প্রাইস তার চোয়াড় রেবেলিয়নএ লিখছেন, ১৭৯৮-১৭৯৯, মেদিনীপুরের ইতিহাসকে ভয়ঙ্কর চোয়াড় বিদ্রোহের ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে। কত রোমহর্ষক ঘটনা, চোয়াড় বিদ্রোহকে বিভত্স করে তুলেছিল। সরকার তাদের দীর্ঘকালের ভোগদখল করা জমি কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে চোয়াড় সর্দারেরা আর পাইকেরা ভয়ানক মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছিল। জঙ্গলমহলের প্রত্যকটি আদিবাসী এই অত্যাচারকে নিজেদের বিরুদ্ধে অত্যাচার হিসেবে ধরে নিয়িছেল। ম্যাজিস্ট্রেটের দরজা পর্যন্ত তারা হত্যা আর ধংসের আঘাত হেনেছে। মেদিনীপুরের সাধারণ পুলিশ আর সৈন্যদল এই বিদ্রোহ দমন করতে ব্যর্থ হওয়ায় জেলায় সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। শাসককুলের দীর্ঘসময়ের অস্থিরতা, নানান পাশবিক হত্যাকান্ডের পর পরের বছর জেলায় আংশিক শান্তি ফিরে আসে। এঅ বিদ্রোহ ১৭৯৮তে হঠাতই শুরু হয় নি। বহু আগে থেকেই এর লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছিল। প্রশাসনের বোঝা উচিত ছিল।
মেদিনীপুরের গেজেটের লেখক ওম্যালিও একই সুরে চোয়াড় বিদ্রোহের বর্ণনা করেছেন। ওম্যালিসহ অনেকেরই অভিযোগ, বিদ্রোহীরা নিরীহ প্রজাদের ওপরেও অত্যাচার করেছে। এর একটা বাস্তব কারণ রয়েছে। ইংরেজরা চোয়াড় আর পাইকদের জমি দখল করে প্রজা পত্তন করেছিন এ কথা আগেই বলা গিয়েছে। সেই পত্তনি প্রজাদের ওপরেও যে বিদ্রোহীরা প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করবে একথা বুঝতে খুব বড় বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে সে সময়কার শাসকেরা স্বীকীর করেছেন বিদ্রোহীরা প্রথমে প্রজাদের ওপরে আক্রমণ করে নি। বিদ্রেহীরা তাদের প্রথমে তাদের শুধু চাষ করতে দেয় নি। তাদের রণনীতি ছিল, কেড়ে নেওয়া জমি থেকে যেন শাসকেরা এক টাকাও রোজগার করতে না পারে। যারা বিদ্রোহীদের সঙ্গ দেয়নি বিদ্রোহীরা সেই প্রজাদের ইংরেজদের সহযোগী হিসেবে দেখেছিলমাত্র।
ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা বিদ্রোহ ক্রমশঃ জ্বলতে শুরু করে মেদিনীপুরের রায়পুর পরগণা অঞ্চল থেকে। পরগণার জমিদার দুর্জন সিংহ ইংরেজদের দাবিমত রাজস্ব দিতে অপারগ হওয়ায় জমিদার দুর্জনের জমিদারি কেড়ে নিয়ে অন্য একজন ক্রেতার কাছে অনেক বেশি মূল্যে বিক্রয় করে দেয়। দুর্জন প্রতিশেধের জন্য চোয়াড়-পাইকদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। চোয়াড় পাইকরা রায়পুরে প্রবেশ করে নতুন জমিদারকে তাড়িয়ে জমিদারি দখল করে। তহশিলদারকে খাদ্যদ্রব্য দাবি করলে তহশিলদার পালিয়ে যায়। ১৭৯৯এর মার্চের শীতে রায়পুরের বেশকিছু গ্রাম দখল করে। নতুন প্রজাদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়, অনেকে আহত হয়, প্রজারা পালিয়ে যেতে থাকায় তাদের ছেড়ে যাওয়া জমি দখল করে বিদ্রোহীরা। আমলা-কর্মচারীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে এসে মেদিনীপুরে আশ্রয় নেয়। রায়পুরে সৈন্য উপস্থিত হলে যুদ্ধশুরু হয় এবং বিদ্রোহীরা রায়পুর ছেড়ে পালায়।
মে মাসে রায়পুরের নায়েবের কাছারি লুঠ করে জ্বালিয়ে দেয়। গুনারি থাকার কাছারিতে সৈন্য দলের ছাউনি আক্রমণ করলে সারারাত যুদ্ধ হয়। বিদ্রোহীরা পালিয়ে যায়। আবার দেড়মাস পর আবার বিদ্রোহীরা পরগণায় সৈন্যদলকে তাড়িয়ে পরগণা দখল করে। প্রধান বাজার কাছারি দখল করে পুড়িয়ে দেয়, বিদ্রোহীরা মাটির দুর্গ তৈরি করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। এবার রামগড় পরগণা দখল হয় জুনে। পরগণার এক বড় অংশ জনশূণ্য হয়ে পড়ে। চন্দ্রকোণা আক্রমণ করেন গোবর্ধন দিকপতির নেতৃত্বে চোয়াড় পাইকরা। কলকাতা থেকে আসা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে বিদ্রোহীরা পালায়। নয়াবসান আর বড়জিতে আক্রমণ করে ধনীদের বাড়ি থেকে সম্পদ আর খাদ্য লুঠ করে। এরপর কাশীজেড়া, বাসুদেবপুর, তুর্কাচর, জনেশ্বর, বলরামপুর, জুবাজল, রামগড়, শালবনী প্রভৃতি পরগণার ওপর আক্রমণ আর লুঠ চালাতে থাকে বিদ্রোহীরা। নিরাপত্তার অভাবে, রাতে মেদিনীপুর শহর পাহারাদেওয়ার জন্য একটি বাহিনী সবসময়ে জন্য রাখা হতে থাকে। চ্যাপা বাহাদুপুরেরে অত্যাচারী ইজারাদার কৃষ্ণ ভুঁইয়া চোয়াড় বিদ্রোহীদের হাতে প্রাণ হারান। গ্রামের পর গ্রামের মানুষ পরগণা ছেড়া পালাতে থাকে, ইংরেজরা সেনা মোতায়েনের অভয় দিয়েও তাদের পলায়ন রোখা যায় নি।
No comments:
Post a Comment