১৭৯৯ বছরের শুরুতে প্রাইস বলছেন, মেদিনীপুর পরগণাটি জনমানবহীন হয়ে পড়ে। একদিকে নারা,ণগড়, অন্যদিকে মেদিনীপুর শহরের চৌদ্দ মাইল দূরের হুদ্দাঘোষপুর থানায ভরঙ্কর তান্ডব চালায়। শালবনীর তহশিলদারের কাছারি, দপ্তর, সৈন্য ছাউনি সবকিছু পুড়িয়ে দেয়। কর্মচারীদের হত্যা হচ্ছে দেখে প্রজারা পালাতে শুরু করে। কয়েকদিনের মধ্যে শালবনী শ্মশানে পরিণত হল। মেদিনীপুরের অদূরে আনন্দপুরের থানা জ্বালিয়ে দেওয়ার উপক্রম হয়। বিদ্রেহীরা নানান কাছারির জমির নানান নথিপত্র পুড়িয়ে বহ্নুত্সব করতে থাকে।
বিদ্রোহীদের হুমকিতে রাজস্ব আদায় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ট্যাপা-বাহাদুরপুরে রাজস্ব আদায়ের কর্মচারী পাওয়া যাচ্ছিলনা। কালেক্টর লিখলেন, যদি সেনাবাহিনী পাঠানো না হয়, তাহলে পরের বছর কোনো কৃষিকাজ করা সম্ভব হবে না। মেদিনীপুর শহরের চারদিকে চোয়াড়-পাইকদের তীব্র আক্রমণ চলতেই থাকে। শহরে সেনাদল থাকায় শহরে তাদের আক্রমণ না হলেও জেলার নানান পরগণায় এই আক্রমণ ক্রমাগত চলে। ৭ আর ৯ মার্চ রেভিনিউ বোর্ডকে চিঠিলিখে কালেক্টর জানান সকলেই মেদিনীপু শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছে, মফঃস্বলের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গুজব ছড়াতে শুরু করে চোয়াড় বিদ্রোহীরা ১৯ মার্চ মেদিনীপুর শহর আক্রমণ করে শহর পুড়িয়ে দেবে। শহরের আশ্রয় নেওয়া বাসিন্দারা আতঙ্কি দিশাহারা হয়ে পড়ে। মেদিনীপুরের সেনা প্রধানের কাছে কালেক্টর একটি চিঠি পাঠান, আমি জেলার অবস্থা বর্ণনা করার ভাযা খুঁজে পাচ্ছিনা। শোচনীয় অবস্থা মেদিনীপুর পরগণার। বিদ্রোহীরা অবাধে লুঠ করছে। আমার পক্ষে দেখা সম্ভব হচ্ছেনা। ১৪মার্ট রাতে দুটি গ্রাম লুঠ হয়েছে। ১৫মার্ট শিরোমণি নামে বড় গ্রামও লুঠ হয়। দুই গ্রামেই প্রচুর শষ্য ছিল, তাতে যে আগুণ লাগিয়ে দেয় সেই আগুন পরেরদিন পর্যন্ত জ্বলছিল। প্রচুর সরকারি দলিল নষ্ট হয়েছে। শতপতি অঞ্চল পুণর্দখল সম্ভব হয়নি। এই অঞ্চলটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাহাদুরপুর পরগণা এখনও জনশূন্য। কেউই সেখানে যেতে সাহস পাচ্ছনা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। সমগ্র মেদিনীপুর পরগণার বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সয়ে শয়ে মানুষ শহরে আসছেন আশ্রয় নিতে ার শহরের লোক শহরের হাইরে পালাচ্ছেন আতঙ্কিত হয়ে। সংবাদটি সত্য বলে মনে হচ্ছে আর কিছুদিন পরে (মেদিনীপুর)শহর আক্রমণ করে ধংস করে ফোলবে। সমগ্র জেলায় রাজস্ব আদায় সম্পূর্ণ বন্ধ আছে, সমস্ত জেলায় আরাজক অবস্থা চলছে, লাঙলের একটিো আঁচড় পড়ে নি। এই পরগণার ২৬টি গ্রামে বহু সরকারি সম্পত্তি লুঠ হয়েছে। ।।। আমার সুনাম আর মানসিক বল নষ্ট হতে বসেছে। আমার অবস্থা এতই শোচনীয় যে চোয়াড়দের এই অসহনীয় দৌরাত্ম্য আমাকে নীরবে বসে দর্শকেরমত চুপ করে দেখতে বচ্ছে। ।।।এখন বেলা বারেটা, এখানথেকে দুই ক্রেশদূরে একটি গ্রামে লুঠ করে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রামের অধিবাসীদের রক্ষার জন্য একটি সেনাদল পাঠানোর তোড় জোড় চলছে – এটাই জেলার প্রকৃত অবস্থা।
