সাধারণতঃ ছোকরাদের ছাড়া আর কোনও শিল্পীর পোষাকের প্রতি নজর দেওয়া হয় না। একটা ময়লা ধুতি, ছেঁড়া চটি পরে কোনও অভিনেতা হয়ত মঞ্চে এসে বলেন সে অমুক দেশের রাজা বা তমুক গ্রামের মোড়ল। এই অতিশয়াক্তিতে কোনো দর্শকের বিন্দুমাত্র চিত্র বিক্ষেপ ঘটে না। আর যে অভিনেতা আগের মুহূর্তে রাজার বা রানীর চরিত্রে অভিনয় করে মাতিয়ে দিয়ে গেল বা বাজনদারদের সঙ্গে প্রকাশ্য মঞ্চে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ধুয়া ধরছিল তারস্বরে সেই হয়ত মাথায় ঘোমটা টেনে অর্থাত মাথায় পেতে রাখা গামছাকে মুখের ওপর একটু ঝুঁকিয়ে দিয়ে ঘোমটারমত করে রাজবাড়ির দাসী হয়ে অভিনয় করে আবার নিরুপদ্রবে ধুয়ো ধরতে বসে যায়। আধুনিক নাটকের এটাচমেন্ট – ডিটাচমেন্ট তত্ব তাঁরা শতাব্দর পর শতাব্দধরে প্রয়োগ করে চলেছেন তারা বোধহয় জানেন না। এর পরেও পশ্চিমি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবর্নের শহুরে সমালোচকেরা চসমা উঁচিয়ে, ভুরু তুলে, নাক কুঁচকে নিদান দেবেন গ্রামের লোকনাট্যে সূক্ষ্মতার পরিবর্তে স্থূলতাই বেশি করে প্রকাশ ঘটে।
কয়েক বছর আগে পশুপতি প্রসাদ মাহাতোর ভাঁড় যাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা শেনাচ্ছিলেন, বলছিলেন কীভাবে থার্ড থিয়েচারের বীজ ছড়িয়ে রয়েছে তথাকথিত নিরক্ষর অথচ অভিকর শিল্পে জ্ঞাণীগুণী মানুষদের কাজে। আগেই উল্লেখ করা গিয়েছিল, লোকনাট্যের অনেক আঙ্গিকেই প্রথাগত সাজঘর না থাকায়, অভিনেতারা অভিনয় করার পর বাদ্যকরেদের সঙ্গে বসে কালক্ষেপ করেন. তাদের সঙ্গী হয়ে ধুয়াও ধরেন. চারদিক খোলা মঞ্চে অভিনয়ের জন্য বর্তমান আধুনিক প্রসেনিয়াম নাটকে প্রযুক্ত ক্লক ওয়াইজ আর এন্টি ক্লক ওয়াইজ পদক্ষেপণের জন্য দেহারদের অক্ষদণ্ডধরে অভিনেতারা অভিনয় করেন. এখানেই লোক নাটকের প্রয়োগবাদিতার সমাপ্তি ঘটেনা. সাধারণতঃ যে অঞ্চলে কালাকুশলীরা অভিনয় করতে যান, সেই অঞ্চলেরই কোনও এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে পালাগান বাঁধেন তাঁরা. পুরোটাই কিন্তু গানের ওপর নির্ভর করে. আর অধিকাংশ অভিনেতা নিরক্ষর হওয়ায় তাঁরা কণ্ঠস্থ রাখেন সমগ্র গানগুলি. এই গানগুলির ওপর বিনি সুতোর মালা গাঁথা হয় তাত্ক্ষণিক কথোপকথনের মাধ্যমে. মনসা মঙ্গল বা বিষহরি পালার শেষে অভিনেতারা মনসার উদ্দেশ্য নিবেদিত থালা হাতে করে নেমেযান দর্শকাসনে. গ্রাম্য মহিলারা থালার রাখা প্রদীপের পাশের সিঁদুরে আঙুল ছুঁইয়ে চুড়িতে, সিঁথিতে বুলিয়ে দেন আর প্রদীপের শিখার ওপর হাতের চেটো ধরে সেই তাপ সঞ্চার করেদেন পরবর্তী প্রজন্মের বুকের অন্তরে. প্রতিদানে অবশ্যই দেন কিছুমাত্র দক্ষিণা.
যার মধ্যে এত সম্ভাবনা, যে সংস্কৃতির মধ্যে অন্তঃসলিলা স্রোতেরমত বয়ে চলে দেশজ মানুষের সমষ্টির সবাইকে নিয়ে বাঁচার দর্শণ, যার টানে আজও গ্রামে-গঞ্জে টিভি-সিনেমা-যাত্রার মায়াকুহকময়বিতংস ছাড়িয়েও দর্শক ভিড় করেন পালাগানের টানে, যে ভারতীয় ঐতিহ্যকে সমস্ত কালাপাহাড়ি আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলেছেন এই দুর্দিনে, কেন তার গায়ে অস্তগামী সূর্যের ম্লান কিরণরেখা, কেন তাকে আজও স্বীকার করতে কুণ্ঠা, এই এত কেনর উত্তর পাওয়াটা বেধহয় খুব একটা শক্ত কাজ নয়. তবুও লেটোর হরকুমার, আলকাপের করুণাকান্ত বা অন্যান্য পালাগানের সংদারদের অসম্ভব দেশজ হাল না ছাড়া জেদেই মাটির সুর আর মাটির গান টিকে রয়েছে টিমটিম করে, প্রত্যকটি সমাজের নতুন প্রজন্মের আর সরকারি সমস্ত উপেক্ষা সত্বেও. আজ এক সন্ধিক্ষণ সমাসন্ন, যে সময়ে নতুন করে এই সমস্ত সহজ অথচ অনির্দেশ্য উত্তরগুলি খোঁজার সময় এসেছে শহুরে উদ্যমী, অনুসন্ধিত্সু মানুষজনের সামনে, বিশেষ করে আগামীপ্রজন্মের সামনে কোনো নির্দেশকময় কাজ না করে যেতে পারলে উত্তরপ্রজন্মের ক্ষমা আর পাওয়া যাবে না এ কথা স্পষ্ট করে আজই বলে দেওয়া যাক.
No comments:
Post a Comment