গুরুদের মাইনে মাসে চার আনা থেকে শুরু করে পাঁচ টাকা পর্যন্ত হত। যারা কম অর্থ পেতেন তাদের কাপড় দেওয়া হত, আর চাষীদের কাছ থেকে চাষের জিনিষও পেতেন। এছাড়াও কেউ হয়ত শুধুই প্রতিদিনকার খাদ্য পেতেন, কেউবা এর সঙ্গে পরিধেয় ধোয়া, অথবা তাঁর সমস্ত খরচপাতিও পেতেন। যিনি খাদ্যপেতেন তাঁর হয় নিজের বাসস্থান থাকত অথবা গ্রামের অবস্থাপন্ন ব্যক্তির ভদ্রাসনে থাকতেন। সামগ্রিকভাবে শুধু আর্থিক অথবা কিছুটা আর্থিক আর কিছুটা অন্যান্যভাবে যাঁরা রোজগার করতেন, তাঁদের প্রত্যেক মাসের রোজগার ছিল তিনটাকা আটআনা থেকে সাত টাকা আট আনা পর্যন্ত, গড়ে পাঁচটাকার বেশি সকলেই রোজগার করতেন। তিনি উদাহরণস্বরূপ ধারাইলের বিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এই গ্রামে চৌধুরিদের চারটি পরিবার বাস করত। এরাই গ্রামের সম্ভ্রান্ত। কিন্তু এদের আর্থিক অবস্থা এত ভাল ছিলনা, যে অন্যান্যদের সাহায্য ব্যাতীত তাঁরা গুরুমশাই নিয়োগ করতে পারেন। এংরা বাড়ির এক অংশে গুরুমশাইএর থাকার ব্যবস্থা করেন, যেখানে বটুরা পড়াশোনাও করত। এই স্থানটি পুজোর জন্যও ব্যবহার হত আবার অতিথি নিবাসও ছিল। দুটি পরিবার চারআনাকরে, তৃতীয় পরিবার আটআনা আর চতুর্থজন বারো আনা এই কাজে দিতেন। এর বাইরে তাঁরা আর কোনো কিছুই দিতেন না। এই অর্থে পাঁচটি বটু বাঙলা ভাষায় শিক্ষা পেত। কিন্ত এই অর্থে গুরুমশাইএর চলা মুশকিল ছিল, তাই তিনি অন্য পরিবার থেকে বটুর ব্যবস্থা করতেন – এক বটু দিত একআনা, একজন তিন আনা, পাঁচজন চার আনা করে গুরুমশাইকে মাসে সাম্মানিক দিত। এর বাইরে নানান শষ্য, মাঠ, চাল আর কখোনো কখোনো কেউ রুমাল(গামছা!), ফতুয়ারমত(আপার গার্মেন্ট) নানান পরিধেয়ও দিত। কাগবাড়িয়ার দুটি পরিবারের পাঁচটি বটু ধারাইল পাঠশালায় পাঠ নিত। এই দুই গ্রামের মধ্যে প্রায় এক মাইলের পার্থক্য।
তিনি গুরুমশাইদের পাওয়া মাইনের সঙ্গে গ্রামের প্রায় একই স্তরের কাজ করা মানুষের রোজগারের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। স্থানীয় জমিদারদের নানান কাজে যারা নিযুক্ত হতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন পাটওয়ারি, আমিন, শুমারনাভি আর খামারনভিস। পাটওয়ারির কাজ ছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে জমিদারদের খাজনা উশুল করা, মাইনে পেতেন দুটাকা আট আনা সঙ্গে রায়তদের কাছথেকে শষ্য উঠলে বেশ কিছু জিনিষপত্তরও যার প্রায় মূল্য আট আনা, সবে মিলিয়ে তিন টাকা। আমিনদের কাজ ছিল জমিদারদের পক্ষে গ্রমের জমিজমার পরিমান মেপে বিবাদের সমাপ্তি ঘটাতেন। তিনি পেতেন মাসে সাড়ে তিন টাকা থেকে চার টাকা। শুমারনভিস পাটওয়ারিদের আদায়ের হিসেব রাখতেন, পেতেন পাঁচ টাকা প্রতি মাসে। আর অনেক জমিদার জমির ফসল থেকেই যখন খাজনা আদায় করার জন্য খামারনভিস রাখতেন তারা অনেক কম অর্থ পেতেন। জমিদারিতে যেসব আমলা কাজকরতেন তাদের অনেকেরই উপরি আয়ের সুযোগ থাকত, যে সুযোগটি এই গুরুমশাইদের ছিলনা।
গ্রামে পাঠশালার জন্য আলাদা করে গৃহ স্থাপিত হত না। যে স্থানে বটুরা পাঠ নিত সেই স্থানটি নানান কাজে নানাম সময়ে ব্যবহৃত হত। কেউ কেউ চন্ডিমন্ডপেই পাঠদিতেন, পাঠগ্রহণ ছাড়াও সেখানে সারা বছর নানান ধরনের পুজো, পার্বন ও অনুষ্ঠান হত। কোথাও কোথাও গ্রামের আড্ডার জন্য নির্দিষ্ট বৈঠকখানায়ও এই পাঠশালা আয়োজিত হত। কোনো কোনো পৃষ্ঠপোষক আবার নিজের বাস্থানের এক অংশ ছেড়ে দিতেন পাঠশালের জন্য। ৩০-৪০বটর জন্য যে সব পাঠশাল, সেগুলো বছরের শুকনো সময়ে খোলা যায়গায় আর বর্যার সময় তিন চারটি অস্থায়ী পাতায় ছাওয়া কুঁড়ে ঘরে হয়। বেশি বর্যা এলে বটুদের পাততাড়ি্ গুটেতে হত। ছাপার হরফে পুস্তকের কথা গ্রামাঞ্চলে কেউ জানতইনা বলা চলে। তবে কিছু কিছু ছাপাই পঞ্জিকা(এলম্যনাক) অবস্থাপন্ন পরিবারের গৃহস্থরা কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে যেতেন। একজনও গুরুমশাই ছাপার বই দেখেননি। এডাম এদের স্কুল বুক সোসাইটির প্রকাশনায় পুস্তক দেখান। গুরুমশাইরা এগুলো খুবেশি গুরুত্ব দেননি। সোসাইটি বইগুলি বিক্রির জন্য বাউলিয়ায় একজন দালাল ঠিক করেছে বলেও তিনি জানান। প্রত্যেক গুরুমশাই তাঁর স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে পাঠদান করতেন। পাঠশাল শেষ হত স্বরস্বতী বন্দনা দিয়ে। একজন নেতা পোড়ো এই বন্দনা আবৃত্তি করত, বটুদের প্রত্যেককে ভুঁইএ মাথা ঠেকিয়ে বন্দনার একটার পর একটা স্তবক আবৃত্তি করতে হত যাতে এই বন্দনাটি তাদের স্মরণে থাকে। এছাড়াও ছড়ায় ছড়ায় শুভঙ্করী(এডামের ভাষায় ককার অব বেঙ্গল)ও শেখানো হত।
No comments:
Post a Comment