যে গ্রামটির কথা লিখছেন কালেক্টর সেই মেদিনীপুর শহরেরে থেকেও বড় গ্রামটি গোবর্ধন দিকপতির নেতৃত্বে দুহাজার চোয়াড় লুঠ করে পুড়িয়ে দেয়। উল্লিখিত সেনা বাধা দিতে এলে নিহত হয়। বিদ্রোহ দমন করতে না পেরে অস্থির হয়ে এই বিফলতার কারণ খুঁজতে গিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের সন্দেহ জমিদার দিকে পড়ে। চোয়াড় রেবেলিয়ন বইতে প্রাইস বলছেন, বিদ্রোহীরা জানত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত লৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে পেরে ওঠার আশা নেই। সুতরাং তারা এমন আবস্থা তৈরি করল, জমিদার অথবা অবস্থাপন্ন পরিবারে অথবা সরকারি কর্মচারীদের কাছথেকে সেনা বাহিনী খাওয়ার সংগ্রহ করতে না পারে। তাহলেই খাদ্যের অভাবেই সরকরি বাহিনীকে পালাতে হবে। ফলে তারা সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করে দেয় যাতে সেনী বাহিনীকে কেউ খাবার দিয়ে সাহায্য না করে। বিদ্রোহীরা একে রাণী শিরোমণির নির্দেশ রূপে প্রচার করে। ফলে বহু সেনা বাহিনীকে খাদ্যের অভাবে শহরে ফিরে আসতে হয়েছে।
প্রাইস চোয়াড়দের শৃঙ্খলবোধের কথাও শ্রদ্ধায় উল্লেখ করেছেন। আনন্দপুর গ্রাম আক্রমণকালে সর্দার মোহনলালের অপরিসীম নীতিবোধ আর নিজেদের সেনার ওপর প্রভাব দুটিরই উদাহরণ দিয়েছেন প্রাইস। এমতঅবস্থায় প্রচুর অত্যাচারিত প্রজাও এই বিদ্রেহে স্বইচ্ছায় যোগদানও করে সে সংবাদও কালেক্টরের লেখা থেকে পাওয়া যায়। বোর্ অব রেভিনিউকে লেখা চিঠিতে তিনি বলছেন, সমগ্র মেদিনীপুর জেলাটি জনমানবহীন আর ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।।। সংক্ষেপে বলাযায়, জঙ্গল অঞ্চলের সব জমিদারও চোয়াড়দের সঙ্গে মিলেছে। শাসকদের সন্দেহ হয় জমিদারদের সরাসরি সাহায্য না পেলে চোয়াড়রা এতটা প্রাবল্যে আক্রমণ করতে পারত না। রানি শিরোমণি সেই বিদ্রোহের গোপন পরামর্শদাত্রী ছিলেন, তারা সন্দেহবশে রানী শিরোমণিসহ অনেক জমিদারকে অন্তরীণ করে রাখে। কিন্তু কর্ণগড় অধিকার করার সঙ্গে সঙ্গে সব সৈন্যও দুর্গত্যাগ করে পালাতে থাকে। মেদিনীপুরে আরও সৈন্য আসতে শুরু করে, ফলে মেদিনীপুরের ওপর আক্রমণের আশংকা অনেকটা দূর হয়। কালেক্টর কিছুটা স্বস্তি পেয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে থাকে। তার প্রতিশ্রুতি যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের অভিযোগ বিচার করে দেখা হবে।
No comments:
Post a Comment