লুঠেরা ইংরেজ বণিকদের, এবং তাদের সাম্রাজ্যের সহচর বন্ধু, অত্যাচারের সরাসরি সঙ্গী লুঠেরা মধ্যবিত্ত বাঙালির যখন থেকেই জঙ্গলমহলে সম্পদের ওপর বিষ নজর পড়েছে, তখন থেকেই নরমে গরমে গণতন্ত্রপ্রিয়, চরম আত্মসম্মানবোধের অধিকারী আদিবাসীদের সঙ্গে ছোটখাট গন্ডগোল চলছিল। এই অঞ্চলের অদিবাসীরা নিজেদেরমত করে বিনাখাজনায় স্বাধীণভাবে চাষবাস করে পূজ্য প্রণম্য প্রকৃতির ক্ষতি না করে নিজেদের সমাজের বিকাশে নীরবে কাজ করে চলেছিলেন। ইংরেজ আমলেক আগে কী কেন্দ্রিয় শাসক কী স্থানীয় শাসক কেউ তাঁদের এই প্রবণতায় হস্তক্ষেপ করতে চায় নি। কিন্তু ইংরেজ শাসক আর তাদের নব্য লুঠেরা বন্ধুরা, যারা এতদিন সনাতন সমাজের কঠোর নজরদারিরমধ্যে বসবাস করতে বাধ্য থাকত, ইংরেজ শাসকদের পদপ্রান্তে আনত তারাই সনাতন সমাজে নামিয়ে আনল অত্যাচারের ঘুর্ণাবাত। চিরাচরিত রাজস্ববিহীন এই জমিগুলি ইংরেজরা বলপূর্বক কেড়ে নিয়ে উচ্চ খাজনায় নব্যজমিদারদের অধিকারে দিয়ে দিতে থাকে। এই সমাজগুলির প্রতিবাদ ক্রমশঃ ধ্বনিত হতে থাকে। আত্মসম্মানবোধে ভারপুর এই সমাজগুলির প্রতিবাদ অত্যাচারের নিচে দাবিয়ে দিতে দিতে এই সব জমিতে প্রজা পত্তন ঘটতে থাকে। আর হাজার হাজার বছরের দখলি জমি চোখের সামনে বেহাত হয়ে যাওয়ায় ধংসের মুখে পড়ে সমগ্র সমাজ আর এতদিনের বিকশিত সংস্কৃতি। যার অনিবার্য পরিণতি বাঁকুড়া মেদিনীপুর জেলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিদ্রোহের ছাইচাপা আগুণ জ্বলতে থাকে ধিকি ধিকি।
মেদিনীপুরেরে সেটলমেন্ট অফিসার, জে সি প্রাইস, তার নোটস অন দ্য হিস্টোরি আব মেদিনীপুরএ বলছেন পাইক বিদ্রোহ নিয়েও আলোচনা করছেন। চোয়াড় সমাজগুলোর পাশাপাশি আর এক সমাজও এই বিদ্রোহে নিজেদের অত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত হয়, সেই সমাজটির নাম পাইক সমাজ। মোগল আমলে পাইকদের কাজ ছিল সমাজে আরক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করা। এই কাজে তারা মোগলদের কাছ থেকে বিনা খাজনার জমি চাষের জন্য পেতেন। সেই জমিও ইংরেজ গায়ের জোরে দখল নিতে শুরু করে। মোগল সাম্রাজ্যের অবসানে এ ধরণের নানান প্রফেসনলসদে জীবনে অস্থিরতা নেমে আসে। এদের জীবিকার নিশ্চয়তা না দিয়েই ইংরেজরা এসব গোষ্ঠীগুলিকে বাড়ন্ত ঘোষণা করেদিল। এদের বহু বছরের কর্মের অপর আঘাত শুধুই এল না, এদের বদনে একশ্রেণীর আরক্ষাবাহিনীকে এদের কাজ করতে দিয়ে তাদের ব্যয় তোলার অজুহাতে এদের বংশপরম্পরায় অধিকৃত নানান সুযোগ সুবিধে কেড়ে নিতে শুরু করে। পশুশক্তির সাহায্যে পাইকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে সেই জমি কয়েকজন বশংবদ জমিদারদের অধীনে রাজস্বের জন্য দিয়ে দেয়। প্রাইস বলছেন এধরণের পঁচিশ হাজার পাইক পিতৃপুরুষের জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। জমিহারা বাস্তু হারা পঁচিশ হাজার পাইক, অসন্তোষের আগুনে ঝিকি ঝিকি জ্বলা চোয়াড়দের সঙ্গে যোগদিয়ে চোয়াড় বিদ্রোহের পরিবেশে ধোঁয়া দিয়ে একত্রে বিদ্রেহের অবস্থা ঘনিয়ে তুলল।
এ সময় ইংরেজদের দাবিমত বিপুল পরিমান করের বোঝা বহু সনাতন জমিদার পরিবার মেনে নিতে পারে নি। চিরাচরিতভাবে নবাবদের সঙ্গে যে ধরণের রাজস্ব প্রদানের শর্ত পূরণ করে এসেছেন এ ধরণের জমিদারেরা, সেই ধরণের শর্তের বাইরে না যেতে চাইলে কর্নওয়ালিশের নতুন ভূমিসত্ব আইন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুযায়ী এদের জমিদারি উচ্চমূল্যে নিলামে ওঠে এবং রাতারাতি এগুলি দখল হয়ে যেতে থাকে। এই অঞ্চলের জমিদারেরা পাইক-চোয়াড়দের অসন্তোষের পারদ অরও বাড়িয়ে দিয়ে তাদের বিদ্রোহে যোগ দেয়। এই জমিদারদের মধ্যে দুর্জন সিংহ অন্যতম, যিনি তার কাজকর্মে বিদ্রোহীদের শ্রদ্ধা অর্জন করে ওঠেন।
সেসময় মেদিনীপুরের কালেক্টরও মিনহফ মন্তব্য করেন যে, ইংরেজ শাসনের অপরিমিত সম্পদ-লুন্ঠন ক্ষুধা এই বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে রূপান্তরিত করে দিত পেরেছিল। তিনি সরাসরি বিচারক-ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট গ্রেগরিকে অভিশুক্ত করেন। সে সময় লুঠেরা শাসকদের ঔদ্ধত্য দেখে বিতশ্রদ্ধ তিনি রেভিনিউ বোর্ডকে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন কেন এ অঞ্চলে পাইক চোয়াড় বিদ্রোহ আজ প্রকাশ্যে এসে পড়ার যোগাড় হয়েছে। অন্যদিকে প্রাইস বলছেন রাণী শিরোমণীর বিশাল রাজত্বে ব্যাপক হারে পাইকদের জায়গির জমি দখলের ফলে পাইকদের মনে অসন্তোষ দেখা দেয়। ফলে বিক্ষুব্ধ পাইকেদের এক অংশ সরকারের ওপর আনুগত্য হারিয়ে ফেলে চোয়াড়দের সঙ্গে সরাসরি হাত মেলায়। এরা যখন দেখল ভ্রাতৃপ্রতীম চোয়াড়দের জীবনে ইংরেজদের দখলদারি নেমে এসেছে, তখন এদের বুঝতে দেরি হয় নি যে আগামীদিন এদের জীবনে দুর্বিসহ হয়ে উঠতে চলেছে।
No comments:
Post a Comment