাঁশের মাছ ধরার
ফাঁদ কর্মশালা
১৮ অক্টোবর থেকে ২৭
অক্টোবর,
মধ্যনারারথলি,
কুমারগ্রাম, আলিপুরদুয়ার
রাভা বয়ন শিল্পের
কর্মশালার প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কলাবতী মুদ্রা, ভারতীয় মানব বিজ্ঞান
সর্বেক্ষণকে বাঙলার নতুন জেলা আলিপুর দুয়ারের মধ্যনারারথলীর মেচ গ্রামে তাদের ভুলে
যাওয়া বাঁশের মাছ ধরার ফাঁদ তৈরির কর্মশালার প্রস্তাব দেয় এবং পূর্বাঞ্চলের
অবরনির্দেশক কাকলী চক্রবর্তী সেই প্রস্তাবটি সানন্দে গ্রহণ করেন। শর্ত হল
কর্মশালার ব্যয়বরাদ্দ এবং সেই কর্মশালার খরচ ভারত সরকারেরে এই সঙ্গঠনটি নিজেরাই
নিজেদের হাতে করবেন। যেহেতু কলাবতী মুদ্রা এবং বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র
শিল্পী সংঘ মূলত চাঁদা ভিত্তিক সংগঠন, সেহেতু এই প্রস্তাবে তাদের কোন সমস্যাই হয়
নি।
তো রসিক বিল আর
কামাক্ষ্যাগুড়ির থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এবং ৩১সি জাতীয় সড়ক থেকে কয়েক মিটার
দূরত্বে অবস্থিত মধ্যনারারথলী গ্রামে মেচ বা মেচিয়া সমাজের বাস। এরা গয়েরকাটা
জঙ্গলের উপকণ্ঠে বাস করা গোঁসাইহাট রাভা বস্তির রাভা সমাজের মত জঙ্গল ভিত্তিক নয় –যদিও
কয়েক প্রজন্ম পূর্বে তারা তা ছিল – যা আমাদের জানিয়েছিলেন মেচ সমাজের প্রয়াত মাথা
দারেন্দ্র ঈশ্বরারী মশাই কয়েক বছর আগে – যদিও সমাজের সামাজিক বন্ধন যথেষ্ট দৃঢ,
কিন্তু জীবনযাত্রায় এঁদের শহুরে প্রভাব বেশ জোরদার। খাওয়াদাওয়ায় অনেকটা বাঙ্গালি
প্রভাব। রাভাদের মতই তারা নিজেদের বুননটা হয়ত ভোলেন নি, কিন্তু গত দুদশক তা আর
নিজেদের হাতে করেন না।
১৮ তারিখ
সর্বেক্ষণের অবরপ্রধান, স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত বোড়ো সাহিত্য সভা এবং কলাবতী
মুদ্রার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কর্মশালাটির উদ্বোধন হয়। সেদিন দুপুরের খাওয়ার পর
থেকেই শুরু হয়ে যায় কর্মশালার কাজ।
কিন্তু সুখের বিষয়
হল বাঁশ দিয়ে মাছ ধরার ফাঁদ তৈরির কর্মশালার ভাবনা বাড়তে বাড়তে কিন্তু চলে যায়
তাদের জীবনের আচারের সঙ্গে যুক্ত বাঁশ দিয়ে তৈরি নানান ধরণের উপকরণ তৈরির
কর্মশালায়। দ্রুত খবর ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেচ/বোড়ো সমাজের নানান ধরণের
প্রতিনিধির উপস্থিতির বহর বাড়তে থাকে ক্রমশ। তাঁরাও সহর্ষে, সগর্বে অংশগ্রহণ করতে
থাকেন এই কাজে। এই সাধারণ ছোট্ট কর্মশালাটি দাঁড়িয়ে যায়
সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের কর্মকাণ্ডে।
সে এক অসাধারণ
অভিজ্ঞতা। উদ্বোধনের দিনই যদিও কর্মসূচীতে ছিল না, তবুও তারা একটি তাঁত এনে বসিয়ে
দিয়েছিলেন, কর্মশালাটি যেখানে হচ্ছে - মধ্যনারারথলীর মানসিং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
প্রাঙ্গণে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে তৈরি হয়ে উঠল তাঁদের বাথৌ আচারের প্রাণকেন্দ্র সিজ
মনসা গাছের নিচে থাকা বাঁশের তৈরি বিশেষ ঘেরাটোপ, চাষের মই, সুতো কাটা মাকু,
বাঁশি, বাচ্চাদের খেলনা আরও সব নাজানি কি। এ সব তৈরি হতে থাকল মেচ সমাজের যুবকদের অংশগ্রহণে।
অংশগ্রহণকারী অনেকের
সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাভা গ্রামের বয়ন কর্মশালার কথা। তারাও খুব উতসাহী সে ব্যাপারে।
বললেন কুড়ি তিরিশ বছর আগে তাদের গ্রামে বাড়ি বাড়ি চাষ হত সাদা কাপাস তুলো – সেই
তুলো দিয়ে তারা তাদের কাপড় বুনতেন। অন্তত বিশ বছর আগেও প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে ছিল তাঁত – সেই
তাঁতে কাপড় বুনতেন গাঁয়ের মেয়েরা – যে কাজে তাদের একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। কথা
বলতে বলতেই এসে হাজির এক বয়স্কা মহিলা তকলি দিয়ে সুতো কাটতে কাটতে – সে এক
অনির্বচনীয় দৃশ্য। তিনি সগৌরবে জানালেন পাঁচশ মেচ বসতির গ্রামে আজও কয়েকশ
মহিলা সুতো কাটতে পারেন তুলো থেকে, নিজের হাতে।
স্বাভাবিকভাবেই
সমাজের মানুষদের সঙ্গে কর্মশালার বাইরে বসে প্রস্তাব দেওয়া হল, তারা কি তুলো চাষে
ইচ্ছুক? তুলো কাটতে ইচ্ছুক? এক স্বরে স্থানীয় যুবারা বলে উঠল ব্যবস্থা করেন আমরা
আছি। কর্মশালা চলা কালীন ঠিক হয়ে গেল পরের মাসে ঠিক এই তারিখের কাছাকাছি তুলো বীজ
নিয়ে আর তুলো চাষের উদ্গাতা সৌমিক মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আমরা মেচ গ্রামে আসছি। মেচ
সংগঠনের যুবা নেতা রাজীব ঠাকুর নিজে পাঁচ বিঘেতে তুলো চাষ করতে বড়ই ইচ্ছুক। সংঘ
তাঁদের একটি সংগঠন তৈরি করিয়ে দিচ্ছে, যে সংগঠনের মাধ্যমে তারা সংঘের বা ওয়াটাগের
যৌথ উদ্যোগে বা শুধু নিজেরাও তুলো চাষ, সুতো কাটা, সুতো রঙ করা এবং কাপড় তৈরি এবং
ব্যবসা করতে পারবেন সরাসরি বাজারের হাতে নিয়ন্ত্রিত না হয়েও।ইতিমধ্যে কথা হয়েছে,
সৌমিকবাবু কিছু তুলো পরীক্ষামূলকভাবে মধ্যনারারথলীতে পাঠাবেন সুতো তৈরির জন্য।
তো ইতিমধ্যে বাঁশের
যে কর্মশালা চলছিল তাও দারুণ রূপ পেতে থাকল – যা আপনারা এই ছবিগুলিতে দেখতে
পাচ্ছেন।
No comments:
Post a Comment