বাংলার ধারের শিল্প, প্রসেনিয়াম থিয়েটারের যখন পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে, তখনই শুরু হয়েছে, সেই বদ্ধজলা থেকে বেরোনোর বিকল্প রাস্তার, আঙ্গিকের খোঁজ। সেই আঙ্গিকের খোঁজে শহুরে ধারকরা নাট্য পা বাড়িয়েছে লোকনাট্যের ব্রাত্য আঙিনায়। সেই খোঁজ কতটা আন্তরিক আর কতটা দায়ে পড়ে সেই পশ্চিমি বিতর্কে না ঢুকে বলা যায়, শহুরে সমাজ আজ বুঝেছে ধারের সম্পদে ঝুলি ভরলে সেই ধারের ভারে একদিন ন্যুব্জ হতেই হয়। তাই ফিরে চলা শেকড়ের পানে। একে একে কলকাতার প্রসেনিয়াম থিয়েটার, যারা বিকল্প ভাবনা, আঙ্গিকের কথা বলেন, একে একে আপন করে নিলেন নানান লৌকিক লোক নাটকের আঙ্গিক। যে কেনো নাট্য উত্সবে লৌকিক আঙ্গিকের নাটক দেখার জন্য লাইন এখন কিংবদন্তির পর্যায়ে, শম্ভু মিত্রের চাঁদ বণিকের পালা শুধুই পাঠ দেখা, মাধব মালঞ্চি কইন্যা, চাক ভাঙা মধু আথবা গোপীচন্দ্রের পালা ভেঙে দেয় সমস্ত নাট্য প্রযোজনার অতীত গৌরব।
আর নতুন করে পশ্চিম থেকে ধার করা থার্ড থিয়েটার, বা থিয়েটার ফর দ্য অপ্রেসড তার প্রেরণা কিন্তু এসেছে লৌকিক নাট্য থেকে। বিংশ শতকের মাঝের দিকে যখন পশ্চিমি(যাকে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রদ্ধাভরে আন্তর্জাতিক ছাপ মেরে দিয়েছে) চিত্রকলা প্রায় গতিহীন হয়ে পড়ে, তখন তাকে পথ দেখাল আফ্রিকার প্রাচীণ মুখোশ, গুহাচিত্র আর অতীতের গুহাচিত্রাবলী। আজ বাংলায় যখন প্রবাদপ্রতীম প্রসেনিয়াম থিয়েটার মুখ থুবড়ে পড়ছে, তার সামনে বিশাল একটা প্রশ্ন চিহ্ন ঝুলে রয়েছে, তখন তাকে সসম্মানে পথ দেখাচ্ছে একদা ব্রাত্য, অশ্লীল, বাংলার নানান লৌকিক নাট্য আঙ্গিক।
পথ দেখানোর কথাই যখন উঠল, তখন একবার বাংলার লোক নাট্যের আঙ্গিকের অন্দরে ঝাঁকি দর্শণ করে আসা যাক। বিশ্বের নানান দেশের লোকনাট্যেরমতই বাংলার লোক নাট্যের অধিকাংশই অভিনীত হয় ভূমি মঞ্চেস প্রসেনিয়ামেরমত অভিনেতা অথবা দর্শকের মধ্যে থাকেনা কোনো আড়াল বা দার্শনিক বিভাজন, লৌকিক জীবনের অংশিদারি দর্শনের অনুসরনে সকলেই যেন একস্তরেই অবস্থান। সেখানে না থাকে কেনো উইংসএর চাপানো বাহুল্য, থাকেনা কোনো তৈরি করা সাজঘর। লৌকক নাটকে বাজনদারেরা একটা বড় অংশ পালন করেন। তাঁরাও যেন একটা বড় অংশিদার। আর এই নাট্য আঙ্গিকের প্রত্যেক অংশিদারেরাই যেন পরিপূর্ণ শিল্পীর মর্যাদা পেয়ে আসেন, তাই কখোনো কখোনো বাজনদারেরাই অবলীলায় অভিনয়ও করেন অথবা গানও গেয়ে ওঠেন। কোনো আঙ্গিকে বাজনদারেরা বলেন আসরের মাঝে আবার কোনো আঙ্গিকে বলেন আসর ঘিরে, মাঝখানের ছাড়া অংশে অভিনীত হয়। আলকাপ পুস্তকে ফণি পালমশাই বলছেন, চণ্ডী মণ্ডপে বা পার্শ্ববর্তী ভাঙা হাটের খোলা ময়দানে বাঁশ পুঁতে সামিয়ানা টাঙিয়েছে। অভাবে কোথাও কোথাও আবার চট বা চাটাই টাঙানো আশ্চর্যের নয়। মাতব্বর লোকেরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে কিছু চাল ডাল সংগ্রহ করছেন, কিছু টাকাও। চাল ডাল সংগ্রহ করে আলকাপ দলের লোকজনদের খাওয়াতে হবে। আর টাকাটা বখশিস।
No comments:
Post a Comment