চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে দেশজুড়ে নেমে আসে হঠাত গজিয়ে ওঠা জমিদার আর নানান মধ্যসত্বভোগীর সংখ্যা।
১)জমিদার - জমিদার শ্রেণী মধ্যসত্বভোগীদের ত্রিভূজের চূড়ায়। এদের সঙ্গেই কেম্পানি সরকার রাজস্ব গ্রহন করে। এরা সবথেকে প্রতাপশালী মধ্যসত্বভোগী। অথচ জমির এপর সার্বভৌম অধিকার ছিল কিন্ত সরকারের। ইরেজ শাসকই জমিদারদের নির্দিষ্ট রাজস্ব ঠিক করেদিত, নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব দিতে না পারলে জমিদারি নিলাম করে দেওয়া হত। সর্বোচ্চ দরে যে কোনো কেউ কিনে নিতে পারতেন। এই দালালির কাজ করেই বহু মানুষ ধনী হয়েছেন।
২)তালুকদার – জমিদারের নিচে তালুকদারেরা। এরা চার প্রকার – ক) খারিজা, খ) বাজেয়াপ্তি – এরা নিজের নামে আলাদা আলাদা কালেক্টরিতে খাজনা দিতে পারতেন, গ)সামিলাত ঘ) পত্তনি বা পাট্টাই- জমিদার নিজের নিজের এলাকাকে ভাগ করে ছোটছোট এলাকায় বেঁটে পাট্টার সাহায্যে বিলি করত তার নাম পত্তনি। জমিদার উট্ঠেদ হলে পত্তনিদারও উচ্ছেদ হতেন। সামিলাতে কিন্তু তা হত না।
৩) জোদ্দার, গাঁতিদার, হাওলাদার প্রভৃতি তালুকদারের পরে অবস্থান। জোতদারের অধীনে যারা জমা নিত তাদের বলাহত কারফা বা কোলজানা প্রজা। যারা জোতদার গাঁতিদার খামার জমি চাষ করে মোট মজুরি বাবদ সাদারণতঃ মোট উতপন্নের অর্ধেক পেত তাদের বর্গ-জোতদার বা আধিয়ার বলত।
৪) এবার মৌরসী মোকরররী – মৌরসী অর্থ পুরুষানুক্রমিক আর মোকরররীর অর্থ খাজনার এক প্রকার হার। সুতরাং তালুকদারিরমত এটিও বংশ পরম্পরায় ভোগদখল। এরা পত্তনিদারেরমত মেয়াদি বা হস্তান্তরে অযোগ্য শর্তে জমি বিলি করতে পারত।
৫) ইজারাদারেরা তালপকদার বা জমিদারদের কাছ থেকে বড় এক এলাকা নির্দষ্চ কালের জন্য বন্দোবস্ত নিয়ে পূর্ববর্তী মালিকদের স্বত্ব-সামিত্ব বা ভোগদখল বা হস্তান্তর করতে পারত। দায়সূদী বা পাচানী ইজারাদার মালিকদের কিছু টাকা অগ্রিম বা ঋণ দিয়ে যে সুদে ঐ টাকা সুদে আসলে শোধ নাহত, সে পর্যন্ত ইজারার উপস্বত্ব ভোগ করত।
৬) লাখেরাজ – নিষ্কর সম্পত্তির মালিক। এছাড়াও ছিল দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর, ভোগোত্তর, মহাত্রাণ, চেরাগী, পীরোত্তর নানান ধর্মী। কাজে এ ধরণের সম্পত্তি দেওয়া হত।
৭) ওয়াকফ বা ট্রাস্টএর হাতে জনহিতর কাজ করার জন্য
৮) চাকরান বা পাইকান
১৭৯৮-৯৯সালে বাঁকুড়া, মেদিনীপুর জুড়ে এক বিরাট অঞ্চলে ব্যাপক বিদ্রোহ দেখা দেয়, ইতিহাসে যেটি চোয়াড় বিদ্রোহ নামে মুখ ঢেকে বসে আছে। অন্যান্য বিদ্রোহেরমত এটির প্রচার কম, কেননা চোয়াড় শব্দটি মধ্যবিত্ত বাঙালির জগতে গালিরূপেই ব্যবহার হয়ে এসেছে। সেই অবহেলিত, অভিধানে বর্ণিত দুর্বৃত্ত, অসভ্য, নীচ জাতি, অবজ্ঞাত মানুষগুলি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার সাধারণ মানুষের বিদ্রোহের আকাঙ্খার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে বিপ্লবের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন গ্রামের পর গ্রাম। এই বিদ্রোহকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পথানুগামী ঐতিহাসিকেরা তাঁদের লেখা ইতিহাসে স্থান দেননি। বাঙালি মধ্যবিত্তের শহুরে ঔপনিবেশিক ভাষার মারপ্যাঁচের খামখেয়ালিপনায়, অসভ্যতার দাগে দাগি এই সনাতন জনসমাজ, লুঠেরা বণিক-শাসকদের বিরুদ্ধে যে পরাক্রামে লড়াই করেছিল, সেই প্রচেষ্টা সমকালীন ইতিহাসে স্থান না হলেও স্থানীয় লব্জে আর কিছু সমকালীন নথিপত্রে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এই বিদ্রোহের অমর কাহিনী আজও নানান ঐতিহাসিক লড়াইএর আত্মনিবেদনে নিবেদিত মানুষের প্রেরণা।
No comments:
Post a Comment